তিন বছরের ছেলের জন্য দুধও কিনতে পারলাম না

এই লকডাউন পরিস্থিতিতে পাঠকদের থেকে তাঁদের অবস্থার কথা, তাঁদের চারপাশের অবস্থার কথা জানতে চাইছি আমরা। সেই সূত্রেই নানান ধরনের সমস্যা পাঠকরা লিখে জানাচ্ছেন। পাঠাচ্ছেন অন্যান্য খবরাখবরও। সমস্যায় পড়া মানুষদের কথা সরকার, প্রশাসন, এবং অবশ্যই আমাদের সব পাঠকের সামনে তুলে ধরতে আমরা মনোনীত লেখাগুলি প্রকাশ করছি।দোকানদার পাশেই থাকায় জিজ্ঞেস করলাম এক প্যাকেট দুধ পাওয়া যাবে? উত্তরে বড় করে ‘না’ বলে দিলেন দোকানদার।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২০ ০৭:৩০
Share:

প্রতীকী ছবি।

মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে আমি রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াই। কলকাতার বাসিন্দা হিসেবে কলকাতা থেকে কোনও বাস এলেই আমি সেটা উপভোগ করি। সাধারণত পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদয়গিরি-খণ্ডগিরিতে ঘুরে তার পর রাজারানি মন্দিরে বেড়াতে যান। সত্যজিৎ রায়ের বই, সম্ভবত ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’তে এই মন্দিরের কথা পড়েছি। প্রতিদিন শহরে পর্যটক ভর্তি থাকত। তার পর সেখান থেকে অনেক মানুষ পুরী যেতেন। প্রভূ জগন্নাথ মন্দির ও পুরীর সমুদ্রসৈকতের সৌন্দর্য দেখতে যেতেন। কিন্তু এখন সেই শহর পুরো ফাঁকা।

Advertisement

নবীন পট্টনায়ক বলেছেন, রবিবার রাত পর্যন্ত সব কিছু পুরোপুরি বন্ধ থাকবে। আজ সকালে আমার তিন বছরের ছেলের জন্য একটি দুধের দোকানে দুধ (ওড়িয়া ভাষায় ক্ষীর) কিনতে গিয়েছিলাম। কিন্তু দুধের দোকানও বন্ধ। তবে দোকানদার পাশেই থাকায় জিজ্ঞেস করলাম এক প্যাকেট দুধ পাওয়া যাবে? উত্তরে বড় করে ‘না’ বলে দিলেন দোকানদার। জানি না, আগামী দিনে আরও কী হবে। আশা করি, ভাল দিন আসবে।

রোমিও দে, ভুবনেশ্বর

Advertisement

অনেক কঠিন পরিস্থিতি দেখেছি, তাই ভয় পাই না

আমার নয়ডায় পদার্পণ ১৫ মার্চ। পরের দিন নতুন চাকরিতে যোগ। একাই এসেছি। মা, বাবা, স্ত্রী, পুত্র সকলেই কলকাতায়। স্বভাবতই ওরা আমার জন্য আর আমি ওদের জন্য উদ্বিগ্ন। বিদেশে থাকা আত্মীয়দের সঙ্গেও রোজই হোয়াটসঅ্যাপ মারফত যোগাযোগ। দিকে দিকে শুধুই যেন ভয়ের ছবি। আশঙ্কা আর দুশ্চিন্তার সঙ্গে ভালভাবে থাকার টানাপড়েন। আমার এ দেশেরই বেশ কিছু দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘোরার ফলে হোক বা ট্রেকিং-এর নেশা থেকেই হোক, অতটা আতঙ্কিত লাগে না। আমরা অনেক সময়েই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এমন ভাবে সময় কাটিয়েছি যে নয়ডার মতো শহরে বসে করোনা আর লকডাউনের ফলে কী হবে, অত ভয় হচ্ছে না। আজই একটা জরুরি জিনিসের প্রয়োজনে আমাকে সাড়ে চার কিলোমিটার হেঁটে যেতে হচ্ছে। যদি এক বেলা খাবার না পাই বা কম খাই, তাতে কী এমন হবে? আর আমরা তো যাকে বলে প্রিভিলেজড। সারা দেশে এত কোটি কোটি মানুষ আছেন, যাঁরা সহায়-সম্বলহীন। বা অনেক বন্ধুর মুখেই শুনলাম, কত লোকে কত বেকায়দা পরিস্থিতিতে আটকে পড়েছেন। আমরা যাঁরা নিয়মিত ডিসকভারিতে বিয়ার গ্রিসস-এর ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড টা দেখতাম, তাঁদের কেবলই মনে হচ্ছে ওই প্রোগ্রাম ছেলে-বুড়ে সবার এখন আরও বেশি করে দেখা উচিত। আতঙ্কিত না হয়ে কী ভাবে বেঁচে থাকা যায়, সেটা আমাদের সময়ে হওয়া অন্যতম সেরা অ্যাডভেঞ্চার প্রোগ্রাম, যেতা সাধারণ ও অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের কাজে লাগবে।

শুভজিৎ চৌধুরী, নয়ডা

এই অন্ধকার এক দিন ঘুচে যাবে

এক মাসের মত হয়ে গেল বাড়ির বাইরে পা রাখিনি। যত দিন যাচ্ছে, নিউ জার্সির পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে। বাড়িতে দু’বছরের ছেলে আর ছ’মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে আছি। ডাক্তারের কাছে যাওয়া এখন অসম্ভব তাই ফোনেই ডাক্তারের কাছ থেকে আমার স্ত্রী পরামর্শ নিয়ে নেন, কোন ওষুধ খাবে বা খাবে না। ওষুধ বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছে, এছাড়া অনলাইন ডেলিভারিতে দুধ, ডিম, কিছু ফল সব্জি, পেয়ে যাচ্ছি। ছেলে মাঝে মাঝে বলে “বাবা মার্কেট যাব, মাছ কিনতে হবে’’। ও মার্কেট যেতে খুব ভালোবাসে। জানি না কতদিন তাকে বলতে হবে, মার্কেট তো এখন বন্ধ। যখন খুলবে, নিয়ে যাব।

রোজ সকালে উঠে খবরে চোখ রেখে দেখি আজকের আক্রান্তের সংখ্যা কি কালকের থেকে কম নাকি বেশি। এখনও গ্রাফটা উর্ধমুখী, ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, এই গ্রাফ যেন খুব শ্রীঘ্রই নিচে নেমে যায়। এই অন্ধকার একদিন ঘুচে যাবে।

কৃষ্ণেন্দু ধর

জার্সি সিটি, নিউ জার্সি

এমন কালো দিনের কথা কখনও ভাবিনি

পশ্চিমঙ্গবাসী, আটটে আছি ঝাড়খণ্ডে। সন্তান খুবই অসুস্থ। ওষুধ চলছে, কিন্তু সে ওষুধে কাজ হচ্ছে না। এই মুহূর্তে অনেকগুলো টেস্টের প্রয়োজন। কিন্তু সে সব টেস্ট বন্ধ। বাইরের ডাক্তার ডেখানোর কথা ছিল। বিমানের টিকিট ছিল। সব বন্ধ। এমনকি, নিজের রাজ্যে যাওয়া বন্ধ। গেলেও চিকিৎসা পাব? এই চিন্তায় সমস্ত রাতদিন আলাদা করা যাচ্ছে না। সবই যেন অন্ধকারে ঢাকা। কোনও প্রদীপ বা মোমবাতি আমাদের অনের অন্ধকার দূর করতে পারবে? জানি না, এই মুহুর্তে আমাদের সন্তানের জন্য চাই এক জন ভাল ডাক্তার। ভাল ল্যাব, স্বাস্থ্য পরিষেবা। এমন কালো দিনের কথা কখনও ভাবিনি। অসহায় অবস্থা সত্যি যে কী, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।

সুমিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়

কিছু লোক সুযোগ এই পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছেন

করোনা মোকাবিলায় লকডাউন শুরু হয়েছে ২৩ মার্চ, রাত ১২টা। রাজ্যে ওই দিন বিকেল পাঁচটা থেকে। হাসপাতাল-সহ সমস্ত অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা ছাড়া বাদবাকি সব বন্ধ হয়ে গেল। এই জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত মানুষগুলো পরিষেবা দিতে পৌঁছবেন কী করে, তার নীল নকশা তখনও তৈরি হয়নি। যাঁরা কাজে যোগ দিয়েছিলেন, লকডাউন শুরু হয়ে যাওয়ার পর তাঁদের লড়াই ছিল কাজের পর কী ভাবে বাড়ি ফিরবেন। থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেলেও এক বস্ত্রে আর কত দিন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের থেকেও যেন ভয়াবহ। এই সময়টুকুর জন্য কাজে আটকে যাওয়া মানুষের লড়াইয়ের মূল বিচার আমজনতা কেন, সেই প্রশাসনের কর্মকর্তারাও ঠিকমতো অনুধাবন করেন না।

আমি কর্মসূত্রে রেল পরিবহণের সঙ্গে এমন ভাবে যুক্ত, যেখানে অনেক কাছ থেকে প্রশাসককে দেখি। তাঁরা কতটা দায়িত্বশীল না দায়সারা গোছের তাও বুঝতে পারি। কিন্তু বিপর্যয়ের মধ্যে যাঁরা কাজ করেন, গ্রাউন্ড লেভেল থেকে এগিয়ে নিয়ে যান, তাঁরা তাঁদের কাজের জন্য কখনও অনুতপ্ত হন না। বরং সেই কাজের জন্য তাঁরা বেশ গর্ববোধ করেন। আর এই সংখ্যাটা প্রায় ৯০ শতাংশ। বাকি দশ শতাংশ কাজ না করার জন্য পরবর্তী সুযোগকে কী ভাবে ভবিষ্যতে সদ্ব্যবহার করতে হয়, তা ঠিক জানেন।

বর্তমান করোনা বিপর্যয়ে রেল পণ্য পরিবহণ করছে। এই পরিষেবা দেওয়ার জন্য স্টাফদের যাতায়াতের জন্য প্রশাসন স্টাফ কার চালাচ্ছে। তবু কিছু স্টাফ, যাঁরা ওই ১০ শতাংশের মধ্যে পড়েন, নানা অজুহাতে কাজে যোগ দিতে আসেননি। কারণ, তাঁরা জানেন, এই বিপর্যয়ে কাজ না করলে বেতন আটকাবে না। সরকার তাইই বলেছে। এই যে মালগাড়ি চলছে, তার জন্য স্টেশন মাস্টার-সহ অন্যান্য স্টাফ, গার্ড, ড্রাইভার— যে ভাবে দিনরাত এক করে কাজ করে যাচ্ছেন, এঁরাও বেতন পাবেন। আবার যাঁদের কাজ করতে হচ্ছে না, তাঁরা বাড়িতে বসেই বেতন পাবেন। তা হলে যিনি কাজ করছেন, তিনি দেশের জন্য প্রথম সারির সৈনিক হিসেবে কাজ করছেন বলে কি শুধু সাধুবাদ পাবেন? তার মানে বিপর্যয়ে কর্মরত কর্মীর কাজ ছাড়া তাঁর আর কোনও অধিকার নেই?

নরেন্দ্রনাথ কুলে, কলকাতা

আটকে পড়েছি, সাহায্য করুন!

আমি কলকাতার মুর্শিদাবাদ জেলার ইসলামপুর থানার কাশিমনগরের একজন বাসিন্দা। আমি কাজের সন্ধানে কেরলে আছি (ঠিকানা: গ্রাম কোদানড়, পোস্ট অফিস ৬৮৬৬৫১, তালুক মানচিল, থানা মেলুকাভু, জেলা কোট্টায়াম)। আমরা ৮ জন আছি। আমাদের কাছে কোনও ধরনের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। আমাদের কাছে সামান্য কিছু টাকা ছিল, তাই দিয়ে আমরা এতদিন আমাদের খাবার খরচ চালিয়েছি। দয়া করে আমাদের সরকার আমাদের এই দুঃসময়ে আমদের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে আমরা কৃতজ্ঞ থাকব।

সামিম আখতার

মোবাইল -৭৪৭৭৬৮৪৩৬০

খাদ্যদ্রব্যের পাশাপাশি এ বার জল সঙ্কটেও পড়ব

গত এক বছর স্বামীর কর্মসূত্রে দক্ষিণ বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা। এখানে খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বেশ অপ্রতুল। কিন্তু বড় কমিউনিটির মধ্যে থাকায় আমাদের জন্য সব রকম ব্যবস্থাই কর্তৃপক্ষ করছেন। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। বিশেষত খাদ্যদ্রব্য। তবে লকডাউনের সুনিয়ন্ত্রিত ছবি এখানে দেখতে পাচ্ছি আমরা। জানি না যাঁরা খুব সহজ জীবন কাটান এবং প্রতিদিনকার রুজি-রুটি প্রতিদিন জোগাড় করেন, তাঁদের কি অবস্থা। আমাদের আবাসনে কর্মসহায়িকাদের প্রায় দু’সপ্তাহ আগেই নোটিস এসেছিল। আমি ব্যক্তিগত ভাবে তিন সপ্তাহ আগেই ছুটি দিয়ে দিয়েছিলাম আমার দু’জন সহায়িকাকে। ফোনে খোঁজ নিচ্ছি৷ এমনিতেই বেঙ্গালুরুর জল-সঙ্কট কুখ্যাত। যেটা বুঝতে পারছি, খুব শিগগিরই পানীয় জলের সঙ্কট খুব বেশি করে ঘনিয়ে উঠবে।

শ্রেয়সী চক্রবর্তী, বেঙ্গালুরু

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement