অনুরাধা রায়ের লেখা ‘স্বদেশজননীর রূপ ও রূপক’ (২৮-১১) শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। বঙ্কিমচন্দ্র দেশকে মাতৃরূপে স্থাপিত করে এই বন্দনামন্ত্র যে ভাবে উচ্চারণ করেছিলেন তাতে ভারতের সমগ্র জাতীয় আন্দোলন এক নতুন মাত্রা লাভ করেছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের পরবর্তী কালেও এই মাতৃবন্দনা ক্রমশ দশপ্রহরণধারিণী দুর্গার বন্দনায় পরিণতি পেয়েছে। মনে পড়ে কমলাকান্তকেও। কমলাকান্ত বলেছিল, “...চিনিলাম, এই আমার জননী জন্মভূমি— এই মৃন্ময়ী— মৃত্তিকারূপিণী— অনন্তরত্নভূষিতা...।” প্রসঙ্গত মনে পড়ে শ্রীঅরবিন্দের ভবানীমন্দির, ‘দুর্গা-স্তোস্ত্র’-র কথা। সমকালীন আবেগে আজও মন ছুঁয়ে যায় কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদের ‘মা গো, যায় যেন জীবন চলে’। আর ছিল চির উদ্দীপনার গান রবীন্দ্রনাথের ‘আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে’। দেশ-মায়ের জন্যই সে দিন মুকুন্দ দাস উচ্চারণ করেছিলেন— ‘ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে’।
‘বন্দে মাতরম্’-কে কেন্দ্র করে যখন সারা ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ার এসেছিল, তখন এর হিন্দুত্ব নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি। পরবর্তী কালে সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক মতবাদকে কেন্দ্র করে প্রশ্ন ওঠে। এটি বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই শুরু হয় এবং স্বাধীনতালাভ ও দেশভাগের পর বিষবৃক্ষের রূপ নেয়। অতীব দুঃখের যে, আজ তা প্রায় মহীরুহের রূপ নিয়েছে।
‘বন্দে মাতরম্’ বঙ্কিমচন্দ্রের স্বাজাত্যের অন্যতম কীর্তি। তাঁকে দেশমাতৃকার কল্পনা-মূর্তির উদ্ভাবক ও উদ্গাতা বলা যায়। তাঁর আনন্দমঠ-এ দেশকে মাতৃরূপে দেখা এক অভিনব ধারণা। ভবানন্দের এই গান যেন সাহিত্যের মধ্য দিয়ে বঙ্কিমের জাতীয়তাবাদের আহ্বান। এ-গান জাতীয়তাবাদকে উদ্দীপিত করেছিল। এই মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে বহু স্বদেশপ্রেমী প্রাণ দেন। তাঁদের রক্ত ও অশ্রুধারায় স্নাত হয়ে এই উচ্চারণ হিন্দু মানসে এক দিব্যমাত্রা লাভ করে। যদিও সে-সময় জাতীয় সঙ্গীত কী হতে পারে, তা নিয়ে কংগ্রেসের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা চলছে। রবীন্দ্রনাথ এই সম্বন্ধে তাঁর মত কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল নেহরুকে লিখে জানিয়েছিলেন। কবিও সমগ্র গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত রূপে গ্রহণের পক্ষে মত দিতে পারলেন না। কংগ্রেসের অধিকাংশের মতানুসারে ‘বন্দে মাতরম্’ গানটির প্রথম দু’টি স্তবক জাতীয় সঙ্গীত রূপে গৃহীত হয়েছিল। এই গান জাতীয়তাবাদকে খুবই উদ্দীপিত করেছিল। এর আদর্শে বাঙালিরা সে সময় নানা সমিতি গঠনে উৎসাহিত হয়েছিলেন।
বাস্তব ক্ষেত্রে ‘বন্দে মাতরম্’ ও আনন্দমঠ মুসলিম তাড়ানোর কোনও জিগিরই তোলেনি। কাজেই গানটিকে ‘বহুবিতর্কিত’ বলা বোধ হয় ঠিক নয়। এ গান সমগ্র বাঙালি জাতিকে স্বদেশপ্রেমেই দীক্ষিত করেছিল। আনন্দমঠ মুসলিম-বিরোধী নয়, ব্রিটিশ-বিরোধী উপন্যাস। আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বঙ্কিমচন্দ্রের দেশপ্রেমকে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার উৎস বলে তাঁর দেশপ্রেমের অপব্যাখ্যা চলেছে, ‘বন্দে মাতরম্’-এর দেড়শো বছরেও তা বহমান।
সুদেব মাল, খরসরাই, হুগলি
ক্ষতি বাড়বে
অনুরাধা রায়ের লেখা ‘স্বদেশজননীর রূপ ও রূপক’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে ধর্মীয় পরিচিতি সাংবিধানিক অধিকার। ভারতে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন প্রমুখ, এমনকি ধর্মহীন সব মানুষের সম্মানের সঙ্গে বাঁচার অধিকার আছে। তবুও মানুষের ধর্মীয় পরিচিতি স্পর্শকাতর বলে এড়িয়ে সমস্যা জিইয়ে রাখা হয়েছে বহু দিন থেকেই।
ব্রিটিশ সরকারি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে কোনও কারণেই হোক আনন্দমঠ উপন্যাসের পরবর্তী সংস্করণে ‘যবন’ শব্দ পরিবর্তন করে দস্যু, শত্রু, আক্রমণকারী ইত্যাদি তুলনামূলক ধর্মনিরপেক্ষ শব্দ ব্যবহার করেন। এই উপন্যাসের পটভূমিতে রয়েছে ১৭৭০-এর মহাদুর্ভিক্ষ ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, যেখানে বিদ্রোহীদের বিরোধী শক্তি ছিল কোম্পানি-বাহিনী এবং এর সহযোগী নবাবি সৈন্য। অচেনা কোম্পানি বাহিনী ছাড় পেল। সামনে চেনা নবাবি মুসলিম সৈন্য ইতিহাসের কারণে হিন্দুদের কোপে পড়ল।
এটা কঠিন সত্য, ‘ন্যাশনাল সং’ ও ‘ন্যাশনাল অ্যান্থেম’ দু’ক্ষেত্রেই মূল কবিতা-গানের কিছু অংশ বাদ গিয়েছে। কারণও জানা। অনেক সময়ই দেশ ধর্মভেদে ‘মাতৃভূমি’ বা ‘পিতৃভূমি’ হয়। প্রতিবেশী বাংলাদেশ, পাকিস্তানে ‘মাতৃভূমি’ শব্দের ব্যবহার থাকলেও কিন্তু তাদের সংস্কৃতিতে ‘পিতৃভূমি’ও পাওয়া যায়। বাস্তবে মাতৃভূমি বা পিতৃভূমি যা-ই হোক এখন এক বিমূর্ত ধারণা বিশেষ। মাতৃভূমি হলেই হিন্দুদের দেশপ্রেম বাড়বে বা পিতৃভূমি হলে মুসলিমদের দেশপ্রেম বাড়বে এমন ধারণা অবাস্তব, অযৌক্তিক। আমাদের সকলের স্বতন্ত্র ব্যক্তিগত ধর্মীয় পরিচিতির পালন স্পষ্ট সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু ধর্মীয় গোষ্ঠী, দলাদলিতে আমাদের সামাজিক রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম পরিচিতি নিয়ে এক মহাফ্যাসাদে পড়েছে। স্বদেশজননীর প্রতীকটি নিয়ে এত তর্কবিতর্কে ক্ষতির পাল্লাই ভারী হবে।
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি
অপেক্ষাতুর
রণবীর সমাদ্দার তাঁর ‘তরুণের স্বপ্ন ও বিপ্লব’ (১৭-১১) প্রবন্ধে লিখেছেন, “এমন কোনও বৈপ্লবিক রাজনৈতিক শক্তিও নেই, যে এই ছাত্র যুব তরুণ সমাজের অসন্তোষকে সমাজপরিবর্তনের পথে নিয়ে যাবে।” সহমত পোষণ করি। তবে এই প্রসঙ্গে আরও কিছু কথা। এই ছাত্র-যুব সমাজের বর্তমান প্রজন্ম তথা জেন জ়ি-র যে দুর্দমনীয় সাহস আছে তা মানতেই হবে। শাসকের গদি একের পর এক উল্টে যাওয়ার ঘটনা ঘটে চলেছে সে কারণেই। কিন্তু আদর্শ সমাজ তো গড়ে উঠছে না। রাজনৈতিক কাঠামো পুনর্নির্মাণের হাতিয়ার যে নেই এদের হাতে। বহু ক্ষেত্রেই তরুণদল সোজাসাপটা যা বোঝে তা হল, যখন নিচুতলার মানুষ জেগে ওঠে তখন উপরতলার ক্ষমতাসীনদের পতন ঘটে। মেক্সিকোর তরুণ বিদ্রোহীদের মুখে এমন কথাই শোনা গিয়েছে। কিন্তু সমাজের মৌলিক পরিবর্তন ঘটাতে না পারলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা দূরে থাক, মূল সমস্যাগুলোর সমাধান হবে না। মসনদ দখলে জয়ের সাময়িক উল্লাস থাকলেও এ ধরনের বিদ্রোহকে সরকার যে গুঁড়িয়েও দিতে পারে সে দৃষ্টান্তও আছে। মায়ানমারে কিন্তু এমন ঘটনাই দেখা গিয়েছে।
অতীতের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অভিজ্ঞতা থেকেও দু’-একটি কথা ভাবা দরকার। সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতার পর প্রশ্ন উঠতেই পারে, বিপ্লব করেই বা কী হল! জীবনানন্দ দাশ অবশ্য অর্ধশতকেরও অনেক আগে এ প্রশ্ন তুলেছিলেন। সুতীর্থ উপন্যাসে তাই সুতীর্থকে বলতে শুনি— “কিন্তু কিই বা হবে রক্তবিপ্লব করে। অনেকবার তো সে সব করা হল। কিছু হল না তো। ফরাসী বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, স্পেন, চীনের বড় বড় বিপ্লব সব এল গেল— কিন্তু কোনো দিকনিরূপণ মন পরিবর্তন হল না তো মানুষের। আরো খারাপ হল তো। এর চেয়ে আগেকার পৃথিবী ঢের ভালো ছিল।”
প্রশ্ন হল, সেই ‘শুভ রাষ্ট্র’ ঠিক কবে গড়ে উঠবে? এর উত্তর একটাই— আমাদের অপেক্ষাতুর হয়েই থাকতে হবে।
শিবাশিস দত্ত, কলকাতা-৮৪
শহরে জলকষ্ট
বাঁশদ্রোণীর ব্রহ্মপুর এলাকায় দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে তীব্র জলকষ্ট চলছে। সময়ে সময়ে পুরসভা থেকে যে জল সরবরাহ করা হয়, তার পরিমাণ অকল্পনীয় কম। স্নান, কাপড় কাচা তো দূরের প্রশ্ন, পানীয় জলের অভাব দেখা দিচ্ছে। কাপড় কাচার, জল পরিশোধনের যন্ত্র তো বটেই, হাওয়া ঢুকে খারাপ হয়ে যাচ্ছে পাম্প। পুরসভাকে কর দেওয়া সত্ত্বেও বেশির ভাগ সময়ই বাইরে থেকে জল কিনে আনতে হয়। এখন তাতেও প্রশ্নচিহ্ন উঠেছে। কারণ, মূল রাস্তা, ঋষি রাজনারায়ণ রোড খুঁড়ে কাজ চলছে। ফলে, জলের গাড়িও ঢুকতে পারছে না। প্রসঙ্গত, এখানে যখনই রাস্তা খোঁড়া হয়, সেই কাজ অনন্ত কাল ধরে চলতে থাকে। ভাঙা রাস্তার কারণে দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গিয়েছেন, তা নিয়ে সংবাদ-শিরোনাম হলেও পরিস্থিতি বদলায়নি। এই এলাকায় রাস্তা, জলের সরবরাহের মতো মৌলিক চাহিদাগুলিকে এ ভাবে উপেক্ষা করা হয় কেন? জলের লাইন খারাপ হয়ে গেলে সেটি দ্রুত সারাইয়ের দায়িত্ব কি স্থানীয় পুর প্রশাসনের নয়? এই চিঠির মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রতি সুবিবেচনা ও হস্তক্ষেপের অনুরোধ রইল।
অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-৯৬
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে