—প্রতীকী চিত্র।
আকাশ বিশ্বাসের ‘সমস্যা ধ্বনিরূপ নিয়েই’ (৩১-১) প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। যে বানানবিধি চালু করার চেষ্টা সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, তা জোর করে চালু করলে বাংলা ভাষার কী উপকার হবে? যত বড় মাপের মানুষই এই চেষ্টা করে থাকুন না কেন, একই প্রশ্ন উঠবে।
সংবাদপত্রে Z-এর উচ্চারণ বোঝাতে শব্দের বানানে জ-এর নীচে বিন্দু (জ়) ব্যবহার করা হচ্ছে। এখানে যে যুক্তির কথা বলা হচ্ছে তা হল, কম্পিউটার ও মোবাইলে বানানটা লেখা যায়। তাই প্রবন্ধকারের আরও সুপারিশ উচ্চারণের স্বার্থে চ, ছ-এর ক্ষেত্রে এই রীতির প্রয়োগ উচিত কি না, তা ভেবে দেখা দরকার। ভাষা গবেষকগণ বিষয়টি হয়তো ভেবে দেখবেন। তবে এ ক্ষেত্রেও প্রশ্ন, এর দ্বারা কি বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ এবং সাবলীল হবে? না কি আরও জটিল হয়ে উঠবে?
প্রবন্ধকার উল্লেখ করেছেন যে, ‘কেন’, ‘দেখ’ প্রভৃতি শব্দে আজ ‘অ্যা’ ধ্বনির কোনও মান্য রীতি নেই। রবীন্দ্রনাথ ‘অ্যা’ উচ্চারণ বোঝাতে মাত্রা সমেত এ-কার ব্যবহারের রীতি চালু করতে চেয়েছিলেন, সেই চেষ্টাও সফল হয়নি। অগণিত মানুষ লেখেন ‘বেলা’ ‘খেলা’ ‘মেলা’ কিন্তু উচ্চারণ করেন ‘ব্যালা’, ‘খ্যালা’, ‘ম্যালা’। এ সব ক্ষেত্রে মাত্রা সমেত এ-কার কেউ ব্যবহার করেন না। প্রবন্ধকার বলেছেন, এগুলো ‘স্বাভাবিক’ উচ্চারণ। তা হলে অন্যগুলো কি অস্বাভাবিক উচ্চারণ?
আবার এই ‘অ্যা’ ধ্বনিকে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা হয় ‘এ’ দিয়ে। যেমন ‘মণ্ডল এণ্ড ব্রাদার্স’, ‘হালদার এণ্ড সন্স’, ইত্যাদি।
প্রবন্ধকার আক্ষেপ করেছেন এই বলে যে, রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টাকেও বাঙালি গ্রহণ করল না। রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষায় অজস্র নতুন শব্দ সৃষ্টি করেছেন। নানা ভাবে তিনি বাংলা ভাষাকে ঋদ্ধ করেছেন। তাঁকে অবহেলা করার ধৃষ্টতা কোনও বাঙালির নেই। তবে এ-কারের তারতম্যের বিষয়টি বেশ জটিল বলেই হয়তো বাঙালি তা সে ভাবে গ্রহণ করেনি।
সব শেষে প্রবন্ধকারের সঙ্গে আমরাও আশা করছি বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে তেমন সাহসী মানুষজনের আগমন ঘটুক, যাঁরা বানানকে দিয়ে উচ্চারণের সত্যরক্ষা করবেন।
দিলীপ কুমার বৈদ্য, মন্দিরবাজার, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
মধুসূদনের পথ
জন্মের দ্বিশতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাব্যকে বিজেপির হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিতে চেয়েছেন সুবোধ সরকার তাঁর প্রবন্ধ ‘রেখো মা দাসেরে মনে’ (২৪-১)-তে। কিন্তু কিছু জায়গায় যা লিখেছেন, তাতে বিভ্রান্ত হচ্ছি। প্রবন্ধে আছে, তখনকার কবিতা, পাঁচালি, খেউড় ইত্যাদি ‘গ্রামীণ মহার্ঘভাতা’ অগ্রাহ্য করে বাংলায় ভার্জিল, খিদিরপুরে দান্তে, কলেজ স্ট্রিটে মিল্টন প্রবেশ করলেন। সবিনয়ে বলি, ভারতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতা সাধারণ ভাবে কাউকে অগ্রাহ্য করেনি, বরং ‘দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে’-র আদর্শে তাদের আত্মস্থ করেছে। মধুসূদন এই পথের পথিক। সংস্কৃত-মাগধী সমৃদ্ধ বাংলা মঙ্গলকাব্য থেকে পাঁচালি, কথকতা, বাউল, লোকগীতি, পল্লিগীতি ইত্যাদির সুর ও স্বর আত্মস্থ এবং জারিত করেছেন মধুসূদন দত্ত, তাঁর সহায়ক পণ্ডিতদের মাধ্যমে। যতই গ্রাম্য হোক, এখানেই ভারতীয় সভ্যতার শিকড়।
খিদিরপুর-মেটিয়াবুরুজে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ ১৮৫৬ সালে এসে এক অসাধারণ মিশ্র ও ভারতীয় সংস্কৃতি নির্মাণ করেছিলেন, যা নিয়ে আজও গবেষণা চলেছে। মধুসূদন ১৮৬০-৬২ সালে বাংলা সাহিত্যে তাঁর প্রধান কাব্য সৃষ্টি করেছেন। এতে ‘খিদিরপুর’-এ হিন্দু-মুসলিম সাহিত্য-সংস্কৃতির কোনও ক্ষতি হয়নি। কলেজ স্ট্রিটে ডিরোজ়িয়ো হিন্দু কলেজে ইংরেজি সাহিত্য পড়িয়েছেন। এতে বরং বাংলার নবজাগরণে প্রাচ্য-প্রতীচ্য-পাশ্চাত্যের মহামিলন হয়েছে। মধুসূদন খ্রিস্টান হয়েছেন অনেকটাই ইউরোপিয়ান সাহিত্যচর্চার হিরে-মানিকের নাগাল পেতে। সাধারণ বাঙালি সমাজে তাঁর জীবনশৈলী, ধর্মাচরণ, শিক্ষা, বন্ধুত্ব— কোনও জায়গায় তিনি নিজেকে মৌলবাদী ধর্মসঙ্কটে ফেলেননি। বরং তাঁর সাহিত্যচর্চা ছিল অনেকটাই ধর্মনিরপেক্ষ। খামোকা খ্রিস্টান মধুসূদনকে এ ভাবে হিন্দুধর্মের প্রতিপক্ষ করে বরং তাঁর অবমূল্যায়ন হল।
প্রবন্ধে উল্লিখিত, মাইকেল তাঁর বন্ধুকে লিখেছেন, ‘আই হেট রাম অ্যান্ড হিজ় রাবল্’। তা হিন্দু ধর্মের জন্য নয়, অনেকটাই ক্ষত্রিয় ধর্মের জন্য। সেই মাইকেল ‘বাঘের বাচ্চা’ কেন হতে যাবেন, তিনি তো আদ্যোপান্ত এক জন বিশেষ ব্যতিক্রমী, সাহসী ‘মানুষ’। প্রবন্ধে বলা হয়েছে, “মাইকেল রামকে ‘হিরো’ না করে রাবণকে ‘হিরো’ বানিয়ে অ্যারিস্টটলের থুতনি নেড়ে দিয়ে ‘স্পর্ধা’কে ক্লাসিক্যাল করে তুলেছিলেন, তাকে দেখিয়ে আমরা বলব, ভিতরে বসে রয়েছে একটি আধুনিক রামমন্দির। হিন্দুত্বের গর্ভগৃহ।”
প্রথমত হিন্দুত্ব, যা ভৌগোলিক দেশকাল কেন্দ্রিক জীবনশৈলী, আর হিন্দুধর্ম এক নয়। বাবরি মসজিদ ভেঙে তার উপর গড়ে ওঠা রামমন্দিরে ‘পরধর্ম ভয়াবহ’ মতের প্রতিফলন। মতান্তর আছে ‘অ্যারিস্টটলের থুতনি নেড়ে দেওয়া’ বিষয়টি নিয়েও। শিশিরকুমার দাশের গ্রন্থে ভূমিকায় (কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল) লিখেছেন, বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষে, গ্রিক সাহিত্যের সর্বপ্রথম রসজ্ঞ ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। হোমারের মহাকাব্যের আদর্শে রচনা করেছিলেন তাঁর মহাকাব্য। রামায়ণ-মহাভারত, কালিদাসের কাব্য পড়া সত্ত্বেও তিনি ইলিয়াস-রচয়িতা কবিকে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করেছিলেন। মধুসূদন দৈব প্রভাব বা ভক্তিরসকে বীররসের নীচে স্থান দিয়েছেন। এতেই ‘অ্যরিস্টটলের থুতনি’ নড়ে গেল?
রামমন্দিরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে মধুসূদন দত্তকে অস্ত্র করলে সে অস্ত্র পশ্চিমবঙ্গে সমাপতিত গীতাপাঠ, চণ্ডীপাঠের বিরুদ্ধে যায়। এই ব্যাপারটিতে নীরব থেকে কী বলতে চেয়েছেন প্রবন্ধকার?
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি
অপ্রাসঙ্গিক
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যের অপূর্ব ও আশ্চর্য সমন্বয়ে সৃষ্ট রচনা মধুসূদন দত্তকে অমরত্ব দান করেছে। বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম আধুনিক কবি। পয়ার ভেঙে অবতারণা করেছিলেন অমিত্রাক্ষর ছন্দের। তাঁর হাতে নাট্যসাহিত্যেও পাশ্চাত্য রীতির প্রতিষ্ঠা ঘটে। কৃষ্ণকুমারী-র মতো প্রথম উল্লেখযোগ্য ট্র্যাজেডি বা ঐতিহাসিক নাটক তিনিই লেখেন। বর্জন করেন মানবতাবিরোধী ঐতিহ্য। তাঁর মেঘনাদবধ কাব্যের প্রকরণ, চরিত্র-চিত্রণ, ভাব-কল্পনায় প্রকটিত হয়েছে নবযুগের জীবনবোধ, যা তাঁর ব্যক্তিত্বেরই প্রকাশ। মেঘনাদবধ রচিত হলে ১৮৬১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কালীপ্রসন্ন সিংহের বিদ্যোৎসাহিনী সভা কর্তৃক প্রদত্ত মানপত্রে লেখা হয়, “আপনা হইতে একটি নূতন সাহিত্য বাঙ্গালা ভাষায় আবিষ্কৃত হইল, তজ্জন্য আমরা আপনাকে সহস্রবার ধন্যবাদের সহিত বিদ্যোৎসাহিনী সভ্য সংস্থাপক প্রদত্ত রৌপ্যময় পাত্র প্রদান করিতেছি।”
আসলে ইউরোপীয় মানবতাবাদী শিক্ষা ও চিন্তা-চেতনার বন্ধনমুক্তি মধুসূদনকে বাংলা ভাষায় কীর্তিস্থাপনে সহায়তা করেছিল। তাঁর প্রয়াণকালে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে বঙ্কিমচন্দ্র তো লিখেই ছিলেন, “...কাল প্রসন্ন— ইউরোপ সহায়— সুপবন বহিতেছে দেখিয়া, জাতীয় পতাকা উড়াইয়া দাও— তাহাতে নাম লেখ ‘শ্রীমধুসূদন’”(বঙ্গদর্শন, ১২৮০ ভাদ্র)। কাজেই আজ তাঁর জয়ধ্বজা ওড়ানোর জন্য রামমন্দির নির্মাণের প্রসঙ্গকে টেনে আনার দরকার আছে বলে মনে হয় না। প্রবন্ধকার লিখেছেন, “মাইকেল রামকে কোনও মন্দির বানিয়ে দেননি। তাতে রামের এক চুলও ক্ষতি হয়নি।” মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম দ্বিশতবর্ষের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনে এ কথা আজ অপ্রাসঙ্গিক বলেই মনে হয়।
সুদেব মাল, খরসরাই, হুগলি