সাঁকোটা দুলছে
বসিরহাট মহকুমার স্বরূপনগর ব্লকের চারঘাট গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনস্থ গ্রাম খর্দ্দসিং। খর্দ্দসিং গ্রামের উত্তরাংশ উত্তরপাড়া নামে পরিচিত। এই অংশটি জুড়ে আছে স্বরূপনগর বিধানসভা কেন্দ্রের ১৬৭ এবং ১৬৮ নম্বর বুথের প্রায় ১৬০০ ভোটার এবং তাদের পরিবার-সহ প্রায় ৩০০০ মানুষের বাস। প্রায় প্রত্যেকেরই পেশা কৃষিকাজ। এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ইছামতীর শাখা। নদী না বলে খাল বলাই ভাল।
এই উত্তরপাড়ার একমাত্র সড়ক যোগাযোগের উপায় বলতে খালের উপর নির্মিত নড়বড়ে আধভাঙা বাঁশের সাঁকো (ছবিতে)। প্রবীণ ও তাঁদের পরিবারের শিশুরা প্রাণ হাতে করে প্রতি দিন এই সাঁকো পারাপার করেন। জীবনধারণের প্রয়োজন মেটাতে এঁরা নিকটস্থ শাঁড়াপুল বাজার, শাঁড়াপুল ডাকবাংলা মোড়ে যাতায়াত করেন। শিশুরা ওই নড়বড়ে সাঁকো পার হয়ে পড়তে আসে নিকটস্থ শাঁড়াপুল হাটখোলা অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। একটু বড় ছেলেমেয়েরা নির্মাণ এবং মালঙ্গপাড়া কে সি বি ইনস্টিটিউশনে যায় লেখাপড়া করতে। এদের সকলেই আশায় আছে কবে তাদের এই দুর্ভোগ যাত্রার সমাপ্তি হবে। স্কুল, কলেজ, হাট, বাজার— সব কিছুর জন্য ভরসা আধভাঙা সাঁকোটি।
৬০ ফুট চওড়া ইছামতীর খালটির উপর ১৯৯২ সালে স্বরূপনগর পঞ্চায়েত সমিতির উদ্যোগে কাঠের সেতু নির্মিত হয়। কিন্তু ২০০০ সালের প্রবল বন্যায় সেতুটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তার পর গ্রামবাসীদের উদ্যোগে নির্মিত হয় বাঁশের সেতু। সময় যায়, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামবাসীরাও আশায় বুক বাঁধেন। কিন্তু পরিস্থিতি বদলায় না। স্থানীয়রা বিভিন্ন প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক স্তরে আবেদন করে এবং সংবাদমাধ্যমের নজরে আনার চেষ্টা করলেও অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। যদিও স্থানীয় কয়েক জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের উদ্যোগে প্রশাসনের খানিকটা টনক নড়েছে। ফলস্বরূপ তিন-চার মাস আগে সাঁকো নির্মাণ হেতু প্রতিনিধিরা এসে মাপজোখও করেন। স্থানীয় মানুষদের মনে আশার সঞ্চার হয়।
কিন্তু এই ভরা বর্ষায় দুঃসহ আতঙ্ক নিয়ে গ্রামের মানুষগুলির অন্তহীন দুর্দশার সমাপ্তি হয় না। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক দফতরের আধিকারিকদের নিকট নিবেদন, তাঁরা যদি এই বিষয়টি বিবেচনা করে দ্রুত উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, তবে প্রায় ৩০০০ মানুষ একটু নিশ্চিন্ত হয়ে জীবনযাপন করতে পারেন।
তিলক মুখোপাধ্যায়
শাঁড়াপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
অন্যদের কী হবে
রাজ্য বা কেন্দ্রীয় কর্মচারীরাই কি ভারতে একমাত্র মানুষ, যাঁদের খিদে আছে, অভাব আছে? আর বেসরকারি খেটে-খাওয়া কোটি কোটি মানুষের কি খিদে নেই, অভাব নেই? বছরে দু’বার ঘটা করে পে-কমিশন কর্মচারীদের ডিএ বৃদ্ধি করে। কয়েক বছর অন্তর নতুন করে পে-কমিশন গঠিত হয়। নতুন স্কেলে মাইনে বৃদ্ধি হয়। বাড়তে বাড়তে মাইনে কোথায় চলে গেছে! বর্তমানে এক জন চতুর্থ শ্রেণির কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীর মাইনে প্রায় ২৭ হাজার টাকা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দিনে ১২ ঘণ্টা পরিশ্রম করে ক’জন শিক্ষিত মানুষ এই মাইনে পান?
এ ছাড়া সরকারি কর্মীদের ছুটি আছে, বোনাস আছে, অবসর নিলে পেনশন আছে। বাকি মানুষদের কী আছে? দিন আনি দিন খাই অবস্থা। যত দিন শরীর চলবে, তত দিন পেটে ভাত জুটবে। অভাব, অনাহার, অশিক্ষা এঁদের নিত্যসঙ্গী।
এঁদের কথা সরকার ভাবে না। শুধু একতরফা ভাবে সরকারি কর্মচারীদের মাইনে বাড়িয়ে চলেছে। তাই তো চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদের জন্য লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত ছেলে আবেদন করে, পরীক্ষায় বসে।
এ ছাড়া সরকারি কর্মচারীদের নিয়মিত ভাবে মাইনে বৃদ্ধির ফলে কোষাগারে টান পড়ে। উন্নয়নের কাজ অর্থের অভাবে ব্যাহত হয়। সরকার নিশ্চয়ই তার কর্মচারীদের কথা ভাববে। কিন্তু কোটি কোটি অসংগঠিত মানুষদের কথাও ভাবুক। তাঁদের আর্থিক, সমাজিক সুরক্ষা দিক। যে যা-ই বলুক, পে-কমিশন তার কর্মচারীদের একটা এলিট গ্রুপে নিয়ে চলেছে। ভারতের সমস্ত কর্মচারীদের দু’ভাগ করেছে। এটা নিয়ে ভাবনাচিন্তার সময় এসেছে।
তপনকুমার সাঁতরা
সালকিয়া, হাওড়া
বন্যা প্রতিরোধে
জয়া মিত্রের নিবন্ধটি পড়তে পড়তে ১৯৭৮-এর অক্টোবরের একটা দিনের কথা মনে পড়ে গেল (‘নদীকে মেরেছি তাই মরেছি’, ৪-৮)। সে দিন সারা রাজ্যে ’৭৮-এর ভয়ংকর বন্যার পর ময়দানে বামফ্রন্টের জনসভা। সেখানে নেতৃবৃন্দ দাবি করেছিলেন, হুগলি নদী মজে যাওয়ায় কলকাতা বন্দর সে সময় যেমন অচল হয়ে পড়ছে, তেমন একটু বেশি বৃষ্টিতে বঙ্গজুড়ে বন্যা দেখা দিচ্ছে। এর সমাধানের একমাত্র উপায় ৩০-৪০ হাজার কিউসেক (cu ft /sec) জল ফরাক্কা থেকে ভাগীরথীতে পাঠিয়ে হুগলি নদীর পলি সাফ করা। কিন্তু প্রায় ২০০-২৫০ কিমি দূরের ফরাক্কা থেকে ওই জল এলেও হুগলির পলি যে কাটা যাবে না, তা নিয়ে বিশ্লেষণমূলক একটি পুস্তিকা সে সময় শহিদ মিনারের নীচে বেলেঘাটা ফুলবাগানের ‘ইস্ট ক্যালকাটা সোশিয়ো কালচারাল অর্গানাইজেশন’-এর কর্মীরা সাহসের সঙ্গে তুলে ধরেছিলেন। তাতে যুক্তি ও বিজ্ঞানের প্রয়োগে দেখানো হয়, ১৫ মাইল চওড়া হুগলির মোহনার মুখ না কমাতে পারলে ৪০ কেন, ৬০ হাজার কিউসেক জল ফরাক্কা থেকে পাঠালেও কিছু হবে না। তা ছাড়া দামোদরের জলাধারগুলির (মাইথন, পাঞ্চেত, তিলাইয়া, কোনার) জলধারণ ক্ষমতার পরিবর্তন ও নিম্ন অববাহিকার নদীগুলির মজে যাওয়ার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে বাংলার প্রায় ৩০০টি অঞ্চলে প্রদর্শনী করে সংগঠনটি মানুষকে সচেতন করার পরও তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কোনও হেলদোল দেখা যায়নি। বরং ফরাক্কার জল নিয়ে খেয়োখেয়ি করে গেছে।
দক্ষিণবঙ্গে প্রধান নদী হুগলি-ভাগীরথী, যার সঙ্গে সরাসরি সাগরের যোগ। এতে জোয়ার-ভাটা খেলে। হুগলির মোহনা ফানেলের মতো হওয়ায় জোয়ারে যেমন তীব্র বেগ, ভাটায় তেমন বেগ হারায়। ফলে নদীর বুক পলিতে ভরে। নদীবিশেষজ্ঞ কপিল ভট্টাচার্য ১৯৬৫-তে সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ওই মোহনার মুখ ১৫ মাইলের জায়গায় (স্ক্র্যাপ জাহাজে বোল্ডার ভর্তি করে জলে ডুবিয়ে দিয়ে) ২ মাইল করতে পারলে ঠিক উলটো ক্রিয়া ঘটবে। অর্থাৎ ভাটার সময় তীব্র বেগে হুগলির পলি কেটে নিয়ে সাগরে ফেলবে। এতে হুগলির গভীরতা বাড়বে এবং ১০ বছর পর থেকে ড্রেজিং ছাড়াই নদীর নাব্যতা বহু গুণ বাড়বে। এর সঙ্গে হুগলিতে সংযুক্ত রূপনারায়ণ-সহ অন্যান্য নদীর বাড়তি জল বেরিয়ে যাওয়ারও সুযোগ ছিল।
এ ছাড়া উপত্যকায় বনভূমি কেটে সাফ হয়ে যাচ্ছে বলে বৃষ্টির জলের বয়ে যাওয়া (Run Off) যেমন বেড়েছে, তেমন মাটি, নুড়ি ইত্যাদি জলের সঙ্গে নদীর অববাহিকায় পড়ে জলবহন ক্ষমতা প্রতি বছরই কমে চলেছে। বয়ে যাওয়া বাড়লে মাটির নীচে জলধারণ ক্ষমতা কমবে। ফলে শুখা মরশুমে আগে মাটির নীচের জলাধার চুঁইয়ে যেমন নদীতে জলপ্রবাহ বয়ে যেত, বনভূমি কমে যাওয়ায় সেটা বর্তমানে একেবারেই হতে পারে না। বন্যা রোধে যে ড্যাম বা জলাধার তৈরি হয়, তার ক্ষমতা কমে যাওয়ায় বর্ষার প্রথম দিকে একটু বৃষ্টি হলেই জল ছাড়তে হয়। এই মানুষ-সৃষ্ট বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়। তাই বলা হয়, বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটা কৃত্রিম ড্যাম-এর থেকে ভাল কাজ করে একটা বড় বনভূমি।
প্রকৃতির স্বচ্ছন্দ গতিকে স্তব্ধ করার পরিণামে আধুনিক মানুষের ওপর নেমে এসেছে খাঁড়া, যা থেকে মুক্ত হতে গেলে যেটুকু প্রকৃতির আঘাত সহ্য করতে পারব, সেটুকু করে বনবাসী-সহ সমস্ত মানবজাতির বেঁচে থাকার শর্ত স্বরূপ প্রকৃতিকে ব্যবহার করার দিকেই এগোতে হবে, নইলে এ রকম ‘ম্যানমেড’ কৃতকর্মের ফল ভোগ করবে এমন এক দল মানুষ যারা জানতেই পারবে না কিসের জন্য তাদের এই দুর্গতি। ঠিক এখানেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রকল্প নিয়ে সব রকম পরিস্থিতির আলোচনা প্রয়োজন।
তাপস মুখোপাধ্যায়
কলকাতা-৫৪
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।
ই-মেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়