বিজেপির বন্ধু?
ভারতের মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা প্রকাশ কারাট তাঁর দলের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্ৰহণে যে ভূমিকা পালন করেন, তা একটু বিশ্লেষণ করলে তাঁকে ভারতীয় জনতা পার্টির এক জন বিশিষ্ট শুভাকাঙ্ক্ষী বলে মনে হয়। তাঁর নেতৃত্বে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিপিআইএম, আর সুবিধা পেয়েছে বিজেপি। ধর্মনিরপেক্ষ দলের নেতা হয়েও সাম্প্রদায়িকতার বিপদকে তিনি কোনও দিন বড় করে দেখেননি। তাই তাঁর দৃষ্টিতে কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নেই, যেহেতু উভয় দলের অর্থনৈতিক এজেন্ডা প্রায় একই।
তাঁর বিভিন্ন সিদ্ধান্তে সিপিআইএম কী ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত আর বিজেপি উপকৃত হয়েছে, সেই বিষয়টি কয়েকটি ঘটনার সাহায্যে স্পষ্ট করা যেতে পারে। ভারতীয় জনতা পার্টি ১৯৮৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে যথেষ্ট ভাল ফল করে। পাঁচ বছরের ব্যবধানে বিজেপির সাংসদ সংখ্যার চমকপ্রদ বৃদ্ধিতে জাতীয় রাজনীতিতে একটা গুণগত পরিবর্তন সূচিত হয়। বিষয়টি সিপিআইএমের তৎকালীন সাংসদ ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সইফুদ্দিন চৌধুরীকে নাড়া দেয়। তিনি তাঁর পার্টির কংগ্রেস ও বিজেপির থেকে সমদূরত্ব বজায় রাখার নীতি পরিবর্তনের দাবি তোলেন। বিজেপিকে আটকাতে প্রয়োজনে কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলানোর কথাও বলেন তিনি।
সইফুদ্দিনের এই বক্তব্য পার্টির প্রকাশ কারাটদের পছন্দ হয়নি। ভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপি তথা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানকে তাঁর মতো নেতারা খুব বেশি গুরুত্ব দিতে চাননি। সে জন্য সইফুদ্দিনের মনোভাব পার্টিতে কোনও মর্যাদা পায়নি। শুধু তাই নয়, প্রকাশ কারাটরা তাঁর বিরুদ্ধে কংগ্রেসের সঙ্গে ‘যোগসাজশ’-এর অভিযোগ আনেন এবং পার্টিতে তাঁকে কোণঠাসা করে দেওয়া হয়। সাংসদ হিসেবে সুনাম অর্জন করলেও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তাঁকে আর মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় কমিটি থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেই পার্টির প্রাথমিক সদস্যপদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। সইফুদ্দিন-বিদায়ের মধ্য দিয়ে পার্টি এক দক্ষ সাংসদ, সুবক্তা ও উজ্জ্বল ভাবমূর্তির নেতাকে হারায়।
১৯৯৬ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি দেশের একক বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। হিন্দুত্ববাদী বিজেপির উত্থানকে প্রতিহত করার জন্য কংগ্রেস-সহ অন্য অসাম্প্রদায়িক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন বোধ করে। বিজেপি-বিরোধী জোটের সরকারে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে মনোনীত করা হয়। প্রস্তাবটিকে সিপিআইএমের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ সমর্থন করেন। জ্যোতিবাবুও ওই দায়িত্ব গ্ৰহণে সম্মত ছিলেন। কিন্তু প্রকাশ কারাট এবং তাঁর সহমর্মীরা বেঁকে বসেন। বিজেপিকে আটকানোর চেয়ে কংগ্রেস-সঙ্গ এড়িয়ে চলাকে তাঁরা বেশি জরুরি মনে করেন। দলের কেন্দ্রীয় কমিটি জ্যোতিবাবুর প্রধানমন্ত্রী হওয়া আটকে দেয়। তাঁর নেতৃত্বে কেন্দ্রে সরকার গঠনের সুযোগ নষ্টের ফলে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সিপিআইএমের বিস্তারের সুবর্ণসুযোগ হাতছাড়া হয়। জাতীয় স্তরে বিজেপি-বিরোধী একটা শক্তিশালী জোট তৈরির সম্ভাবনার বিনাশ ঘটে। বিজেপির বিরুদ্ধে আর কোনও ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত জোট গড়ে তোলা যায়নি এবং তার অগ্ৰগমন রোধ করাও সম্ভব হয়নি। আজ দেশের সর্বত্র বিজেপি ছড়িয়ে পড়েছে আর সিপিআইএম অধিকাংশ জায়গা থেকে উঠে গেছে।
২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পূর্বে পরমাণু চুক্তি প্রশ্নে সিপিআইএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট ইউপিএ সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন। গরিব মানুষ ও শ্রমিক শ্রেণির শিক্ষা-স্বাস্থ্য-খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের সঙ্গে সম্পর্কহীন একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে তিনি সরকারকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁর বিরোধিতা করায় লোকসভার অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে পার্টি থেকে বহিষ্কার করে দেওয়া হয়। তখন কেন্দ্রে বিরোধী দল বিজেপি। অর্থাৎ, সমর্থন প্রত্যাহারের জন্য সরকারের পতন হলে বিজেপির সুবিধা লাভের সম্ভাবনা মাথায় রেখেই তিনি দলকে সমর্থন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করেন, যা পশ্চিমবঙ্গে সিপিআইএমের পতনের প্রধান কারণ হয়ে ওঠে।
তা ছাড়া, সোমনাথ-বিদায়ের মধ্য দিয়ে বামপন্থীরা এক জন দক্ষ সাংসদ, বাগ্মী ও উজ্জ্বল ভাবমূর্তির নেতাকে হারায়।
রাজ্যসভার সাম্প্রতিক নির্বাচনে সীতারাম ইয়েচুরির পুনর্নির্বাচন আটকে দিয়ে প্রকাশ কারাট আর এক বার সিপিআইএমের বিরাট ক্ষতি করলেন ও বিজেপির লাভ হল। পশ্চিমবঙ্গ থেকে সংসদে সিপিআইএমের প্রতিনিধির সংখ্যা ১৯৭৭ সালের পর থেকে এই মুহূর্তে সবচেয়ে কম। রাজ্য বিধানসভাতেও বামফ্রন্টের বিধায়ক সংখ্যা এত কম যে কংগ্রেসের সমর্থন ছাড়া তাদের কোনও প্রার্থীর রাজ্যসভায় নির্বাচিত হওয়া সম্ভব ছিল না। জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপির মোকাবিলা করার জন্য কংগ্রেস দলীয় স্তরে ত্যাগ স্বীকার করে সীতারাম ইয়েচুরিকে সমর্থন করার প্রস্তাব দেয়। বিজেপি-বিরোধী অন্য দলের শীর্ষ নেতারাও সীতারাম ইয়েচুরির প্রতি নৈতিক সমর্থন জানান। সকলেই উপলব্ধি করেন যে এই মুহূর্তে সংসদে মোদী সরকারের বিরোধিতা করার জন্য ইয়েচুরিকে দরকার। কিন্তু সিপিআইএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি দলের ‘অসাধারণ’ সদস্য প্রকাশ কারাটের সমর্থন লাভে সমর্থ হলেন না। তিনি প্রার্থী হতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের প্রার্থী সাংসদ নির্বাচিত হলেন।
এর ফলে সংসদে সিপিআইএম আরও শক্তিহীন হল এবং দক্ষ সাংসদ ইয়েচুরির অনুপস্থিতিতে রাজ্যসভায় সরকার-বিরোধিতার ঝাঁঝটাও কমে গেল। মোদী-শাহ নিশ্চয়ই কারাটের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবেন!
সিপিআইএম-কে সাইনবোর্ডে পরিণত করার ক্ষেত্রে প্রকাশ কারাটের ভূমিকা কখনও ভুলবার নয়। এ ব্যাপারে রাজ্যের বাম-বিরোধী দলের নেতানেত্রীর চেয়ে তাঁর ‘কৃতিত্ব’ কোনও অংশে কম নয়। ওই নেতানেত্রীরা সিপিএমকে ‘শেষ’ করার জন্য বাংলার গ্ৰামে-শহরে অনেক লড়াই করেছেন। কিন্তু কারাটসাহেব দিল্লিতে বসে আর আলিমুদ্দিনে এসেই সে কাজ করে দিয়েছেন। বিজেপির পক্ষেও তাঁর মতো এত উপকারী প্রতিপক্ষ পাওয়া মুশকিল। মোদীর তিন বছরের ভয়ংকর শাসনকাল দেখার পরও গেরুয়া শিবিরের কর্মকাণ্ডকে ফ্যাসিবাদ বলা যায় কি না, সেই তাত্ত্বিক আলোচনায় তিনি ব্যস্ত আছেন। সংঘ পরিবার ও বিজেপি নিশ্চয়ই তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রশংসায় পঞ্চমুখ!
মজিবুর রহমান কাবিলপুর, সাগরদীঘি, মুর্শিদাবাদ
দীপাবলির ফানুস
শুরু হয়ে গিয়েছে আলোর উৎসব দীপাবলি। অবাঙালিদের কাছে যা দিওয়ালি— অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার উৎসব। সেই কোন ছোটবেলায় পুকুর থেকে এঁটেল মাটি তুলে এনে মায়ের সঙ্গে হাতে হাতে প্রদীপ বানিয়ে, রোদে শুকিয়ে,
তেল কেনার পয়সার অভাবে পাশের গ্যারাজ থেকে পোড়া মোবিল এনে দীপাবলির দিন সন্ধেবেলা বাড়ির চতুর্দিকে আলোকোজ্জ্বল করা হত। বাড়ির প্রবেশ পথে, তুলসীতলায়, কুয়োতলায়, এমনকী বংশের কুল-মান রক্ষার জন্য মা কুলগাছতলা ও মান গাছতলাতেও মাটির প্রদীপ জ্বালাতেন।
তখনও বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি আসেনি। দীপাবলির সন্ধেবেলা চতুর্দিকে প্রদীপের আলোয় এক মোহময় পরিবেশের সৃষ্টি হত, যা আজও খুব মিস করি। পরবর্তীতে প্রদীপে এল সরষের তেল, তার পর এল মোমবাতি, অবশেষে টুনি বাল্ব। কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে, প্রায় প্রতিটা বাড়ি থেকেই অতি সাধারণ মানের ফানুস ছাড়া হচ্ছে, যা সামান্য কিছুটা ওপরে উঠে বাতাসের বেগে এলোমেলো ছুটে জ্বলন্ত অবস্থায় যেখানে-সেখানে পড়ছে। এই ফানুস থেকে যে কোনও মুহূর্তে বড় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা। প্রশাসনের এই ব্যাপারে কি কিছুই করণীয় নেই?
নিরঞ্জন পাল টাইপ কর্নার, কৃষ্ণনগর, নদিয়া
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।
ই-মেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়