Communal harmony

সম্পাদক সমীপেষু: অশুভের পরাজয়

এই ভারতেরই হনুমান জয়ন্তীর শোভাযাত্রায় পুষ্পবৃষ্টি করেন মহল্লার মুসলিমরা, শিবের মাথায় জল ঢালতে যাওয়া হিন্দুদের জন্য বাড়িয়ে দেন ঠান্ডা জল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০২২ ০৪:৪১
Share:

দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের ‘আমাদের পথ নেই আর’ (১৯-৪) শীর্ষক প্রবন্ধের প্রত্যেকটি শব্দ থেকে চুইয়ে পড়ছে দুর্ভাবনা, ভারতের সুপ্রাচীন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে। লেখক তাঁর এই উদ্বেগের সপক্ষে সাম্প্রতিক কিছু অপ্রীতিকর সাম্প্রদায়িক ঘটনার উল্লেখ করেছেন। তাঁকে আশ্বস্ত করতে চাই, ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শিকড় ভারতবাসীর সহনশীলতা ও শ্রদ্ধার গভীরে গাঁথা রয়েছে। বহু ঝঞ্ঝাও সেই পরীক্ষিত নিটোল গাঁথনিকে বিশেষ টলাতে পারেনি। এই তো সে দিন এই ভারতের এক মন্দিরের পুরোহিত রোজা-রাখা মুসলিম পড়শিদের জন্য ইফতারের আয়োজন করেছিলেন। কর্নাটকের এক মন্দিরে আজও রীতি মেনে কোরান পাঠ করে শুরু হয় পূজার্চনা। আজও মুম্বইয়ের কোনও তরুণী গন্তব্যে পৌঁছতে দেরি হলেও রাজি থাকেন অপেক্ষা করতে, যাতে মুসলিম চালক যথাসময়ে নমাজ পড়তে পারেন।

Advertisement

এই ভারতেরই হনুমান জয়ন্তীর শোভাযাত্রায় পুষ্পবৃষ্টি করেন মহল্লার মুসলিমরা, শিবের মাথায় জল ঢালতে যাওয়া হিন্দু ভক্তদের জন্য বাড়িয়ে দেন ঠান্ডা জল, গ্লুকোজ়ের গেলাস। হিন্দুর শবদাহে নির্দ্বিধায় কাঁধ দেন পড়শি মুসলিম। আজও স্কুলের সরস্বতী পুজোয় দুই সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীরা অংশগ্রহণ করে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। সত্যপির ও মানিক পিরের দরগায় শিন্নি চড়ান হিন্দু ও মুসলিম, উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ। সুন্দরবন এলাকায় জঙ্গলে যাওয়ার আগে বনবিবি, দক্ষিণ রায়ের থানে মাথা ঠেকান হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে। গাঁয়ের ফুটবল টিমের ফরওয়ার্ড অনুপ গোল করলেই আজও জয়নাল খুড়ো তাকে কাঁধে তুলে নাচবেনই। তালিকাটি আবহমান ও অফুরান। ভারতের জিনে সম্পৃক্ত বহুত্ববাদ, সহিষ্ণুতা ও শ্রদ্ধার নিটোল উপাদান। সর্বোপরি জীবনের মৌলিক সমস্যা, চাওয়া-পাওয়া, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার সাযুজ্য, সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষকে রেখেছে ‘আরও বেঁধে বেঁধে’, তাঁদের স্বরকে করেছে একমুখী, সুরে সুর মিলিয়েছে। অশুভ শক্তির সাধ্য কি তাতে চিড় ধরায়?

পলাশ মান্না
সবং, পশ্চিম মেদিনীপুর

Advertisement

ঐক্যের অভাব
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য দেশের সামাজিক ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান ঘৃণার রাজনীতির বিপদ সম্পর্কে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এ আশঙ্কা আজ ভারতের প্রতিটি ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের মনে। এ কোন ভারত, যেখানে প্রতি দিন শুধু ভিন্ন ধর্মের কারণে মানবতার অপমান ঘটে? উগ্র হিন্দুত্বের আস্ফালনে নানা ছলছুতোয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে দমিয়ে রাখার কৌশল কেন গ্রহণ করেছে এ দেশ? ভারত আবহমান কাল থেকেই বহু ধর্ম, সম্প্রদায়ের ভাষা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করেছে, এ দেশ বহুত্বের মিলনক্ষেত্র। সবাই এখানে মিলে-মিশে বসবাস করে এসেছে যুগ যুগ ধরে। আজ কেন্দ্রের বিজেপি সরকার পরিকল্পিত ভাবে ক্ষমতাসীন থাকার লক্ষ্যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ভাবাবেগে উগ্র মুসলিম বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলার জন্য যে সমস্ত কর্মপদ্ধতি চালাচ্ছে, তারই নানা রূপের প্রকাশ দেখা যাচ্ছে প্রতিবেদনে উল্লিখিত ঘটনা সমূহের মধ্যে দিয়ে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বিজেপির একমাত্র লক্ষ্য যে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানো, সেটা তো সবাই জানে, বোঝে। কিন্তু বর্তমানে বিজেপিকে রুখতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির যে জোট দরকার, তার সম্ভাবনা কতটুকু? সে কথাটা স্পষ্ট নয়, কারণ বিভিন্ন স্বার্থের সংঘাত সেখানেও। ষাট, সত্তর ও আশির দশকের বাম ও সমাজতান্ত্রিক দলগুলির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা শ্রমজীবী মানুষের শ্রেণিসংগ্রাম, যা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোকে প্রতিহত করতে পারত, তা বর্তমান আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। তাই বিদ্বেষের সর্বগ্রাসী প্লাবন, তারই ধ্বংসলীলা দেখছি আমরা এই ঘৃণা আর বিভেদে। এই বিদ্বেষের রাজনীতি দেশের ঐক্য ও সংহতির কতটা বিনাশ ঘটায়, সেটা ভেবে সচেতন মানুষ আতঙ্কিত।

দেবকী রঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়
উত্তরপাড়া, হুগলি

দায় বিরোধীরও
বর্তমান সময়ের নিদারুণ অভিঘাতে সাধারণ মানুষকে প্রতি পদক্ষেপে নানা বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। জীবনের চলার পথে এত প্রতিকূলতা ও দিশাহীনতার কথা ব্যক্ত করতে চেয়ে সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দৃঢ়বন্ধনে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন কবি শঙ্খ ঘোষ, “আমাদের পথ নেই আর, আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি।” হয়তো তাঁর কবিতাটিরই কথা স্মরণ করে দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের প্রবন্ধের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে। এটা সত্য যে, ধর্মের নামে ধ্বংসের তাণ্ডবের বিরুদ্ধে সরব হওয়া আজ সময়ের দাবি। বেশ কয়েক বছর ধরে কখনও ভাষা, কখনও খাদ্য, কখনও পোশাক— সব ক্ষেত্রেই ধর্ম দিয়ে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দেশের শাসকরা। প্রাবন্ধিক আহ্বান জানাচ্ছেন, “‘আমরা-ওরা’র বেড়া ভেঙে বেরিয়ে আসুক আমাদের সকলের ভারত।”

কিন্তু কেমন করে এই বেড়া ভাঙবে দেশের আমজনতা? এক দিকে দেশের শাসক তাঁর ক্ষমতা ও পেশিশক্তির জোরে সংখ্যালঘু মুসলমান নাগরিকের উপর ঘৃণাবর্ষণ ও হিংসাত্মক আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্য দিকে এ সব দেখেও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির নেতা-নেত্রীরা নির্লজ্জের মতো হিসাব কষে যাচ্ছেন, কোন সুবিধাবাদী পথ নিলে তাঁদের দলের অস্তিত্ব রক্ষা পাবে; কিংবা সেই দলে থেকেই সহজে বেছে নেওয়া যাবে প্রধানমন্ত্রী বা অন্য গুরুত্বপূর্ণ পদগুলি। আবার কোনও দল কয়েক দশকের ক্ষমতা হারিয়ে আপন শত্রুকে বিনাশ করার অঙ্ক কষতেই ব্যস্ত! এই যদি রাজনৈতিক দলগুলির কর্ণধারদের মনোভাব হয়, তবে দেশের শাসক জনগণের উপর যেমন খুশি প্রভুত্ব চালালেও সাধারণ মানুষ তো অসহায় বোধ করবেই।

প্রশ্ন জাগে, এত সঙ্কটের আবহেও কি সঙ্কীর্ণ রাজনীতির নাগপাশ থেকে মুক্ত হবে না বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি? ওই সব দলের নেতা-নেত্রী আর কবে দেশের ভালমন্দের দিকগুলো নিয়ে ভাববেন? অপশাসন রুখতে এমন ‘জোট’ কি গড়ে তোলা সম্ভব নয়, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা প্রাধান্য পাবে সবার আগে? আর তা যদি না হয়, তবে অজস্র মূল্যবান নিউজ়প্রিন্ট খরচ করে বার বার লেখা হতেই থাকবে একই কথা।

শক্তিশঙ্কর সামন্ত
ধাড়সা, হাওড়া

ক্ষমতার চাল
রঞ্জিত শূরের ‘গরিব মারে, আর গরিবই মরে’ (১৯-৪)প্রতিবেদনটি চিরসত্য। বেশ কয়েক যুগ ধরে প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলই এই গরিব ছেলেমেয়েদের রাজনৈতিক বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। আর গরিবরাও অতি উৎসাহে ব্যবহৃত হচ্ছেন। শুধু ভোটের সময় নয়, ভোট-পরবর্তী সময়ও এঁদের কাজে লাগানো হয়। এলাকা দখল, জমি দখল, ভেড়ি, সিন্ডিকেট, তোলা আদায়ের মতো কাজে অনুগত সৈনিকের মতো এঁরা কাজ করেন। এর পিছনে রয়েছে লম্বা ইতিহাস।

প্রথমত, এঁদের বাবা-মা গরিব। বেশি দূর লেখাপড়া করাতে পারেননি। একটু বড় হতেই এঁরা বুঝতে পারেন বেকারত্বের জ্বালা। দ্বিতীয়ত, এই বয়সে এসে তাঁরাও স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্ন পূরণ করার জন্য চাই অর্থ। তাঁরা তখন দিশাহারা হয়ে ওঠেন। যুক্ত হ়ন নানা রকম অসামাজিক কাজে। আর এই দুর্বল মুহূর্তে পরিণত হয় রাজনৈতিক বোড়েতে। গরিব মানুষরা ইচ্ছা করে কিন্তু এই পথে আসেননি। অনেক সময় মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েও তাঁরা বাধ্য হন হুকুম তামিল করতে। এর জন্য দায়ী দেশ, রাজ্য, সমাজ। চাকরি বা অন্য কর্মসংস্থান থাকলে নিশ্চয়ই তাঁরা এই পথ বেছে নিতেন না।

তৃতীয়ত, কেউ কোনও দিন এঁদের মনুষ্যত্বের বোধকে জাগ্রত করার চেষ্টা করেনি। ভাল কাজে ব্যবহার করেনি। তাই অর্থের লোভে নিজের জীবনকে বিপন্ন করে এই গরিব মানুষেরা শুধু মরেন, আর মারেন।

স্বপন আদিত্য কুমার
অশোক নগর, উত্তর ২৪ পরগনা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন