সম্পাদক সমীপেষু: এ দ্বিচারিতা কেন?

কিছু দিন আগে সংসদের ভিতর রাহুলকে ভালবাসায় বুঁদ হতে দেখা গিয়েছে, মোদীকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে। পরক্ষণেই নিজের জায়গায় এসে চোখ টিপে ‘রক’ কালচারে বুঁদ হয়েছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০৪
Share:

ভাবনাচিন্তার সংস্কৃতি কতটা দেউলিয়া হয়ে গেলে ‘রাহুলের কৈলাস সফরে চাপ বাড়ছে বিজেপির’ (৮-৯) মতো একটি সস্তা সংবাদ খবর হয়ে উঠতে পারে? বিজেপি সাম্প্রদায়িক দল, হিন্দুত্বের তাস খেলে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে বলে প্রতিনিয়ত বিজেপির তথা মোদীর সমালোচনায় মুখর হয়ে আপনারা ‘সম্পাদকীয়’ বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন। আজ যখন রাহুল গাঁধী সেই একই পথে হিন্দুত্বের তাস খেলছেন কৈলাস সফরে গিয়ে, তখন তাঁর ও তাঁর দলের সমালোচনা না করে বাহবা দিচ্ছেন: রাহুল এত দিনে এক নেতা হয়ে উঠতে পেরেছেন, যিনি মোদীকে যোগ্য জবাব দিচ্ছেন! রাহুল কৈলাস থেকে ভিডিয়ো পোস্ট করে বার্তা দিচ্ছেন ‘শিবই মহাবিশ্ব’। এই ধরনের বার্তা যদি মোদী দিতেন তা হলে কি পরের দিন বিজেপির হিন্দুত্বের ‘অবিচুয়ারি’ লেখা হত না? এই দ্বিচারিতা কেন? রাহুলের কৈলাস সফর বিজেপির উদ্বেগের কারণ হলে তো বলতে হয়, কংগ্রেস গণতন্ত্রের উপর আস্থা হারিয়ে হিন্দু ধর্মের উপর বিশ্বাস রাখাটা মোদী-মোকাবিলায় উপযুক্ত মনে করছে।

Advertisement

কিছু দিন আগে সংসদের ভিতর রাহুলকে ভালবাসায় বুঁদ হতে দেখা গিয়েছে, মোদীকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে। পরক্ষণেই নিজের জায়গায় এসে চোখ টিপে ‘রক’ কালচারে বুঁদ হয়েছেন। রাহুল একাধারে মুসলিম নেতা, দলিত নেতা, আদিবাসীদের নেতা, সর্বোপরি এখন তিনি পৈতেধারী এক শিবভক্ত। এমন এক ব্যক্তিকে দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে বাধা দেওয়াটা বিজেপির সাম্প্রদায়িকতা আর ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানাবার অপচেষ্টা— এ ছাড়া আর কী-ই বা ব্যাখ্যা হতে পারে তথাকথিত কিছু মিডিয়া আর সুশীল সমাজের বুদ্ধিজীবীদের কাছে?

মিহির কানুনগো

Advertisement

কলকাতা-৮১

জ্বরের দেবতা

গৌতম চক্রবর্তী ‘জ্বরাসুর মাহাত্ম্য’ (২৬-৮) শীর্ষক লেখায় শীতলার উদ্ভব প্রসঙ্গে দেবীর (শীতলার) চেষ্টায় রাম-সীতার সন্তান লব ও কুশের জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়ে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু শুধু লব-কুশই নয়, মর্তে পুজো পাওয়ার বাসনায় দেবী শীতলার দ্বারা শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বিভিন্ন কবির লেখা শীতলামঙ্গল কাব্যে নানা ভাবে ছড়িয়ে আছে। কখনও দেখা যায় শিবভক্ত রাজা চন্দ্রকেতু শীতলা পুজোয় অস্বীকৃত হওয়ায় দেবীর রোষানলে পড়েছেন। শীতলার বরাবরের মনোযোগ শিশুদের দিকে: ‘‘ছাওয়ালে দেখিয়া দয়া জন্মিল অন্তরে’’। এই দয়া কিন্তু বাৎসল্য নয়। বরং বসন্তের চিহ্নহীন নিষ্পাপ শিশুমুখ দেখে তাঁর মনে ভিন্ন ভাবনার উদয় হয়। শেষে শিশুদের রক্ষার জন্য শীতলার পূজা করতে বাধ্য হন রাজা। শীতলামঙ্গল কাব্যে কবি নিত্যানন্দ চক্রবর্তী লিখেছেন, নহুষ রাজার পুত্রেষ্টি যজ্ঞের নির্বাপিত কুণ্ড থেকে শীতলার জন্ম।

শীতলাকে অলৌকিক শক্তি প্রদর্শন করতে দেখা যায় শিশু-বিনষ্টির মধ্য দিয়ে। তাই শুধু মহিলারা সন্তানের মঙ্গলকামনায় তাঁর পূজা করতেন, এমন দৃষ্টান্তও পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে বৌদ্ধ দেবী হারীতীর সঙ্গে শীতলার মিল আছে। কারণ হারীতী বসন্ত রোগের দেবী হলেও, তিনি একাধারে সন্তান-বিনষ্টকারী ও সন্তান-রক্ষাকারী দেবী হিসাবেও পরিচিত ছিলেন। বৌদ্ধ সাহিত্য মহাবংশ, সর্বাস্তিবাদীদের বিনয়পিটক, সদ্ধর্ম পুণ্ডরীক সূত্র এবং কাশ্মীরি কবি ক্ষেমেন্দ্রর বোধিসত্ত্বাবদানকল্পলতার কাহিনিতে উল্লেখ আছে, প্রথমে হারীতী শিশুবিনষ্টকারী হলেও পরে বুদ্ধের সংস্পর্শে এসে তিনি শিশুরক্ষাকারী দেবীতে পরিণত হন। অবশ্য বৌদ্ধদের অন্য একটি প্রাচীন গ্রন্থ মহাবস্তুতে, হারীতী শিশুবিনষ্টকারী নন। ইৎ সিঙের বর্ণনায়, হারীতী উত্তর ভারতে শিশুদের রক্ষাকারী দেবী হিসাবে পূজিত।

তবে হারীতীর থেকেও শীতলার বেশি মিল বৌদ্ধ দেবী পর্ণশবরীর সঙ্গে। ইনিও প্লেগ, বসন্ত ইত্যাদি মহামারির দেবী। বৌদ্ধদের দেবতা হয়গ্রীবের সঙ্গে শীতলার সহচর জ্বরাসুরের সাদৃশ্য আছে। উভয়েই জ্বরের দেবতা। ঢাকার বিক্রমপুরের নয়নাদ ও বজ্রযোগিনী গ্রাম থেকে পর্ণশবরীর দু’টি মূর্তি পাওয়া গিয়েছে (বর্তমানে ঢাকার সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত), তাতে দেখা যাচ্ছে দু’টি মূর্তিরই ডান পাশে রয়েছেন হয়গ্রীব ও বাম পাশে শীতলা। দু’জনেই পর্ণশবরীর বিপরীত মুখে উড্ডীয়মান ভঙ্গিতে রয়েছেন। যেন দেবীর রোষানলে পড়ে পালিয়ে যেতে তৎপর। শীতলার বাহন গাধা। গাধার দুধ বসন্ত রোগের প্রতিষেধক বলে মনে করা হয়। নেপালে পর্ণশবরীর একটি মূর্তি পাওয়া গিয়েছে, যেখানে তাঁর বাহন হল গাধা।

রাহুল বড়ুয়া

কলকাতা-৭৪

একটা গল্প

তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তারানাথ তান্ত্রিক’ বইতে একটি কাহিনিতে জ্বরাসুরের কথা আছে। গৌতমবাবুর বর্ণনানুযায়ী মাথা ও বাহুর সংখ্যা মিললেও, তার পা ও কাঁটা সমেত একটি ল্যাজেরও উল্লেখ আছে। বর্ণ ঘোর কালো। এর পুজো হয় বাড়ির বাইরে। এর বিসর্জন হয় না। পশুবলি দিয়ে, সেই বলির রক্তেই মূর্তি গলিয়ে ফেলতে হয়। অবশিষ্টাংশ জলে না দিয়ে, দাহ করতে হয়। একে পুজো দিলে অসুখ সারে বটে, কিন্তু যাঁর নামে সঙ্কল্প করা হয়, তিনি ছ’মাসের মধ্যে মারা যান। গল্পে তারানাথের ভয়ঙ্কর জ্বর সারাতে তাঁর দাদু নিজের নামে সঙ্কল্প করান ও পুজো করান। ইচ্ছা করেই পুঁথির শেষ পাতায় লেখা সাবধানবাণী পুড়িয়ে ফেলেন। ছ’মাসের মাথায় মারা যান।

অরিত্র মুখোপাধ্যায়

চাতরা, হুগলি

ভিন্ন রোগ

গৌতম চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘‘পরে, ব্রিটিশ আমলে গল্পটা অন্য রকম হয়ে গেল। কবিরাজি, অ্যালোপ্যাথি, হোমিয়োপ্যাথি তিনটি হয়ে গেল রুদ্ধদ্বার কক্ষ, একের সঙ্গে অন্যের সংযোগ থাকল না।’’ এই সংযোগহীনতারই গল্প দেশে দেশে ঔপনিবেশিক প্রভুরা উপহার দিয়ে যায়। তাই আমরা দেখি, লাতিন আমেরিকার দেশগুলো স্পেন বা পর্তুগালের কাছ থেকে রাজনৈতিক আজাদি অবশ্যই পায়, কিন্তু সে সব দেশের মানুষের মাতৃভাষা হারিয়ে যায়। প্রভু-দেশের ভাষাই আস্তে আস্তে হয়ে ওঠে তাদের মুখ ও মনের ভাষা। সুতরাং শুধু চিকিৎসাশাস্ত্রেই নয়, উপনিবেশ আসলে সব দিক থেকেই আমাদের একা করে দেয়।

যে সময় মেকলের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠছে ভারতে, চার দিকে তৈরি হচ্ছে নানা বিদ্যায়তন, সে সময়ই কয়েক শতাব্দী ধরে চলে আসা, ভারতের সনাতন টোল ও মাদ্রাসা ভিত্তিক সেকুলার শিক্ষাব্যবস্থা উঠে যেতে থাকে। বন্ধ হতে থাকে সকলের জন্য শিক্ষার সুযোগ। ব্রিটিশরা শহরে যে সমস্ত বিদ্যায়তন গড়েন, সেগুলির দরজা গরিবের জন্য বন্ধই থেকে যায়, কারণ সেখানে পঠনপাঠনের খরচ বিশাল। দ্বিতীয়ত, প্রাচীন বিদ্যাশিক্ষার কেন্দ্রগুলোতে টিকিধারী পণ্ডিতমশাই যেমন পড়াতেন, তেমনই থাকতেন মৌলবি সাহেবও, ফলে দেশটাকে কখনও কোনও পড়ুয়ার নির্দিষ্ট ধর্মের মনে হওয়ার সুযোগ থাকত না। অথচ শহরে ইংরেজ শাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় যে শিক্ষা চালু হল, তা থেকে প্রথমেই বাদ হয়ে গেল মুসলমান, দলিত ও অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল শ্রেণি।

কিন্তু এর উল্টোটাও ঘটতে পারত। প্রাচীন শিক্ষাপদ্ধতির ভালটা আত্মীকরণ করেই পথ হাঁটতে পারত, তুলনায় আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতি। আসলে উপনিবেশের প্রভুর সংস্কৃতি প্রথমেই বোঝায়, শোষিতের কোনও ভাল দিক থাকতেই পারে না। আলো আমরা সরবরাহ করব তোমাদিগকে। আর এই মানসিক অবদমনের রাজনীতির ফলে, তৃতীয় বিশ্ব হয়ে ওঠে এমন এক বহুতল, যার এক তলার সঙ্গে দোতলার, দোতলার সঙ্গে তিন তলার কোনও আত্মিক যোগাযোগই থাকে না।

সেই বিচ্ছিন্নতার রাজনীতিকেই আজ হিন্দুত্ববাদীরা সুচতুর ভাবে ব্যবহার করছে। ফলে ভারতীয় সংস্কৃতির গভীরতর রূপ রস গন্ধ বর্ণকে মুছে দিয়ে হিটলারি মডেলের এক হিন্দু সংস্কৃতি গড়ে তুলছে, যেখানে বিতর্কের কোনও স্থান নেই। স্থান নেই ইসলাম-সহ ভারতের অন্য সংস্কৃতিগুলোর সঙ্গে বার্তালাপের।

দেবাশিস চক্রবর্তী

কলকাতা-৬১

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।

ইমেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন