সম্পাদক সমীপেষু

দু’পাশে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, লক্ষ্মী-সরস্বতী। উমার কোলে বাল-গণেশ আর নীচে ছোট্ট কার্তিক আর দু’পাশে দেবীর দুই সখী জয়া ও বিজয়া। এই চিত্রপটের বর্ণনায় যে সারাংশ পুরাণে পাওয়া যায়, তা হল, দেবী দুর্গা পিত্রালয়ে কয়েক দিন কাটিয়ে কৈলাসে ফিরে এসেছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৭ ০০:৪৯
Share:

কৈলাস পুজোয় উমা

Advertisement

দুর্গাপুজোয় যে দেবীকে আমরা দেখি, তিনি অসুরদলনী দশভুজা। কিন্তু কৈলাস পুজোর যে চিত্রপট, তাতে আমরা দেবীকে পাই দ্বিভুজা উমারূপে। সঙ্গে কৈলাসপতি মহাদেব। দু’পাশে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, লক্ষ্মী-সরস্বতী। উমার কোলে বাল-গণেশ আর নীচে ছোট্ট কার্তিক আর দু’পাশে দেবীর দুই সখী জয়া ও বিজয়া। এই চিত্রপটের বর্ণনায় যে সারাংশ পুরাণে পাওয়া যায়, তা হল, দেবী দুর্গা পিত্রালয়ে কয়েক দিন কাটিয়ে কৈলাসে ফিরে এসেছেন। মহাদেব তাঁর কাছ থেকে তাঁর পিত্রালয়ের সকলের কুশল সংবাদ জেনে নিচ্ছেন। দুর্গাপুজোর পরবর্তী সময়ে উমা রূপেই কার্তিক মাসের সংক্রান্তির দিন কৈলাস পুজো হয়ে থাকে। মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে জাঁকজমকসহ প্রতি বছর চার দিন ব্যাপী কৈলাস পুজো বহু বছর ধরে সংঘটিত হয়ে চলেছে। কৃষ্ণনগর, চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর মতো প্রচার না পেলেও, বহরমপুরবাসীর কাছে এর গুরুত্ব অপরিসীম। মূর্তির এই বিশেষরূপ (সঙ্গের ছবি) রাজ্যের আর কোথাও পাওয়া যায় বলে জানা নেই। এর প্রচার ও প্রসার জরুরি।

শুভায়ু সাহা

Advertisement

ইন্দ্রপুরী, এ সি রোড, খাগড়া

উৎসধারা পার্ক

ব্যারাকপুর শহরে গঙ্গার ধারে সাড়ে তিন কিলোমিটার জুড়ে ‘উৎসধারা’ নামে একটি নতুন পার্ক তৈরির সরকারি উদ্যোগের খবর জানা গেল (‘ইকো পার্কের ধাঁচেই...’, ২৪-১০)। ১৮০০ সালে ‘লাটসাহেব’ লর্ড ওয়েলেসলি ‘ব্যারাকপুর পার্ক’-এর পত্তন করেন। ১০০৮ বিঘা জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই ‘লাটসাহেবের বাগান’ ক্রমে লোকমুখে বিবর্তিত হয়ে এখন ‘লাটবাগান’ নামে পরিচিত।

খবরে পড়লাম, এক সরকারি কর্তা জানিয়েছেন, ‘ওখানকার ধোবি ঘাটেই সিপাহি বিদ্রোহের অন্যতম নেতা মঙ্গল পাণ্ডের ফাঁসি হয়েছিল।’ এই ভয়ংকর ভুল উক্তি থেকে বোঝা গেল, যে অফিসাররা ইতিহাসের সঙ্গে সংগতি রেখে ব্যারাকপুরের সৌন্দর্যায়ন ও পার্ক তৈরির দায়িত্ব পেয়েছেন, তাঁরা নিজেরাই ব্যারাকপুরের ইতিহাস এবং এখানে ঘটে যাওয়া দুটি সিপাহি বিদ্রোহের ইতিহাস সম্বন্ধে উদাসীন। মঙ্গল পাণ্ডের ফাঁসি হয়েছিল ‘নেটিভ সিপয় লাইন্স’-এর কাছে, একটি বড় জলাশয়ের পাশে, সর্বসমক্ষে। ১৮৪১ এবং ১৮৬৬ সালের পুরনো ম্যাপ দেখলে বোঝা যায় যে স্থানটি এখন ব্যারাকপুর এয়ার ফোর্স স্টেশনের চৌহদ্দির ভিতরে।

ব্যারাকপুরে গঙ্গার তীরে ধরে কলকাতার দিকে এগোলে নিম্নলিখিত ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্যগুলি পর পর দেখা যাবে, ‘উৎসধারা’ পার্কের মধ্যে এগুলি অবশ্যই থাকা উচিত। ১) গোলা ঘাট— ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্টের প্রাচীনতম এবং একমাত্র মিলিটারি ঘাট। এখানে আছে ইটের তৈরি চওড়া সমতল বিশাল ঢালু পথ, যার ওপর দিয়ে ভারী কামান, গোলা-বারুদের বাক্স টেনে পাড়ে ওঠানো হত, সৈন্যরা ওঠানামা করত। ২) গাঁধী সংগ্রহশালা। ৩) ধোবি ঘাট— এখানে এখনও ধোবিরা (ধোপারা) কাপড় কাচে, শ্রীরামপুরে যাওয়ার ফেরি চলে। ৪) মঙ্গল পাণ্ডে পার্ক। এখানে আছে এন পি গ্রান্ট মেমোরিয়াল। ৫) ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউসের বাগান— এখানে উঁচু মাস্তুলে উড়ত ইউনিয়ন জ্যাক (নিশান), তাই পাশের স্নানের ঘাটের নাম নিশান ঘাট। ৬) দৃষ্টি সংকেতে খবর পাঠানোর জন্য সিমাফোর টাওয়ার। ৭) কলকাতা থেকে স্থানান্তরিত ব্রিটিশ রাজপুরুষদের ১২টি ব্রোঞ্জ মূর্তি। ৮) সেনোটাফ, হল অব ফেম— ১৮১৩ সালে তৈরি, যুদ্ধে নিহত ইংরেজ সৈন্যদের স্মরণে গ্রিক মন্দিরের হুবহু আদলে তৈরি এক অনবদ্য দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য। ৯) ব্যারাকপুর গভর্নমেন্ট হাউস— এখন পুলিশ হাসপাতাল। এই বাড়ি ছিল ইংরেজ গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয়দের কান্ট্রি হাউস। ক্যালকাটা গভর্নমেন্ট হাউসের ঠিক পরেই, প্রশাসনিক গুরুত্বে, এই প্রাসাদ ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের দ্বিতীয় কেন্দ্রবিন্দু। ব্যারাকপুরে ঘটে যাওয়া ১৮২৪ সালের এবং ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়ি। এই প্রাসাদে ‘সিপাহি বিদ্রোহ স্মৃতি সংগ্রহশালা’ গড়ে তোলা যেতে পারে। ১০) প্রাচীন বট গাছ— ১৮৫৬ সালে লেডি ক্যানিং এই গাছটিকে জঙ্গল কাটিয়ে নিজের প্রাসাদের চৌহদ্দির মধ্যে নিয়ে এসে যত্নে রাখেন। কিছু অজ্ঞ মানুষ এর নীচে মঙ্গল পাণ্ডের ফাঁসিতে ঝোলানোর মূর্তি বসিয়েছেন। ১২) ব্যাম্বু টানেল— ব্যারাকপুর গভর্নমেন্ট হাউস থেকে নদীর কিনারায় নৌকার ঘাট পর্যন্ত ছিল ১৮০০ ফুট দীর্ঘ এক ছায়া-ঘেরা সুড়ঙ্গ-সম পথ, নুয়ে পড়া বাঁশগাছে ঢাকা, সে যুগের বিস্ময়। ১৩) লেডি শার্লট ক্যানিংয়ের সমাধি ও লর্ড ক্যানিংয়ের ঘোড়ায় চড়া মূর্তি। ১৪) মিন্টো ফাউন্টেন— ছাই রঙা পাথরে তৈরি ২৬ হাজার গ্যালন জলাধারসহ এক বিশাল ডানামেলা ফোয়ারা। ১৫) এক খিলান ব্রিজ (ওয়েস্ট গেট)— মুক্তোর আকারের মতিঝিলের ওপর ১৮০৩ সালে লর্ড ওয়েলেসলির তৈরি অনবদ্য ব্রিজটি সারা ভারতে আর একটিও নেই। ১৬) চিড়িয়াখানা— অনবদ্য গথিক স্থাপত্যে গড়া পাখির খাঁচা রাখার গ্যালারি ও ফোয়ারা, এখন সম্পূর্ণ জঙ্গলে ঢাকা। লন্ডন চিড়িয়াখানা স্থাপনেরও আগে ১৮০৩ সালে ব্যারাকপুরে শুরু হয়েছিল এশিয়ার প্রথম চিড়িয়াখানা এবং পশুপাখি সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সংগ্রহের জন্য ন্যাচারাল হিস্ট্রি প্রজেক্ট। সারা পৃথিবীর ন্যাচারাল হিস্ট্রির ইতিহাস আলোচনায় আজও ব্যারাকপুর চিড়িয়াখানার নাম উল্লেখ করা হয়। অথচ আমরাই তার কথা ভুলে গেছি। ১৭) প্লান্ট অ্যান্ড সিড হাউস— ১৮২৪ সালের সিপাহি বিদ্রোহের সময়, এখন জঙ্গলে ঢাকা এই বাড়িটিতে রাত্রিবাস করেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনা সর্বাধিনায়ক এডওয়ার্ড প্যাজট। তিনি এখান থেকেই ২ নভেম্বর ভোরবেলা প্যারেড গ্রাউন্ডে দাঁড়ানো বিদ্রোহী, কিন্তু শান্ত সিপাহিদের ওপর লুকিয়ে রাখা কামান থেকে গোলা বর্ষণের আদেশ দিয়েছিলেন। ১৮) জওহর রোজ গার্ডেন। ১৯) লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো প্রাঙ্গণ। ২০) মালঞ্চ টুরিস্ট লজ। ২১) গাঁধীঘাট। ২২) ব্যারাকপুর পার্কের মূল প্রবেশদ্বার— চার্লস ডয়লির আঁকা বিখ্যাত পেন্টিং-এ দুই পাশে সুন্দর ভল্টেড সেন্ট্রি বক্স সজ্জিত প্রবেশ পথটি দেখা যায়। কলকাতা রাজভবনের সেন্ট্রি বক্স দুটি এরই নকল। ২৩) নীলকর সি বি স্টুয়ার্ট সাহেবের বাংলো— এখন দমকলের কেন্দ্র। অতি ব্যতিক্রমী ইংরেজি ‘টি’ ডিজাইনের এই দোতলা বাড়িটি নদীর ধারে। ২৪) অন্নপূর্ণা মন্দির। রানি রাসমণির কনিষ্ঠ কন্যা জগদম্বাদেবী ২২ এপ্রিল ১৮২৫ সালে এই মন্দির স্থাপন করেন। ২৫) একটি জগদ্ধাত্রী মন্দির এবং ছ’টি শিব মন্দির।

ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্যগুলি সম্বন্ধে না জেনে ‘উৎসধারা’ পার্ক তৈরির কাজে নামলে, সরকারের বহু টাকা খরচ হবে বটে, কিন্তু তা হয়ে থাকবে ইতিহাস ও স্থানীয় মানুষের আবেগের সঙ্গে সম্পর্কহীন এক নিষ্প্রাণ সৃষ্টি।

অমিতাভ কারকুন

কলকাতা-৩২

লজ্জার দশ!

দেখতে দেখতে তসলিমা নাসরিন বহিষ্কার কাণ্ডের দশ বছর পূর্ণ হয়ে গেল। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, বুদ্ধিজীবী থেকে আরম্ভ করে মিডিয়া, সাধারণ বাঙালি, সবাই দিব্যি গুন্ডামি-মস্তানির কাছে নিঃশর্ত পরাজয় স্বীকার করে চলচ্চিত্র উৎসব, বইমেলা, আইপিএল, আইএসএল, বলিউড নিয়ে মশগুল। বহিরাগত দুর্বৃত্তদের রক্তচক্ষুতে বঙ্গভূমি থেকে বঙ্গকন্যার বহিষ্কার বাঙালির জাত্যভিমানকে ন্যূনতম আঘাত করে না। আসলে জাত্যভিমানই যেখানে নিশ্চিহ্ন, সেখানে তা আঘাতপ্রাপ্ত হবেই বা কী রূপে!

দুই বঙ্গের কাছেই ‘একুশ’ তারিখটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ও-পার বাংলা যখন উর্দু সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বভূমে মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার মাধ্যমে একুশ ফেব্রুয়ারিকে করেছে মহিমান্বিত, তখন এ-পার বাংলা মৌলবাদীদের কাছে নতজানু হয়ে স্বজাতির কন্যাকে স্বভূমি থেকে বহিষ্কার করে দিনটিকে করেছে কলঙ্কিত। এখানে বর্বর পেশিশক্তি ও হিংসা দ্বারা মানবাধিকার, গণতন্ত্র, বাক্‌স্বাধীনতা, আইন, সভ্য বিতর্ক ও আলোচনার আলোককে নিষ্ঠুর হত্যার সামাজিক স্বীকৃতি প্রদানের অন্য নামই হল একুশ নভেম্বর।

কাজল চট্টোপাধ্যায়

সোদপুর

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন