১৪ ফেব্রুয়ারি কাশ্মীরের পুলওয়ামায় মিলিটারি কনভয়ের উপর গাড়ি বোমা হামলা— শহিদ হলেন অসংখ্য জওয়ান। বেদনায় শ্রদ্ধায় আমরা স্মরণ করি তাঁদের। ধিক্কারে গর্জে উঠি। থেমে থাকি না সেখানে। কখনও বা আবেগ লাগাম ছেড়ে আহ্বান জানায় আগুনে প্রতিহিংসার, যার প্রতিফলন আছড়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় হোয়াটসঅ্যাপে। জন্ম নেয় এক বোধহীন বিভেদকামী সামগ্রিক উন্মাদনা, যা ক্ষতি করে দেশেরই। স্তব্ধ হয় শহিদের অসমাপ্ত কাজ। হয়তো বা পিছিয়ে যায় বহু দূর।
থেমে যাওয়া নয়, তাঁদের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি না কি আমরা? হলাম না-হয় সিভিলিয়ান, না-ই বা গেলাম যুদ্ধক্ষেত্রে। কিন্তু দেশের ভাল হোক, দেশবাসী ভাল থাকুন— এই বোধটুকু তো আমাদের সবার মনে। তাকেই হাতিয়ার করি না কেন?
পুলওয়ামায় লজ্জাজনক ঘটনার পর রব ওঠে, কাশ্মীর ও কাশ্মীরিদের বয়কট করার। দেশ জুড়ে চলতে থাকে কাশ্মীরিদের হেনস্থা। কেন এমন হয়? ‘‘কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ’’ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলি আমরা, যা রক্ষা করতে প্রাণ দেন শহিদ। বয়কটের ডাক তবে কেন?
এ বার কাশ্মীরিদের কথায় আসি। আদিল দার, বুরহান ওয়ানি (২০১৬ সালে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার মৃত্যুর পর উপত্যকা আরও অশান্ত হয়েছে) যেমন সত্য, তেমনি সত্যি এ বারে মরণোত্তর অশোকচক্রে ভূষিত ‘ইকওয়ান’ নাজ়ির আহমেদ ওয়ানি। খবরের কাগজে তাঁর বীরত্বের কথা পড়েছি। জেনেছি জঙ্গি নিকেশে তাঁর মরণপণ ভূমিকা। শুধু তা-ই নয়, তাঁদের পরিবারের অনেকেই আছেন সেনাবাহিনীতে, এ খবরও পাই। বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গির সঙ্গে ‘এমন’ ভারতীয় কাশ্মীরিরাও ছড়িয়ে আছেন উপত্যকা জুড়ে। ‘টাইট’ দেওয়া নয়, ভাল থাকুন প্রতিটি ভারতবাসী কাশ্মীরি, কেন চাইব না হৃদয় দিয়ে।
গৃহবধূ আমি, রোজকার চলার পথে কোথায় বা পাই তাঁদের? কিন্তু ওই যে প্রতি বছর নিয়ম করে আসা (দুটো পয়সা রোজগারের তাগিদে) আমার আপনার দরজায় কড়া-নাড়া পরিচিত কাশ্মীরি শালওয়ালাটি (এখন তো বকেয়া টাকা সংগ্রহ করে তাঁর ঘরে ফেরার পালা), কিংবা ভিনরাজ্যে পড়াতে আসা ভাড়াটে কাশ্মীরি যুবকটি, তাঁদের নিরাপত্তার দায়িত্ব তো আমাদেরই। রাজনৈতিক চাপানউতোর, কোন সরকারের কেমন নীতি কিচ্ছু বুঝি না, বুঝতে চাইও না। শুধু বুঝি, বিভেদকামী চক্রান্তের ফাঁদে পা দিয়ে দেশকে যেন আরও পিছিয়ে নিয়ে না যাই। শহিদের কাজ অসম্পূর্ণ না রাখি। একটিমাত্র ভারতবাসীও যদি বিনা দোষে আক্রান্ত হন, ভারতীয় হিসেবে এ লজ্জা আমার আপনার সবারই।
রীনা সেনগুপ্ত
কলকাতা-৯৪
বদলা নয়, কাজ
2 ফেসবুক, টিভি, খবরের কাগজ, রাস্তাঘাট, নেতাদের বক্তব্য সব কিছুতেই একটা ‘বদলা চাই/যুদ্ধ চাই’ গোছের মনোভাব চোখে পড়ছে। তাঁরা ঠিক কী চাইছেন? ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানের ভূখণ্ডে (পাক অধিকৃত কাশ্মীর) ঢুকে
টপাটপ জঙ্গি ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করে চলে আসবে আর সন্ত্রাসবাদ নির্মূল হয়ে যাবে? না কি আমাদের সেনাবাহিনী পাকিস্তান দখল করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে?
ব্যাপারটা কিন্তু এত সহজ নয়। ২০১৬ সালের সার্জিকাল স্ট্রাইকের পর কিন্তু অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি। পাকিস্তানের সঙ্গে ‘বদলা চাই, যুদ্ধ চাই’ বলে যাঁরা চেঁচাচ্ছেন, তাঁরা বোধ হয় জানেন না, দুটো পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে তার পরিণতি কী ভয়ঙ্কর হতে পারে।
এটা মেনে নিতেই হবে যে, এই সরকার কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ, জঙ্গিদমনে ব্যর্থ, এমনকি নিজের নিরাপত্তা বাহিনীকে নিরাপত্তা দিতেও ব্যর্থ। আগে নিরাপত্তার ফাঁকফোকর নিয়ে তদন্ত হোক, দেখা হোক আগাম খবর থাকা সত্ত্বেও কাদের গাফিলতিতে জঙ্গিরা এমন ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটাতে পারল।
দোষীরা শাস্তি পাক। হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করা হয় প্রতি বছর। সেই টাকাগুলো দিয়ে কী হয়? জওয়ানদের ভাল ভাবে থাকা, খাবার, ছুটি, বিনোদন— এই ব্যাপারগুলোও একটু দেখা হোক। তাঁরা নিজেরা যদি ভাল না থাকেন, উন্নত মানের কাজ করবেন কী ভাবে? নিরাপত্তার ফাঁকফোকরগুলো বন্ধ করা হোক এমন ভাবে, যাতে এত তাজা প্রাণ আর না যায়।
এর পাশাপাশি আমাদের দেশের গোয়েন্দা বাহিনীকে ঢেলে সাজানো হোক, আর আধুনিক জঙ্গিদমন বাহিনী তৈরি করা হোক, যাঁরা জঙ্গিদমনে সমর্থ হবেন। পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক ভাবে কোণঠাসা করে বাধ্য করা হোক জঙ্গিদের ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করতে।
এই মর্মান্তিক ঘটনার পর দেশ জুড়ে যে আবেগের জোয়ার বইছে, তা কাজে লাগিয়ে যেন কেউ ভোটের বৈতরণি পার হতে না পারে। যুদ্ধ হোক অবশ্যই, তবে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে।
আশিস রায়চৌধুরী
কলকাতা-৯৫
নিরাপত্তার ব্যবস্থা
পুলওয়ামায় যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটানো হল, তার নিন্দার কোনও ভাষা নেই। ৭৮টি গাড়ির একটা কনভয় যাবে, তার নিরাপত্তা ঠিক ভাবে নেওয়া হয়নি। প্রয়োজন ছিল আকাশপথে নজরদারির। এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে— এই চিন্তা যাঁদের মাথায় আসেনি, তাঁদের এ ধরনের কনভয় যাওয়ার নির্দেশ দেওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া উচিত। অনেক আগে খবর থাকা সত্ত্বেও কেন যথেষ্ট সতর্কতা নেওয়া হয়নি? এত বড় একটা কনভয় এ রকম উপদ্রুত এলাকায় চলাচল করবে— এ খবর জানাজানি হবেই। জঙ্গিরা তার সুযোগ নেবেই।
ত্রিদিব কান্তি মজুমদার
রাজবাড়ি পাড়া, জলপাইগুড়ি
অসভ্যতা কেন?
জঙ্গিবাদ সভ্যতাবিরোধী। কোনও সভ্য দেশ জঙ্গি কার্যকলাপ সমর্থন করতে পারে না। তাই কাশ্মীরে সেনাহত্যা নিঃসন্দেহে তীব্র ধিক্কারযোগ্য।
এর যোগ্য জবাব কী হতে পারে, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। জঙ্গি দমনের অনেক পথ খোলা আছে। রাষ্ট্র নিশ্চয়ই তা ভেবে দেখছে। কিন্তু দুর্ভাবনা জাগে অন্য ব্যাপার নিয়ে। জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের প্রধান উদ্দেশ্য বিশৃঙ্খলা তৈরি এবং শান্তির আবহ নষ্ট করা। এটা করতে তারা সক্ষমও হয়েছে। কিন্তু দেখছি, জঙ্গিবাদের সঙ্গে ইসলামের যোগস্থাপনের একটা চেষ্টা চলছে। জঙ্গিবাদ মানেই যেন মুসলমানী কর্মযজ্ঞ। ফলে ভারতের সব মুসলমানকেই বিশৃঙ্খলাকারী হিসেবে দেগে দেওয়ার মনোভাব তৈরি হয়েছে কিছু মহলে। এই মনোবৃত্তির কুপ্রভাব ভয়ঙ্কর হতে পারে। কারণ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস ক্ষুণ্ণ হলে, সেই রাষ্ট্রের আত্মাই মরে যায়।
একটি মোমবাতি মিছিল দেখলাম। মিছিলে যাঁরা হাঁটছেন, তাঁদের মুখের রেখায় মর্মবেদনার কাঠিন্য। নিশ্চয়ই তাঁদের কষ্ট বা শোক কোনও অংশেই অন্তঃসারশূন্য নয়। কিন্তু দেখলাম, তাঁরা একটি মুসলমান পাড়ায় এসে উচ্চৈঃস্বরে বার বার ‘পাকিস্তান মুর্দাবাদ’ স্লোগান তুললেন। এই স্লোগান এখানে তোলার অর্থ বুঝলাম না।
আমি সেই পাড়ায় এক মুসলিম বন্ধুর সঙ্গে উপস্থিত ছিলাম। সেই অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের নির্ঘোষে, এক জন হিন্দু হিসেবে আমি লজ্জা পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল, তাঁরা এই পাড়ায় একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে স্লোগানটি দিচ্ছিলেন। যেন, তাঁরা সমগ্র মুসলমান জাতিকে পাকিস্তানি ভেবে নিয়েছেন।
যে ঘটনা ঘটেছে, তার বিরুদ্ধে লড়তে হলে, সবার প্রথমে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে জাতিগত মন-কষাকষি শুরু হলে, আমাদের নিরাপত্তাই বিঘ্নিত হবে। প্রচার হোক সন্ত্রাসবিরোধিতার, প্রচার হোক মৈত্রীর। ‘পাকিস্তান মুর্দাবাদ’ স্লোগানটি শুধুমাত্র মুসলমানদের কানে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টটা অসভ্যতা।
প্রীতম বিশ্বাস
কলকাতা-১৩৩
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।