সম্পাদক সমীপেষু: অজিতকুমার ও রবিস্নেহ

স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে সদ্য স্নাতক হওয়া অজিতকুমার শান্তিনিকেতন আশ্রমে যোগ দিয়েছিলেন পরিবারের প্রতি আর্থিক দায়দায়িত্ব পালনের ব্যাপারটিকে গৌণ জ্ঞান করেই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:৩৫
Share:

রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য এবং বহুগুণে গুণান্বিত অজিতকুমার চক্রবর্তীকে এ যুগের পাঠকের সামনে তুলে ধরার অভিপ্রায়ে ‘কবির কাছের মানুষ, তবু স্বীকৃতিহীন’ (৩০-১২) রচনাটির জন্য দীপঙ্কর ভট্টাচার্যকে ধন্যবাদ জানাই। নিবন্ধটি পাঠ করে আশঙ্কা হয়, সাধারণ পাঠক রবীন্দ্রনাথ-অজিতকুমারের সম্পর্কের গভীরতার এমন করুণ পরিণতি লক্ষ করে এর জন্য রবীন্দ্রনাথকেই অনেকটা দায়ী করবেন। কিন্তু বাস্তবে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা কী ছিল, তুলে ধরা আবশ্যক।

Advertisement

স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে সদ্য স্নাতক হওয়া অজিতকুমার শান্তিনিকেতন আশ্রমে যোগ দিয়েছিলেন পরিবারের প্রতি আর্থিক দায়দায়িত্ব পালনের ব্যাপারটিকে গৌণ জ্ঞান করেই। শান্তিনিকেতন আশ্রমেই আশ্রমকন্যা লাবণ্যলেখার সঙ্গে অজিতকুমারের পরিচয়, প্রণয় এবং পরিশেষে বিবাহকে কেন্দ্র করে আশ্রমের আদর্শচ্যুতি সম্পর্কে যেমন আশ্রমের ভিতরে নানা প্রশ্ন উঠেছিল, বাইরের মহলেও শান্তিনিকেতন আশ্রমে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা নিয়েও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্ট হয়েছিল। বিষয়টি রবীন্দ্রনাথের গোচরে এলেও এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ অজিতকুমারের উপর রুষ্ট হননি।

রবীন্দ্রনাথ দু’জনের বিবাহ ব্যাপারে কতখানি উৎসাহী ছিলেন, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের বর্ণনায় বোঝা যাবে। তিনি লিখেছেন, ‘‘কবিরই কন্যা সম্প্রদানের কথা, রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছা ছিল শান্তিনিকেতনে অজিতকুমারের বিবাহ হয়।... তাঁহার আরো ইচ্ছা ছিল আদি ব্রাহ্মসমাজ অনুষ্ঠানপদ্ধতি অনুসারে এই বিবাহ হয়। কিন্তু বাধা দুইটিতেই পড়িল।’’ আশ্রমের অন্যতম ট্রাস্টি দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে অসবর্ণ বিবাহ অনুষ্ঠানে আপত্তি জানিয়েছিলেন। অন্য দিকে ব্রজেন্দ্রনাথ শীল ব্রাহ্মণ পিতা ও বিধবা বৈদ্য কন্যার অসবর্ণ বিবাহের সন্তান অজিতকুমারের বিবাহের ‘রেজিস্ট্রেশন’ বিষয়টির উপর গুরুত্ব আরোপ করে মন্তব্য করেন, ‘‘অজিতের বিবাহ আদি সমাজীয় মতে আইনসিদ্ধ না হইবার আশঙ্কা আছে।’’ সে জন্য শেষ পর্যন্ত ‘‘কবিকে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের রীতি অনুসারে বিবাহ দিতে হইল।’’

Advertisement

অসবর্ণ বিবাহে রবীন্দ্রনাথের কোনও সংস্কার ছিল না, কিন্তু রেজিস্ট্রি বিবাহে পিতা দেবেন্দ্রনাথের যে আপত্তি ছিল সেটিকে রবীন্দ্রনাথ অসম্মান করতে পারেননি। অজিতকুমার এই ঘটনায় হয়তো কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। বিষয়টি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে একটি পত্রে লিখছেন— ‘‘...তোমাদের বিবাহে আমি অন্তরে এবং বাহিরে যোগ দেব কেবলমাত্র অনুষ্ঠানভাগে যোগ না দেওয়াতে তোমরা কেন মনকে পীড়িত করবে?’’ তবে রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে ম্যাঞ্চেস্টার বৃত্তি পেয়ে অজিতকুমারের বিলেতযাত্রা সেই অস্বস্তিকে অনেকটা প্রশমিত করেছিল।

রবীন্দ্রনাথ যে কেবল বিবাহকালেই অজিতকুমারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তা নয়, তাঁর বিবাহকে কেন্দ্র করে শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক জীবনে যখন গোলযোগের সূত্রপাত হয়েছিল, কিংবা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে অজিতকুমারকে নিয়ে নানান ঠাট্টা-তামাশা-সমালোচনা শুরু হয়েছিল, সে দিনও কবি অজিতকুমারকে সস্নেহে আগলে রাখতে চেয়েছিলেন। বিশেষ করে ঠাকুরবাড়ির ব্যাপারস্যাপারের তীব্র বিরোধিতা করে মীরা দেবীকে একটি পত্রে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘জীবনকে কেবল ক্ষুদ্র বিষয়ে তুচ্ছ আলোচনায় বিক্ষিপ্ত করে নষ্ট করে ফেলবিনে।’’

অজিতকুমারের মাতা পুত্রের বিবাহের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন এবং সমস্ত ঘটনার জন্য তিনি রবীন্দ্রনাথকেই দায়ী সাব্যস্ত করেছিলেন। এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্নেহের জগৎ থেকে অজিতকুমারকে সচেতন ভাবে নির্বাসন দেননি।

অজিতকুমারের বিবাহোত্তর জীবনে সপরিবার শান্তিনিকেতনে বাস, পরে স্থানাভাবের কারণে গিরিডিতে স্থানান্তর, আশ্রমের কাজকর্ম ও আর্থিক অনিয়ম সংক্রান্ত কিছু অনুযোগ, পুনরায় অজিতকুমারকে রবীন্দ্রনাথ ও আশ্রমের প্রতি বিতৃষ্ণ করে তোলে। স্ত্রী লাবণ্যলেখাকে লিখিত একটি পত্রে মনের সেই ক্ষোভ অজিতকুমার সোজাসুজি জানিয়েছেন— মূল নিবন্ধে শ্রীভট্টাচার্য তা উল্লেখও করেছেন। পত্রের অন্য একটি অংশে অজিতকুমার তাঁর প্রতি অ্যান্ড্রুজ়ের প্রবল বিরাগ ইত্যাদির কথা উল্লেখ করে পরে জানাচ্ছেন, ‘‘...আমি অবশ্য গুরুদেবকে তখনি লিখলাম যে আমাকে বিদ্যালয় থেকে সরাবার ইচ্ছা হলে স্পষ্ট বলাই ভালো... যেদিন আমায় জানাবেন যে তোমায় চাইনা, সেদিনই চলে যাব। গুরুদেবের সঙ্গে কথাবার্ত্তাও তারপর হয়ে গিয়েছে— আমি বলেছি— আমি হতভাগ্য— অযোগ্য আমায় যদি আপনি ভুল বুঝবেন এই সম্ভাবনাই থাকে তাহলে আমায় বিদায় করে দিন। তিনি শুধু বললেন— আমি ভুল বুঝেছিলুম।’’

রবীন্দ্রনাথ সত্যিই ভুল বুঝেছিলেন কি না সে তথ্য পাওয়া মুশকিল, কিন্তু অজিতকুমার যে আশ্রম ও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিলেন তা অত্যন্ত স্পষ্ট হতে থাকে। ১৩১৮ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথকে লেখা একটি চিঠির প্রতিটি ছত্র জুড়ে ছিল বিদ্যালয়ের শিক্ষাপ্রণালী সম্পর্কে ক্ষোভ, সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ ভাবের লোকের সমাবেশ জানিয়ে অভিযোগ ইত্যাদি এবং মন্তব্য— ‘‘আমার চিত্ত কিছুতেই ইহার সঙ্গে সায় দিতে পারে না।’’ অজিতকুমারের এই চিত্তবিক্ষোভ, অসহিষ্ণুতা রবীন্দ্রনাথের ভাল লাগেনি। তিনি যথেষ্ট হতাশ হয়েই অজিতকুমারকে লিখেছেন— ‘‘কখনো কোনো অবস্থায় তোমার মন যেন সংসারের ওকালতি করে নিজেকে না ভোলায়। আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি সংসার আমাদের আইডিয়ালকে যখন খর্ব করার চেষ্টা করে তখন তার মত সঙ্কট আর নেই।... তোমার কাছে কিছু গোপন করা অন্যায় মনে করেই আজ আমি বলচি আমার মনে কিছুদিন থেকে এই আশঙ্কা জেগেছে তোমার নতুন সংসার তোমাকে নীচের দিকে ভারগ্রস্ত করতে আরম্ভ করেছে। এক দিন এমন আশা ছিল যে উপরের পথে চলবার দিকেই তোমার দাম্পত্য জীবন তোমার পাথেয় জোগাবে। কিন্তু আমি হয়ত ভুল বুঝচি— তবু এই শঙ্কাই নানা ছোটবড় কথায় ও ঘটনায় আমার মনে জেগেছে যে ঠিক সে রকমটি হয়নি বরং তার উল্টো হয়েছে এবং তোমাকে এতে খানিকটা পরাভূতও করেছে।

আমার এই কথাটা সত্যই হোক আর মিথ্যাই হোক এই কথা মনে আনা ও প্রকাশ করার দরুণ তুমি আমাকে ক্ষমা কোরো।’’

অজিতকুমার ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সুহৃদ-সম্পর্ক অজিতকুমারের শান্তিনিকেতন ত্যাগের পরও অটুট ছিল, কিন্তু অজিতকুমার তাঁর প্রতি কবির স্নেহশূন্যতা কিংবা শ্রদ্ধাশূন্যতার অভিমান থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি। সেই রকমই কোনও প্রসঙ্গ থেকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘‘তুমি লিখেছ আমি তোমাকে প্রত্যক্ষভাবে কিছু দিতে পারিনি। সে কথাটা ঠিক— আমি কাউকেই সেভাবে কিছু দিতে পারিনে।’’ নিজেকে গুরুর আসনে বসিয়ে অন্যের প্রত্যাশা পূরণের ব্যর্থ চেষ্টা করা ছিল রবীন্দ্রস্বভাব-বিরোধী। বস্তুত অজিতকুমারকে স্বীকৃতিদানে রবীন্দ্রনাথের কার্পণ্য কোথাও দৃষ্টিকটু হয়ে উঠেছে বলা যায় না।

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

কলকাতা-৫২

হকার প্রস্তাব

হকারদের জন্য চাকাওয়ালা স্টলের পরিকল্পনা চমৎকার। তবে মোড় থেকে ৫০ ফুট দূরে বসার যে কথা হয়েছে, সেটা মানা হচ্ছে কি না, নজর রাখতে হবে। অন্তত ‘স্টপ’ লাইন পর্যন্ত যেন কোনও স্টল না থাকে। এতে রাস্তা পারাপারের সুবিধা হবে। আর একটা ব্যাপার করলে ভাল, ফুটপাত ও রাস্তার মধ্যে যে বেড়া দেওয়া থাকে, সেই বেড়াকে তুলে ফুটপাতের কিছুটা অংশ নিয়ে বসানো, যাতে হকারেরা এই বেড়ার বাইরে বসেন। সে ক্ষেত্রে তাঁরা যথেচ্ছ ভাবে ফুটপাত দখল করতে পারবেন না। পথচারীরা তুলনায় সহজেই ফুটপাত দিয়ে যাতায়াত করতে পারবেন, তাঁদের রাস্তায় নেমে পড়ার প্রবণতা কমে যাবে। ফুটপাত আট ফুট চওড়া হলে, পথচারীদের জন্য পাঁচ ফুট রেখে, ওই বেড়া সরিয়ে তিন ফুট ফুটপাতের ভিতরে বসালে, হকাররা তিন ফুট চওড়া জায়গা পেয়ে যাবেন। যেখানে এ রকম বেড়া নেই, সেখানে সাদা লাইন টেনে দেওয়া যেতে পারে।

সমীর দত্ত

কলকাতা-৩২

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।

ইমেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন