সম্পাদক সমীপেষু

আমার পনেরো বছরের মোবাইল টেলিফোনটিও বন্ধ হয়ে যেতে পারে, কারণ আমারও আঙুলের ছাপ মেলেনি। পেনশনারদের লাইফ সার্টিফিকেটও নাকি এ বার থেকে এ ভাবেই হবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:৪৫
Share:

আধার না আঁধার

Advertisement

আজকাল আধার কার্ড নিয়ে প্রচুর কথা হয় দেখতে পাই। আধার কার্ড বাধ্যতামূলক করা উচিত কি না, এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। আমাদের মুখ্যমন্ত্রীও এ বিষয়ে কিছু মূল্যবান বক্তব্য পেশ করেছেন। সত্যিই, এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজ্য সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার, মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট, এঁদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব মতামত থাকতে বাধ্য। কিন্তু আধার কার্ড করাতে তো হচ্ছে সকলকেই। সেখানে, বায়োমেট্রি না মিললে কী হবে, সেই অত্যন্ত জরুরি প্রশ্নটি নিয়ে এখনও কাউকে কিছুই বলতে শুনিনি। তাত্ত্বিক আলোচনার সঙ্গে, ব্যবহারিক খুঁটিনাটির ব্যাপারও তো ভাবতে হবে!

আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাই, যাঁদের বয়স ৬০-৭০ পেরিয়েছে তাঁদের অনেকেরই আঙুলের ছাপ মিলছে না। আমার নিজের ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, প্রায় ৫০ শতাংশ সিনিয়র সিটিজেনের এই সমস্যা হচ্ছে। ফলে এই সমস্ত মানুষ ব্যাংকে নতুন খাতা খুলতে পারছেন না। চালু খাতাগুলি রাখতেও অসুবিধা হতে পারে। তা হলে তাঁরা কী করবেন? ব্যাংকের পরিষেবা পাবেন না? তাঁরা আধুনিক জীবনের নিরিখে বাতিল হয়ে গেলেন?

Advertisement

আমার পনেরো বছরের মোবাইল টেলিফোনটিও বন্ধ হয়ে যেতে পারে, কারণ আমারও আঙুলের ছাপ মেলেনি। পেনশনারদের লাইফ সার্টিফিকেটও নাকি এ বার থেকে এ ভাবেই হবে। জানি না, সে ক্ষেত্রে, আমার মতো বহু হতভাগ্য পেনশনারের কপালে কী আছে!

কল্যাণ ভট্টাচার্য, বিধাননগর

স্তালিন পুজো!

শিবাজী ভাদুড়ী তাঁর চিঠিতে (‘স্তালিন ভাল’, ২২-১২) সলঝেনিৎসিন এবং পাস্তেরনাককে ধূলিসাৎ করতে চেয়েছেন স্তালিন-বন্দনার মাধ্যমে, এই অজুহাতে: কোনও নোবেলজয়ী লেখক কিছু লিখলেই তা সত্য হয়ে যায় না, সত্যে উপনীত হওয়ার জন্য প্রয়োজন ইতিহাসের নির্মোহ বিশ্লেষণ।

সলঝেনিৎসিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়ে সোভিয়েট সামরিক পদে ভূষিত হলেও, বিজয়গর্বে মত্ত লাল ফৌজের সাধারণ জার্মান নাগরিকদের সব কিছু লুটপাট ও জার্মান মেয়েদের ধর্ষণ করার ঘটনার কথা প্রকাশ করার ‘অপরাধে’ গ্রেফতার হন। যথারীতি বন্দিশিবিরে নির্বাসনের মধ্য দিয়ে তাঁর বিপদসংকুল জীবনের আরম্ভ। এই বন্দিশিবিরের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফসল তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘ওয়ান ডে ইন দ্য লাইফ অব ইভান দেনিসোভিচ’। রাজনৈতিক বন্দিশিবিরের এক মর্মস্পর্শী এবং জীবন্ত বিবরণ তাঁর মাধ্যমেই বিশ্ববাসী প্রথম জানতে পারলেন, এবং এ যাবৎ ঢক্কানিনাদে প্রচারিত মিথ্যার পরদা সরিয়ে, প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রূঢ় বাস্তবতা প্রকাশ্যে এল। হয়তো সে কারণে বলা যায়, সলঝেনিৎসিনকে বন্দিশিবিরে পাঠানো এক অর্থে শাপে বর! তার পর একে একে ‘ফার্স্ট সার্কল’, ‘ক্যানসার ওয়ার্ড’ এবং অবশেষে ‘গুলাগ আর্কিপেলাগো’। এ কথা অনস্বীকার্য, শুধু এক জন লেখক নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, এই অপরাধে (!) এক জন প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীর যন্ত্রণার এমন অনুপুঙ্খ বিবরণ বিশ্বাসযোগ্যতা হারায় না।

বিপ্লবোত্তর গত একশো বছরের সোভিয়েট ইতিহাস একরৈখিক নয়, অনেকাংশে আলোকোজ্জ্বলও নয়। এখানে জন্ম নিয়েছিল এক আগ্রাসী রাষ্ট্রব্যবস্থা, যার নখ-দাঁত বার বার নিপীড়িত করেছে মনুষ্যত্বকে, হরণ করেছে মানুষের মনের স্বাধীনতা, মনন ও মনীষার স্বাভাবিক বিকাশকে। অনেকের মতে, এক শৃঙ্খল মোচনের স্বপ্নে আরও এক সুকঠিন শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে যাওয়ার উপাখ্যান এটা।

‘ইতিহাসের নির্মোহ বিশ্লেষণ’ বরং বলে, মহামতি লেনিন যদিও স্তালিনকে খুব পছন্দ করতেন না, তবু উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্তালিন তাঁর পথের কাঁটা ট্রটস্কির বিরুদ্ধে অসুস্থ গৃহবন্দি লেনিনের কান ভারী করেছিলেন। স্তালিনের চক্রান্তে, লেনিনের পরেই থাকা এই মানুষটি (ট্রটস্কি) ‘বিশ্বাসঘাতক’ তকমা পেলেন, প্রথমে দল থেকে বহিষ্কৃত হলেন এবং তাঁকে নির্বাসনে পাঠানো হল, পরে ১৯২৯ সালে দেশ থেকেও বহিষ্কার করা হল। প্রাণ বাঁচাতে তিনি যখন বিভিন্ন দেশ ঘুরে মেক্সিকোতে, তখনও স্তালিনবাদের বিরোধিতা করায়, স্তালিনের নিযুক্ত স্পেনীয় গুপ্তচর নাকি তাঁকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে। যদিও লেনিনের সহযোদ্ধা এই ট্রটস্কির রুশ বিপ্লবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। একটি উদাহরণ দেওয়া যায়: সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রথম পলিটব্যুরোর সাত সদস্যের অন্যতম ও রেড আর্মির প্রধান তিনি, লেনিনের আগেই তৎকালীন পেত্রোগ্রাদ-এ (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ) প্রবেশ করে ‘উইন্টার প্যালেস’-এর দখল নেন।

স্তালিনের কুখ্যাত ‘পার্জ’— অসংখ্য ব্যক্তিকে শ্রমশিবিরে প্রেরণ করে শাস্তি এবং অবশেষে হত্যা, এই ছিল তাঁর প্রতিস্পর্ধী স্পৃহাকে দমনের অস্ত্র। এই একশো বছরের ঘটনাবলি প্রমাণ করে যে স্তালিনের ক্ষমতায় থাকা সুনিশ্চিত করতে দমনমূলক পন্থার অবলম্বনই সমাজতন্ত্রের গণতান্ত্রিক পরিসরকে গ্রাস করেছিল। সর্বহারার একনায়কত্ব পর্যবসিত হয়েছিল দলীয় কর্তাব্যক্তিদের একনায়কত্বে, ‘অল পাওয়ার টু দ্য সোভিয়েটস’ পর্যবসিত হয় ‘অল পাওয়ার টু পলিটব্যুরো’-তে, যে পলিটব্যুরোই নির্ধারণ করত: লেখক শিল্পীরা কী সৃষ্টি করবেন ও কী ভাবে।

কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থায় শিল্পী-সাহিত্যিক আর বুদ্ধিজীবীদের মুক্তচিন্তার কোনও সুযোগ নেই— এ কথা বার বার প্রমাণিত। এমনকী আমাদের দেশেও কমিউনিস্ট দল/মতাদর্শের কাছে বশ্যতা স্বীকারের জন্য শিল্পীদের উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। দলীয় লাইনে না হলে, যত মহৎ সৃষ্টিই হোক না কেন, তার স্বীকৃতি দিতে পার্টি পরাঙ্মুখ। বরং প্রয়োজনে কুৎসা রটানোর প্রয়াসও হয়েছে, হেয় করার জন্য। বাংলার প্রগতি সাহিত্য ও গণনাট্য আন্দোলনও এই কারণেই ক্রমশ কমিউনিস্ট পার্টির অক্ষম প্রচারযন্ত্রে পরিণত হয় ও স্বল্পায়ু হয়।

তাই যদিও সোভিয়েট রাশিয়ায় বহু বুদ্ধিজীবী মানবাধিকার ও শিল্পীর স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করেছেন দীর্ঘ দিন, যদিও বিদ্রোহী লেখক-বুদ্ধিজীবীদের দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড দিয়ে, শ্রমশিবিরে নির্বাসন দিয়ে, পাগল সাজিয়ে অত্যাচার করে তাঁদের মননশক্তিকে বিনষ্ট করে দেবার প্রয়াস ছিল সর্বদা, তবু এ দেশের বামপন্থী(!) পণ্ডিতেরা এ বিষয়ে বিস্ময়কর ভাবে নীরব।

শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয়, অন্য রাষ্ট্রের উপর দাদাগিরি করে সেগুলোকে নিজের তাঁবে রাখার চেষ্টাও করেছিলেন স্তালিন। তিনি যেন ভাবতেন, সোভিয়েট রাশিয়ার স্বার্থে অন্য দেশের মুক্তিকামী নিপীড়িত জনসাধারণের আকাঙ্ক্ষা বলি দেওয়া যেতেই পারে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি এর ভুক্তভোগী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভের আগেই স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েট রাশিয়া গায়ের জোরে দখল করে নেয় লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড। মলটভ-রিবেনট্রপ চুক্তির বলে হিটলারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে স্তালিনের সোভিয়েট রাশিয়া, যৌথ আক্রমণে ভাগাভাগি করে নেয় পোল্যান্ড। যে স্তালিন ১৯৪৫-এর ফেব্রুয়ারিতে ইয়াল্টা সম্মেলনে চার্চিল-রুজভেল্টের সঙ্গে দুনিয়াটা ভাগবাটোঁয়ারা করার চক্রান্তে লিপ্ত হলেন, তিনিও কত মহান, তা প্রতিপন্ন করার অতি-উৎসাহকে কী বলব? ব্যক্তিপূজা? স্তাবকতা?

আবার ‘সোশ্যালিজ্ম ইন ওয়ান কান্ট্রি’ স্লোগানের অজুহাতে ১৯৫৬-তে হাঙ্গেরিতে, ১৯৬৮-তে চেকোস্লোভাকিয়ায় হাজির হয় সোভিয়েট রাশিয়ার নেতৃত্বে লাল ফৌজ। এবং আশির দশকের প্রথমে পোল্যান্ডের প্রতিবাদী জনসাধারণের কণ্ঠ স্তব্ধ করার জন্য সামরিক আইন জারি করে দুর্নীতিপরায়ণ জারুলেস্কি সরকার, যাতে বড়দাদা রাশিয়ার লাল চক্ষুকে সন্তুষ্ট করা যায়।

সোভিয়েট রাষ্ট্রব্যবস্থার এমন চৌচির পতনের কারণ তার অন্তর্নিহিত মৌলিক দুর্বলতা কি না, সেই সমীক্ষা ও পুর্নবীক্ষণ প্রয়োজন এখন। আর তা করতে হবে খোলা মনে, বাস্তবতার নিরিখে, ইতিহাসের অভিজ্ঞতায়। নইলে ‘ইতিহাসের চাকা ঘুরবে’ বা ‘পৃথিবী বদলাবে, বদলাবেই’ জাতীয় আপ্তবাক্য হয়তো স্বপ্নভঙ্গের অন্তর্লীন হতাশা থেকে ক্ষণিক মুক্তির উজ্জীবকেই সীমাবদ্ধ থাকবে, আর শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।

শান্তনু রায়, কলকাতা-৪৭

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।

ই-মেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন