Regional Language

সম্পাদক সমীপেষু: অবিরাম বিনিময়

এর জন্য আমরাও কি দায়ী নই? আমরাই যে বাংলা বলতে লজ্জা পাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৫:৪১
Share:

সোনালী দত্তের ‘সামোসা বলব শিঙাড়ার বদলে?’ (১২-২) অনবদ্য। সত্যিই তো, আমরা বলতেই পারি, “আমরা যেমন ‘সামোসা’ শিখেছি, আপনিও ‘শিঙাড়া’ শিখে দেখুন। ভাল লাগবে।” এর মধ্যে আঞ্চলিকতাবাদের কিছু নেই। রয়েছে নিজের ভাষার প্রতি ভালবাসা। মাতৃভাষার প্রতি ভালবাসা জাগ্রত হলে পৃথিবীর কোনও ভাষার অপমৃত্যু ঘটবে না। ভাষার হাত ধরে নিজ নিজ সংস্কৃতি আবার ডানা মেলবে। ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যই হল ‘নানা ভাষা নানা মত’। দুর্ভাগ্যের বিষয়, কিছু লোক ভাষা-সাম্রাজ্য বিস্তার করতে গিয়ে অন্য ভাষার ব্যবহার সঙ্কীর্ণ করে তুলছে।

Advertisement

এর জন্য আমরাও কি দায়ী নই? আমরাই যে বাংলা বলতে লজ্জা পাই। ২০১২ সাল। ক্যানসার-আক্রান্ত মা’কে নিয়ে মুম্বইয়ের একটি হাসপাতালে যাই। আমি মরাঠি বা হিন্দি বলতে পারি না। ইংরেজি আর ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে কথা বলছিলাম। ডাক্তারবাবু হাসতে হাসতে বললেন, “হিন্দি বা মরাঠিটা একটু শিখবেন।” আমি ওই ভুল হিন্দিতেই বললাম, “ডাক্তারবাবু, বাংলা কিন্তু পৃথিবীর প্রথম পাঁচটি ভাষার অন্যতম। আপনি বাংলা জানলে টেগোরকে খুব ভাল ভাবে জানতে পারবেন।” না, তিনি রাগ করেননি। বরং বলেছিলেন, টেগোরকে জানার জন্য তিনি সুযোগ পেলে বাংলা শিখবেন।

লকডাউন পরিস্থিতিতে অশোকনগরে একটি অ্যাকাডেমির ১১ জন ফুটবলার গৃহবন্দি হয়ে যান, যাঁরা সুদূর ঘানা থেকে এসেছেন। আমরা প্রায় সাড়ে তিন মাস তাঁদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করি। তাঁরা ইংরেজি জানেন। আর জানেন তাঁদের মাতৃভাষা ‘চি’। আমাদের টিমের সদস্যরা তাঁদের কিছু বাংলা শিখিয়ে দিয়েছিল। তাঁরা রীতিমতো আমাদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলতে শুরু করেন। আমি ‘চি’ শিখতে পারিনি। কিন্তু জোসেফরা বাংলা শিখেছেন। দেখা হলে এখনও বলেন, ‘ভাল্লো আছেন?’ বা ‘কেমোন আছেন?’

Advertisement

সারা বছর ভাষার জন্য কিছু না ভেবে ২১ ফেব্রুয়ারি এলেই বিপ্লবী হয়ে যাই। ভাষার জন্য ‘জানতক কোরবানি’ দিতে তৈরি হই। এটা লোক-দেখানো। দরকার নিরন্তর চর্চা।

সফিয়ার রহমান, অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা

ভাষাকন্যা

ভাষাগত স্বাতন্ত্র্য চেতনা থেকেই বাঙালি জাতিসত্তার প্রথম প্রকাশ। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে গণ-আন্দোলন শুরু হয়। যদিও ভাষা আন্দোলনের সূচনা ১৯৪৮ থেকেই। এই আন্দোলনে সহযোদ্ধা ছিলেন মেয়েরাও। মহিলাদের মুখপত্র বেগম পত্রিকায় বেগম আফসারুন্নেসা লেখেন, “...আজ রাষ্ট্রভাষা নির্বাচনের অধিকার পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের— যারা মুসলমান অথচ বাঙ্গালী” (ভাষা-আন্দোলন ও নারী, মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির)। ১৯৪৮ সালে গঠিত ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’-এর সদস্য ছিলেন আনোয়ারা খাতুন ও লিলি খান। ১৯৪৮ সালের আন্দোলনে নাদিরা বেগম ছাত্রীদের নেতৃত্ব দানের জন্য কারাবন্দি হয়ে অকথ্য নির্যাতন সহ্য করেন। রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন রওশন আরা বাচ্চু। ‘মেয়েদের রাজনীতিতে যোগ দেওয়া উচিত’— শিরোনামে তিনি রেডিয়ো পাকিস্তানে বক্তব্য রাখেন।

২৭ জানুয়ারি ১৯৫২। ঘোষণা হল, উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে তিন দিন পালিত হয় কালো পতাকা দিবস। ছাত্রীরা সব বাধা অতিক্রম করে আন্দোলনে শামিল হন। রওশান আরা বাচ্চুর স্মৃতিচারণে জানা যায়, সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬০-৭০ জন ছাত্রী ছিল, কলা ও বিজ্ঞান বিভাগ মিলিয়ে। মেয়েদের মাথায় ঘোমটা অথবা বোরখা পরা থাকত। ছেলেদের সঙ্গে কথা বলা নিষেধ ছিল। কেউ কথা বললে তার কাছ থেকে ১০ টাকা জরিমানা নেওয়া হত। মেয়েরা কমনরুমে অপেক্ষা করতেন। ক্লাসে যাওয়ার সময় ডেকে নিতেন শিক্ষক।

এই সব বিধান ভেঙে ছাত্রীরা আন্দোলন করেন ছাত্রদের পাশে থেকে। হস্টেল কর্তৃপক্ষের বার করে দেওয়ার হুমকি, অভিভাবকদের পড়া ছাড়ানোর ভয় দেখানো, কোনও কিছুতেই দমানো যায়নি। (তুষার আব্দুল্লাহ সম্পাদিত বাহান্নর ভাষাকন্যা) ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা দূর-দূরান্তের স্কুল, কলেজ থেকে ছাত্রীদের সংগঠিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা প্রাঙ্গণে নিয়ে আসেন। ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল বার হয়। মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন সুফিয়া ইব্রাহিম, শামসুন্নাহার, সারা তৈফুর, শাফিয়া খাতুন, রওশন আরা বাচ্চু। প্রথমে লাঠি চার্জ, কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়। এই দমন-পীড়নের মধ্যেই মিছিল এগিয়ে যাচ্ছিল বাংলা ভাষার দাবি নিয়ে, পূর্ববঙ্গের আইন পরিষদের দিকে। কিন্তু বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ শুরু হয় পুলিশের গুলি চালানো। লাঠি চার্জে অনেক ছাত্রী আহত হন। নারায়ণগঞ্জের শিক্ষিকা মমতাজ বেগম কারাবন্দি হন। বন্ড সই করে মুক্তি চাননি বলে তাঁর স্বামী মমতাজকে তালাক দেন। ইলা বক্সী, বেণু ধর-সহ বহু ছাত্রী কারারুদ্ধ হন।

হস্টেল কর্তৃপক্ষ মেয়েদের বাইরে বেরোনোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ছাত্রীরা তখন ইট সাজিয়ে উঁচু প্রাচীরে উঠে, প্রাচীর টপকে বেরিয়ে পড়েছেন। ছাত্রদের সলিমুল্লা হল পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। ছাত্রীরা পুলিশের চোখ এড়িয়ে গোপনে খাবার পৌঁছে দিয়ে যেতেন। আন্দোলনের ব্যয় বহন করার ভারও মেয়েরা তুলে নিয়েছিলেন।

২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নানা বাধা অতিক্রম করে ভাষা-সৈনিকরা আন্দোলন চালিয়েছেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে সরকার পক্ষের দমন-পীড়নের মাত্রা তীব্র হয়ে ওঠে। ২৭ ফেব্রুয়ারি অনির্দিষ্ট কালের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। হস্টেল ফাঁকা করে দেওয়ার নির্দেশ আসে। সংগ্রামী কর্মীদের বিচ্ছিন্ন করে সাময়িক ভাবে আন্দোলনকে কিছুটা দমন করতে পারলেও, লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত লড়াই জারি ছিল। এবং লড়াইয়ে সক্রিয় থেকে ভাষা-সৈনিক মেয়েরাও শাসকের রক্তচোখ উপেক্ষা করেছেন। জয়লাভের গৌরবে উত্তরসূরিদের প্রণম্য হয়েছেন, ছেলেদের সঙ্গে সমান ভাবে।

আফরোজা খাতুন, শিক্ষক, সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ফর উইমেন

তিন দশক

আমেরিকায় প্রবাসী বাঙালিরা ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপুঞ্জের সামনে অস্থায়ী শহিদ মিনার নির্মাণ করে ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন ১৯৯২ সাল থেকে। প্রথম বছরের কথা আজও স্মৃতিতে উজ্জ্বল। জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই শুরু হয় ঢাকার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের আদলে অস্থায়ী শহিদ মিনার নির্মাণের প্রক্রিয়া। তার জন্য স্প্যানিশ কার্পেন্টার আনা হল, হোম ডিপো থেকে কাঠ। রাষ্ট্রপুঞ্জের সামনে অস্থায়ী সৌধ স্থাপনের অনুমোদন নিয়ে সংশয় ছিল। তা-ও পাওয়া গেল ১৬ ফেব্রুয়ারি। শিল্পী সজল পাল, হারুন আলি, আবদুর রহমান বাদশা, ছাখাওয়াৎ আলি, দিলদার হোসেন দিলু, শামীম হোসেন-সহ আমরা অনেকে মিনারের আকৃতির সৌধ মোটামুটি দাঁড় করালাম। প্রচণ্ড বরফের মধ্যে রাত ১১টা থেকে নিউ ইয়র্কের বিশিষ্ট বাঙালিরা আসেন শ্রদ্ধানিবেদন করতে। সমবেত কণ্ঠে একুশের গান পরিবেশন করা হয়। পরবর্তী ২৯ বছরে ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন, একুশের গানের রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, কবি শহীদ কাদরী, নির্মলেন্দু গুণ, সৈয়দ শামসুল হক, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়-সহ অনেক গুণী ব্যক্তি এই মিনারে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। ১৯৯৬ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রস্তাবক মোহাম্মদ রফিক কানাডা থেকে আসেন শ্রদ্ধা জানাতে। ১৯৯৯ সালে তাঁরই প্রস্তাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি অর্জনের পর, ২০০০ সাল থেকে রাষ্ট্রপুঞ্জের সম্মুখের এই অনুষ্ঠানে যুক্ত হন ইউনেস্কো ও রাষ্ট্রপুঞ্জের কর্মকর্তারা।

ত্রিশ বছর আগে কয়েক জন তরুণ যে পরিকল্পনা করেন, আজ তা একটি আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান। একটি নিয়মের ব্যত্যয় আজ অবধি ঘটেনি। তা হল, উপস্থিত সর্বকনিষ্ঠ শিশুটির হাতের ফুল সর্বপ্রথম দিয়ে শহিদদের শ্রদ্ধা জানানোর রীতি।

বিশ্বজিৎ সাহা, নিউ ইয়র্ক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন