Uttarkashi Tunnel Collapse

সম্পাদক সমীপেষু: প্রকৃতির প্রতিস্পর্ধী

দেশের বর্তমান শাসক কোনও কিছু থেকেই শিক্ষা নিতে চান না। কোনও প্রশ্ন বা প্রস্তাবও তাঁরা সহ্য করতে অপারগ। সাংবাদিকরা সরকারের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৪:৪২
Share:

—ফাইল চিত্র।

সম্পাদকীয় ‘অক্ষমণীয়’ (২৮-১১)-তে যথার্থ ভাবেই বলা হয়েছে, কেন মন্দির নির্মাণে যা মনোযোগ, সুড়ঙ্গ নির্মাণে তার কিয়দংশও দেখা যায় না, এ-নিয়ে প্রশ্ন ওঠা দরকার। উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশী জেলার যমুনোত্রী জাতীয় সড়কে নির্মাণাধীন টানেল ভেঙে পড়ল ১২ নভেম্বর। ৪১ জন শ্রমিক সুড়ঙ্গের অন্ধকারে আটকে গেলেন। ১৫ দিন অতিক্রান্ত হল, তাঁদের উদ্ধারে নামেই ‘যুদ্ধকালীন তৎপরতা’— বাস্তবে কী দেখেছি?

Advertisement

দেশের বর্তমান শাসক কোনও কিছু থেকেই শিক্ষা নিতে চান না। কোনও প্রশ্ন বা প্রস্তাবও তাঁরা সহ্য করতে অপারগ। সাংবাদিকরা সরকারের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছেন। এই শাসক প্রকৃতির বিরুদ্ধেও কার্যত যুদ্ধে নেমেছেন। তার পরিণাম কী হতে পারে, তার সঙ্কেতও উপেক্ষিত হচ্ছে বার বার। শুধু একটার পর একটা বিজ্ঞানবহির্ভূত প্রকল্প। উপযুক্ত ভূতাত্ত্বিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাহীন অপরিকল্পিত উন্নয়নের পথে বাস্তুতন্ত্রের বারোটা বাজে বাজুক; প্রকল্পের পরিবেশগত ঝুঁকির ছাড়পত্রও প্রকাশ্যে না এনে চালু হয়ে যাচ্ছে নির্মাণকাজ। কারণ, তীর্থযাত্রা সহজতর করতে হবে। পরিবেশ রক্ষার চেয়ে তীর্থযাত্রাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে!

উত্তরকাশীর ব্রহ্মকাল-যমুনোত্রী জাতীয় সড়ক প্রকল্পটি শুরু থেকেই বিতর্কের কেন্দ্রে। তবুও সরকার চায়, এই ‘চার ধাম’ সড়ক প্রকল্পটিকে যে কোনও ভাবে রূপায়িত করতে। বাস্তুতন্ত্রকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ইতিমধ্যেই নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে ৫৬ হাজার গাছ, যেগুলো উত্তরাখণ্ডের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে রক্ষা করছিল জীব-বৈচিত্র। উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে অমরনাথ দুর্ঘটনায় গঠিত নীতীশ সেনগুপ্ত কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, তীর্থযাত্রার সর্বাধিক যাত্রী-সংখ্যা দৈনিক ৩,৪০০-তে সীমাবদ্ধ রাখা এবং যাত্রার সময় সর্বাধিক মাসখানেক ধার্য রাখা। অথচ, এই পথে ১২,০০০ পর্যন্ত যাত্রী চলেছেন বিনা বাধায়। আর সেই বিতর্কিত সড়ক প্রকল্পের জন্যই (যেটি ১১০ কিমি লম্বা) ৫,৩০০ কোটি টাকা মঞ্জুর হয়ে গেছে। অর্থাৎ, সেই ট্র্যাডিশন চলছে চলবে। আর মাসুল দেবে মানুষ হিমবাহ ফেটে, হড়পা বানে বা ভূমিধসের কবলে পড়ে; সুন্দর প্রকৃতি ধ্বংস হয় হোক, তাতে কী! শুধু প্রতীক্ষার প্রহর গোনা। এ-হেন আত্মঘাতী প্রবণতার ফলে আর যে কত ভাবে শেষ হয়ে যাবে জীবকুল, তার ঠিক নেই।

Advertisement

অথচ, যে-সব প্রকল্প জনতার কল্যাণসাধন করতে পারে, সে-দিকে সরকারের নজর নেই। মহাপ্রস্থানের পথে মানুষকে ঠেলে দিলেই যেন জনগণের মুক্তি। সেই ধারা মেনেই গত বছর উত্তরাখণ্ডে তীর্থযাত্রী এবং পর্যটকদের সংখ্যা রেকর্ড ভেঙে হয়েছিল ১০ কোটি!

সবুজ সান্যাল, ধাড়সা, হাওড়া

অসুরক্ষিত

সম্পাদকীয় ‘অক্ষমণীয়’ প্রকাশের দিনেই উত্তরাখণ্ডে সুড়ঙ্গে আটকে পড়া ৪১ জন শ্রমিককে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। নিঃসন্দেহে প্রত্যেক দেশবাসীর কাছে এটা একটা আনন্দের খবর। উদ্ধারকারী দল (র‌্যাট মাইনার) জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ‘জন হেনরি’র মতো পাথরের গায়ে হাতুড়ি চালিয়ে মাটির নীচে আটকে পড়া শ্রমিকদের উদ্ধার করলেন। হাতুড়ির সঙ্গে মেশিনের লড়াইয়ে জয় হল হাতুড়ির। যে শ্রমিকরা এ কাজ করলেন, তাঁদের জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। তাঁরা আজ দেশবাসীর চোখে প্রকৃত নায়ক।

প্রায় ৪২০ ঘণ্টা ধরে মাটির গভীরে আটকে পড়া ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের ৪১ জন শ্রমিককে উদ্ধারের জন্য যে তৎপরতা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের তরফ থেকে দেখানো হয়েছে, তার ছিটেফোঁটাও যদি শ্রমিকদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে দেখানো হত, তবে হয়তো এই ভয়ঙ্কর অবস্থার সম্মুখীন শ্রমিকদের হতে হত না। উন্নত বিশ্বের শ্রমিকরা যে সুরক্ষা বলয়ে কাজ করেন, তার বিন্দুমাত্র সুরক্ষা আমাদের দেশে শ্রমিকরা পান না। সবচেয়ে করুণ অবস্থা নির্মাণ শ্রমিকদের, কারণ এঁরা বেশির ভাগই লেবার কন্ট্রাক্টরের অধীনে কাজ করেন। ফলে, এঁদের দায়-দায়িত্ব কোনওটাই নির্মাণ সংস্থার নয়। সম্পাদকীয়তে যথার্থই উল্লেখ করা হয়েছে যে, শ্রমিকদের নিরাপত্তার প্রশ্নে হিমালয়-প্রমাণ অবজ্ঞার বিপরীতে শ্রমিক সংগঠনগুলোর ভূমিকাও আজ প্রশ্নের মুখে। উন্নয়নের যজ্ঞে শ্রমিকদের ‘বলিপ্রদত্ত’ করার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শ্রমিক সংগঠনগুলোর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা এই ঘটনা আরও এক বার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।

শেষাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়, ভদ্রেশ্বর, হুগলি

শ্রমিকের মূল্য

শেষ পর্যন্ত ভারতবাসীর টানটান উত্তেজনার অবসান ঘটল। আলোর উৎসব দীপাবলির দিনে যাঁদের আঙিনায় অন্ধকারের ছায়া নেমে এসেছিল, সেই ৪১টি পরিবারের বাড়িতে আসল দীপাবলি উদ্‌যাপনের সুযোগ এল ২৮ নভেম্বর রাতে। সিল্কিয়ারা টানেলের ভিতরে আটকে পড়া শ্রমিকদের নিরাপদে বেরিয়ে আসার জন্য পুরো দেশ যে ভাবে প্রার্থনা করছিল, তার ফল মিলেছে। ভারতের ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথম বার সাধারণ শ্রমিকদের বাঁচাতে এত বড় ত্রাণ অভিযান চালানো হয়। যার প্রতি পদে প্রতিবন্ধকতা ছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় ও উত্তরাখণ্ড সরকারের সতর্কতা এবং তৎপরতা ফল দিয়েছে। দুর্ঘটনার ১৭তম দিনে, সমস্ত শ্রমিক নিরাপদে বেরিয়ে এসেছেন। বেশ কয়েকটি কেন্দ্রীয় মন্ত্রক, উদ্ধারকাজে নিয়োজিত ত্রাণ সংস্থা, সেনা, বিমান বাহিনী, বিআরও এবং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের ঐক্যবদ্ধ অভিযানের জন্য এটা সম্ভব হয়েছে। ভারত সারা বিশ্বকে এই বার্তা দিতে সফল হয়েছে যে, তার কাছে প্রতিটি নাগরিকের জীবন মূল্যবান। নিঃসন্দেহে, এই প্রচারাভিযান কোটি কোটি শ্রমিকের মনোবল বাড়াবে।

সেই সব কর্মীর মনোবলের প্রশংসা করতে হবে যাঁরা ১৭ দিন ভয়ানক পরিস্থিতিতে ধৈর্য হারাননি। এত দীর্ঘ উদ্ধার অভিযানে অনেকেই গভীর হতাশায় পতিত হতে পারতেন। কিন্তু আটকে পড়া শ্রমিকদের জন্য সময়মতো বাতাস, জল, বিদ্যুৎ ও খাবারের ব্যবস্থা তাঁদের মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছে এই দেশ। এই ঘটনাবলির আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, এই পার্বত্য রাজ্যে ঘটে চলা পরিকাঠামো প্রকল্প। এই টানেলটি বহুল আলোচিত চারধাম হাইওয়ে প্রকল্পের অংশ। এই প্রকল্প নিয়ে আগেই প্রশ্ন ওঠে এবং বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে যায়। সেই সময় সরকার সুপ্রিম কোর্টে যুক্তি দিয়েছিল যে, দেশের প্রতিরক্ষা স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রকল্পটি প্রয়োজন। এর ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট থেকেও প্রকল্পটি অনুমোদন পেয়েছে। এটাও সত্য যে, দেশের প্রতিরক্ষা স্বার্থের সঙ্গে আপস করা যাবে না। তবে মনে রাখতে হবে যে, পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা হিমালয় অঞ্চলে নতুন নির্মাণের বিরুদ্ধে সতর্ক করে আসছেন। জোশীমঠে জমি তলিয়ে যাওয়ার সময়ও বলা হয়েছিল, কিছু প্রকল্পের কারণে জমি তলিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে। হিমাচলপ্রদেশ নিয়েও একই প্রশ্ন উঠেছে। উদ্বেগের বিষয় হল, বিশেষজ্ঞদের এই ধরনের সমস্ত সুপারিশ কিছু সময় পরিত্যক্ত হয়ে যায়। আজও সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল পাহাড়ের বিশেষ চাহিদা বোঝা এবং সেখানে উন্নয়নের জন্য একটি নতুন কাঠামো নির্ধারণ করা।

তবে সিল্কিয়ারা টানেলে ধস এবং পরবর্তী কালে উদ্ধার অভিযানে বাধা আমাদের অনেক শিক্ষা দিয়েছে। এ ধরনের টানেল নির্মাণের আগে ভূমিধসের সম্ভাবনা এবং পাহাড়ের ধারণক্ষমতা বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে। টানেলের ভিতরে ধস নামলে ত্রাণ কাজের বিকল্প ব্যবস্থা থাকতে হবে। উপর থেকে পড়ে যাওয়া ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরে যে মোটা পাইপের মাধ্যমে শ্রমিকদের সরিয়ে নেওয়া হয়, সেগুলি বাধ্যতামূলক ভাবে নির্মাণাধীন টানেলের পাশে স্থাপন করা উচিত। কেদারনাথ ট্র্যাজেডি, হিমাচলের বর্ষার বিপর্যয়, সিকিমে সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথা মাথায় রেখে বড় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত।

অভিজিৎ রায়, জামশেদপুর, ঝাড়খণ্ড

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন