এ ভাবেই যেতে হবে
চন্দননগর থেকে এক ঘণ্টা ট্রেন চেপে হাওড়া স্টেশনে যখন পৌঁছলাম, তখন দরদর করে ঘামছি। রুমাল দিয়ে গলা, ঘাড়, হাত, মুখ মুছতে মুছতে দৌড়চ্ছি বাস ধরব বলে। যাব সেই বাইপাস চিংড়িঘাটা। প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ। এস–১২-এর স্ট্যান্ডে পৌঁছে দেখি লম্বা লাইন। বসার জায়গা পাওয়া যাবে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এতটা পথ... ভাবতে ভাবতেই পিছনে একটা এসি-১২ এসে দাঁড়াল। চকচকে নীল রঙের বাস। বাসের গায়ে ইংরেজিতে জেএনএনইউআরএম (জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল আরবান রেনেউআল মিশন) লেখা। দৌড়ে উঠে পড়লাম। এই বাসে উঠতে লাইন দিতে হয় না. ফাঁকা বাস।
বেশি ফাঁকা থাকলে আবার কোথায় বসব, বুঝে উঠতে সময় লাগে। তাই এ দিক-ও দিক দেখে মনে হল ওই সিটটাই সবচেয়ে ভাল। বসে পড়লাম চেপে। শান্তি! কিছু ক্ষণের মধ্যেই বাস মোটামুটি ভরে গেল। চলতেও লাগল। কিন্তু কিছু ক্ষণ পরেই দেখি কপালে ঘাম দিচ্ছে! কী রকম একটা অস্বস্তি হচ্ছে! এসি কি চলছে না? মাথার উপরেই দেখি দুটো এসি-র আউটলেট। কিন্তু তার নীচেই একটা ফ্যান জোরে ঘুরছে! ঠান্ডা ব্যাপারটা একদমই চলে গেছে। ছোট্ট বলের মতো আউটলেট দুটোর নীচে হাত দিয়ে দেখলাম নামমাত্র হাওয়া বেরোচ্ছে এবং তার নীচেই ফিট করা ঘূর্ণায়মান ফ্যানের দাপটে তা আর নীচ অবধি পৌঁছচ্ছে না! কন্ডাকটরকে বললাম, দাদা ফ্যানের কী দরকার? ফ্যানটা বন্ধ করে দিন, গরম লাগছে রীতিমত! প্রথম দু’বার শুনতেই পেলেন না! তিন বারের বার বলায় উত্তর দিলেন, ফ্যান না চালালে যাঁরা দাঁড়িয়ে থাকবেন তাঁদের নাকি গরম লাগবে! এ আবার কী কথা! এসি বাসে গরম লাগবে কেন? ফ্যান চালাতে হবে কেন? তিন গুণ ভাড়া দিয়ে তো যাচ্ছি! ড্রাইভারের সিট থেকে এ বার উত্তর এল— এ ভাবেই যেতে হবে! এ দিক-ও দিক তাকালাম আর কারও আমার মতো অসুবিধা হচ্ছে কি না, দেখার জন্যে। দেখলাম দু’এক জন ওই এসি আউটলেট-এর নীচে হাত দিয়ে ওটাকে এ দিক-ও দিক ঘুরিয়ে কী যেন একটা চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোনও ফল হল না! বুঝলাম, গণতান্ত্রিক দেশে এ ভাবেই যেতে হবে।
সাহেব
কলকাতা
বাঙালি রোহিঙ্গা
রোহিঙ্গারা মায়ানমারের রাখাইন (অতীতে আরাকান) প্রদেশের মানুষ। সুপ্রাচীন কালে বাংলার পূর্বাংশ থেকে আগত লাখ লাখ মানুষ এখানে এসে পুরুষানুক্রমে স্থায়ী ভাবে বসবাস করেছে। সেখানে গড়ে তুলেছে সভ্যতা ও সংস্কৃতি। কিন্তু মায়ানমারের রাষ্ট্রশক্তির পুনর্বিন্যাসের ফলে রোহিঙ্গাদের স্বদেশ আরাকান মায়ানমারের অংশ হয়ে গেল। রোহিঙ্গারা স্বদেশে পরদেশি হয়ে গেল।
ষোড়শ শতাব্দী থেকেই আরাকান প্রদেশে বাঙালি মুসলমানেরা বাস করত। ১৬৬৬ সালেও আরাকান বাংলার চিটাগঙ্গের অংশ ছিল। ১৭৮৫’তে বর্মিরা যুদ্ধে আরাকান দখল করলে ৩৫০০০ আরাকানবাসী চিটাগঙ্গে আশ্রয় নেয়। ১৮২৬ সালে প্রথম অ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধের পরে আরাকান প্রদেশকে ব্রিটিশরা ভারতের সঙ্গে যুক্ত করে নেয়। ব্রিটিশদের উৎসাহে এবং প্রলোভনে বাংলার বহু মানুষ সেখানে গিয়ে খামার-শ্রমিক হিসাবে কাজ শুরু করে। কৃষিকাজে দক্ষতা আর কর্মকুশলতার ফলে আরাকান প্রদেশে বাঙালি রোহিঙ্গাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছিল। কোনও নির্দিষ্ট সীমানা না থাকায় চিটাগঙ্গের বাঙালি হাজারে হাজারে আরাকানে চলে যায়। ধান চাষে সস্তায় মজুর পাওয়ার তাগিদে আরাকান-সহ বর্মার আদি বাসিন্দারাও বাঙালিদের উৎসাহিত করত। ১৯২৭ সাল নাগাদ অনেক জায়গাতেই ভারতীয়রা ছিল সংখ্যাগুরু।
পাকিস্তান আন্দোলনের সময় (১৯৪০ সাল) পশ্চিম বর্মার রোহিঙ্গারা পূর্ব-পাকিস্তানভুক্তির জন্য পৃথগীকরণের আন্দোলন শুরু করে। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে বর্মার স্বাধীনতার পরেও তাদের সে প্রয়াস অব্যাহত ছিল। কিন্তু মহম্মদ আলি জিন্না বর্মার লোকেদের বিরুদ্ধে কোনও কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে না বলে ঘোষণা করলে রোহিঙ্গারা বিদ্রোহী হয়ে উঠল। বর্মার মিলিটারি তাদের দমন করার জন্য সক্রিয় হল।
১৯৪৮ সালে বর্মা স্বাধীন হওয়ার সময়ে আরাকান সে দেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। বাঙালি রোহিঙ্গারা পূর্ব বাংলার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য আন্দোলন করেছিল, সেই থেকে বর্মিরা রোহিঙ্গা-বিরোধী। ১৯৭৮ সালে বর্মিদের ‘কিং ড্রাগন অপারেশন ইন আরাকান’-এর অত্যাচারে রোহিঙ্গারা ঘরবাড়ি ছেড়ে হাজারে হাজারে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে চলে এল। ১৯৮২ সালে নাগরিক আইন কার্যকর করে সে দেশের সরকার। সেখানে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়। ৭,৩৫,০০০ রোহিঙ্গা বর্মায় বাস করত। এরা মূলত রাখাইন প্রদেশের শহরকে কেন্দ্র করে থাকত। ব্রহ্মদেশের পুলিশ বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করতে লাগল।
১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাদের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে ঘোষণা করে যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক নয়। সঙ্গে সঙ্গে বর্মা সরকারও তাদের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে ঘোষণা করে যে বাঙালিরা সবাই বিদেশি। ১৯৮৩ সাল থেকে বর্মা সরকার সীমানা সুরক্ষিত করে নেয়। ১৯৯০ সাল থেকে শুরু হয় রোহিঙ্গাদের টিকে থাকার আন্দোলন। তারা রোহিঙ্গা জাতীয়তাবাদের পতাকা তুলে ধরল। তাদের বক্তব্য: ‘আরাকান আমাদের, হাজার বছর ধরে আরাকান ভারতভূমি ছিল।’
আজ নব প্রজন্মের অনেক বাঙালিই মনে করেন রোহিঙ্গারা বাঙালি নয়। তারা রোহিঙ্গা ভাষায় কথা বলে। রোহিঙ্গা ভাষার সঙ্গে আধুনিক প্রামাণ্য বাংলার কোনও মিল নেই। এখনও সিলেট নোয়াখালি চিটাগঙ্গ-এর গ্রামীণ মানুষদের ভাষা একটু লক্ষ করলেই বোঝা যায় বাংলা ভাষা কত বৈচিত্রময়ী।
আরাকানবাসী বাঙালি মুসলমান মানুষরা আজ গৃহহীন দেশহীন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একবিংশ শতকের এই পৃথিবীতে রোহিঙ্গাদের বেঁচে থাকার অধিকার আছে। সেই অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ভারত, বাংলাদেশ ও মায়ানমারকে একসঙ্গে সক্রিয় হতে হবে।
কৃষ্ণ দাস
উত্তরলালপুর, চাকদহ, নদিয়া
শরণার্থী
সংখ্যালঘুর কোনও জাত নেই, রাষ্ট্র নেই, ধর্ম নেই! এক কথায় নেই রাজ্যের বাসিন্দা। সে নির্যাতিত, নির্যাতনই তার জীবনের একমাত্র পাওয়া। আমরা এমন এক সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে মানুষ গৌণ, রাষ্ট্র সমস্ত কিছুর নিয়ামক। ওরা বিশ্বাস করে, নির্যাতিত মানুষগুলোকে মারা যায়, পোড়ানো যায়! ’৪৭-এর দেশভাগের পর রাতারাতি নিজভূমে পরবাসী মানুষের যে ঢল নেমেছিল অন্য দেশে আশ্রয় নেওয়ার, তা আজও অব্যাহত। সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন সত্যিই অলীক বলে ঠেকে আজকাল!
ইতিহাসে আরাকান রাজসভা কিন্তু অসাম্প্রদায়িকতার ছবিই তুলে ধরে! দৌলত কাজি, শ্রীচন্দ্র সুধর্মা, আলাওল, মাগন ঠাকুর— মিথ্যা হয়ে যাবে? রোহিঙ্গাদের এই সংকটে উপমহাদেশের বৃহৎ শক্তি হিসাবে ভারত সরকারের দায়িত্ব অনেক বেশি। কিন্তু এটা ভেবে কষ্ট হচ্ছে যে, ভারতে আশ্রিত চল্লিশ হাজার রোহিঙ্গাকে নাকি জোর করে ফেরত পাঠানো হবে! জেনেবুঝে ওদের যদি আমরা আগুনের মুখে ঠেলে দিই, তা হলে ‘অতিথি দেবতা’-র আদর্শ থেকে বিচ্যুত হব না?
ভাস্কর দেবনাথ
নবপল্লি, বহরমপুর
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।
ই-মেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়
ভ্রম সংশোধন ‘বন্ধ হওয়া অ্যাকাউন্টে জমা পড়ল ৮০ কোটি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে (৯-৯, কলকাতা) ভুলবশত অভিযোগকারীর নাম মহিম হালদার লেখা হয়েছে। অভিযোগকারীর নাম মহিন সমাদ্দার হবে। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।