শম্পা ভট্টাচার্যের ‘সঙের গানেই ধরা পড়ত সমাজের অসঙ্গতি’ (রবিবাসরীয়, ১৬-৫) নিবন্ধে কেন জানি না, চুঁচুড়ার বিখ্যাত সঙ বাদ গিয়েছে। চুঁচুড়ায় বারোয়ারি পুজো উপলক্ষে সঙ বার হত। অর্থাৎ, ব্রাহ্মণ্য প্রথা মেনে দুর্গাপুজো হল। আবার এই সুযোগে অব্রাহ্মণ, যাঁরা এই শাস্ত্রীয় প্রথার ঘরানার বাইরে, তাঁরা পুজোর শেষে বাহিরিয়ানায় আনন্দে মাতলেন। ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণ, দু’পক্ষ দু’ভাবে উৎসবকে দেখলেন, নিলেন ও প্রকাশ করলেন।
প্রসঙ্গত, চুঁচুড়া কলকাতার থেকেও প্রাচীন। তাই কৌম সংস্কৃতির ইতিহাসও সুপ্রাচীন। কালীপ্রসন্ন সিংহ, অমৃতলাল বসু গুরুত্ব সহকারে চুঁচুড়ার সঙের উল্লেখ করেছেন। যেমন, “পূর্ব্বে চুঁচড়োর মত বারোইয়ারি পূজো আর কোথাও হত না, ‘আচাভো’, ‘বোম্বা চাক’ প্রভৃতি সং প্রস্তুত হত; শহরের নানা স্থানের বাবুরা বোট, বজরা, পিনেস ও ভাউলে ভাড়া করে সং দেখতে যেতেন; লোকের এত জনতা হত যে, কলাপাত এক টাকায় একখানি বিক্রি হয়েছিল, চোরেরা আন্ডিল হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু গরিব দুঃখী গেরস্তোর হাঁড়ি চড়েনি।” কিংবা “চুঁচড়োর সঙ আমার কেবল দ্যায়লা করছেন।”
এই সঙের সূত্রে গানের কথাও আসে। চুঁচুড়ার সঙের বিখ্যাত গায়ক ছিলেন রূপচাঁদ পক্ষী। তিনি গানের কথা লিখতেন, সুর দিতেন এবং তান-লয়’সহ গান গাইতেন। গানের কথা একেবারেই স্বতন্ত্র, শুনলেই নেশা ধরে যায়— ‘গুলি হাড়কালি মা কালীর মতো রঙ। টানলে ছিটে বেচায় ভিটে যেন চুঁচড়োর সঙ।’ এতটাই বিখ্যাত এখানকার সঙ যে প্রবাদেও পরিণত হয়েছে— “গুলিখোরের কিবা ঢঙ্, দেখতে যেন চুঁচড়োর সঙ।”
এই সঙ চুঁচুড়ার পাশের শহর চন্দননগরে বিখ্যাত জগদ্ধাত্রী পুজোতেও দেখা যেত। সন্ধ্যা বা রাতের দিকে জগদ্ধাত্রী পুজোর শোভাযাত্রায় প্রথম দিকে মশাল, পরে গ্যাসলাইট, হ্যাজাকের আলোয় এই সঙের আকর্ষণে বাইরে থেকে বহু মানুষ আসতেন। এই সব সঙের গানে প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ, রসিকতা ছিল অবশ্যই, তবে তা ‘সমাজের অসঙ্গতি’ হবে কেন? সবাইকে নিয়ে সমাজ। বহুমাত্রিক বৈচিত্রেই তো সমাজের বিকাশ। রঙ্গতামাশার মধ্যে দিয়ে তার সমন্বয়ই ছিল সঙের জীবন।
শুভ্রাংশু কুমার রায়
ফটকগোড়া, হুগলি
বহুরূপীর দিন
শম্পা ভট্টাচার্যের ‘সঙের গানেই ধরা পড়ত সমাজের অসঙ্গতি’ প্রসঙ্গে এই চিঠি। ছোটবেলায় দেখেছি, পূজাপার্বণ কিংবা উৎসব-অনুষ্ঠান উপলক্ষে সঙেরা নানা রকম পছন্দের সাজ সেজে পাড়ায় এসে হাজির হত। অঙ্গভঙ্গি ও কথার মাধ্যমে মানুষকে আনন্দিত করত। পাড়ার ক্লাবে এবং স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পর থাকত ‘রূপায়ণ’ প্রতিযোগিতা। অনেকেই পোশাক ভাড়া করে এনে সঙ সাজত। আমরা অনেকে খেপাতাম, কারণ কিছু ক্ষণ আগে যাকে দেখলাম সাধারণ পোশাকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, হঠাৎ দেখি ডাকাত সেজে সকলের সামনে হাজির। আবার কাউকে দেখতাম, সাধু সেজে হাত দেখে বলছে, কার বিয়ে হয়নি, আবার বড়দের বলত কার ক’টা ছেলে বা মেয়ে হবে। হো হো করে হাসির জোয়ার বইত সকলের মধ্যে। মনে পড়ে, প্রতি বছর দোলের দিন সকালে মহাদেব, দুর্গা, রাম, সীতা আর হনুমান সেজে আসত, সঙ্গে চেলাচামুণ্ডারা নানা রঙের পোশাকে, হাতে রঙের বালতি নিয়ে পিছন পিছন আসত। বহু দূর থেকে আওয়াজ পেতাম, ওরা আসছে। তখন আমাদের রং খেলা প্রায় শেষের দিকে। দেখতাম শিবের বিশাল বপু, পরনে বাঘছাল, ইয়া বড় গোঁফ, গায়ে ছাই রং, মাথায় জটা, ও ত্রিশূল। বিশাল ধনুক নিয়ে রাম, সঙ্গে সীতা, লক্ষ্মণ ও হনুমান। অনেক বাড়ির সামনে তারা দাঁড়াত, কারণ বাড়ির সামনে রাস্তায় জল দেওয়া হত, তার পর ছোড়া হত বাতাসা। হনুমান তেড়ে যেত গদা নিয়ে মানুষের দিকে। এ ভাবেই ওরা মানুষকে আনন্দ দিত। পাড়ার এক জনের বাড়িতে কিছু ক্ষণ থেকে, দুপুরের প্রসাদ খেয়ে ওরা আবার বাড়ির সামনে দিয়ে ফিরত।
জগদ্ধাত্রী পুজোর ভাসানে, বাজারের লক্ষ্মীপুজোর ভাসানের শোভাযাত্রায় কিছু কিছু বারোয়ারি সঙ কয়েক বছর আগেও নজরে এসেছিল। উৎসাহে পড়েছে ভাটা, হারিয়ে গিয়েছে সেই মানুষগুলো। মাঝে মাঝে বহুরূপীদের দেখতে পাই বাজারে ডুগডুগি নাড়িয়ে দোকানের সামনে হাজির হতে জীবিকার সন্ধানে। তবে স্কুলে বা পাড়ায় কিংবা পুজো প্যান্ডেলে রূপায়ণ প্রতিযোগিতা আজকাল আর চোখেই পড়ে না। হয়তো শরৎচন্দ্র, সমরেশ বসু বা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখাতেই শুধু বহুরূপীরা রয়ে যাবে।
উৎপল মুখোপাধ্যায়
চন্দননগর, হুগলি
আত্মবীক্ষণ
‘দুঃসময়ের সত্যকথক’ (কলকাতার কড়চা, ১৫-৫) প্রসঙ্গে বলতে চাই, সঙ্কীর্ণমনা, সুবিধাবাদী, স্বার্থপর, পলায়নপন্থী মধ্যবিত্ত মৃণাল সেনের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, মৃণাল সেন “দেখতে পেয়েছিলেন বার্লিন দেওয়াল ধসে পড়েছে উত্তর কলকাতার মধ্যবিত্ত শয়নকক্ষে” (দেশ, ১৭ জানুয়ারি, ০১৯)। একদিন প্রতিদিন (১৯৮০), খারিজ (১৯৮), আকালের সন্ধানে (১৯৮)— তাঁর বিভিন্ন ছবিতে পাই যে আত্মবীক্ষণ, তা-ই মৃণাল সেনকে মহান করেছে। হয়তো সে ভাবে জনপ্রিয় করেনি। যদিও তাঁর ইন্টারভিউ (১৯৭০) ও ভুবন সোম (১৯৬৯) দেখে তাঁকে আমরা ‘বাংলার গোদার’ বলে কুর্নিশ করেছিলাম। তুচ্ছ কোট-প্যান্টের অভাবে যে জীবন উপহসিত হয়, সেই জীবন সম্পর্কে নিজস্ব ভাবনার সাহসী প্রতিফলন মৃণাল সেনের পক্ষেই সম্ভব বলে মনে করি। আবার নকশালপন্থী আন্দোলনের পটভূমিকায় কলকাতা ৭১ (১৯৭) ও পদাতিক (১৯৭৩) মৃণাল সেনের নিজস্ব ভাষা ও পদ্ধতিতে স্বতন্ত্র। আর দাঙ্গা-দুর্ভিক্ষ নিয়ে তাঁর বাইশে শ্রাবণ (১৯৬০) আজও মাইলফলক। দাদাসাহেব ফালকে সম্মানে ভূষিত মৃণাল সেনের শতবর্ষ অভিমুখী জন্মদিন উপলক্ষে উত্তরপাড়ার ‘জীবনস্মৃতি’ ডিজিটাল আর্কাইভের সাম্প্রতিক নানা উদ্যোগ এই খারাপ সময়ে নতুন প্রেরণা দিল।
সুদেব মাল
খরসরাই, হুগলি
দুঃস্বপ্নের দিন
কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে এক অকল্পনীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। এই সময়ের সমাজমাধ্যম এবং সংবাদপত্রগুলি এই ভয়াবহতার সাক্ষী। এ যেন আমাদের কালান্তক অতীতের দুঃস্বপ্নময় পুনরাবৃত্তি। শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসের চরিত্র ইন্দ্রনাথ নদীতে ভেসে যাওয়া ওলাওঠায় মৃত একটি শিশুর জন্য পরম মমতায় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করেছিল, তার সঙ্গী শ্রীকান্ত সাক্ষী ছিল। যে মমতা, মানবিকতা একটি কিশোরের মধ্যে রয়েছে, সেটা আমাদের সরকার দেখাবে মৃত নাগরিকের প্রতি, এটাই প্রত্যাশিত।
জিম করবেট ‘রুদ্রপ্রয়াগের নরখাদক চিতা’ কাহিনিতে গঢ়বাল-কুমায়ুন অঞ্চলে কলেরা মড়কের উল্লেখ করে বলেছেন, বহু গ্রামে গরিব মানুষ পর্যাপ্ত কাঠ জোগাড় করতে না পেরে সদ্য মৃতদের উপত্যকায় ফেলে দেয়, যেগুলি পরে নদীতে ভেসে আসে। নদীতে ভেসে-আসা মৃতদেহগুলি ভক্ষণ করেই চিতাটি মানুষখেকো হয়ে ওঠে। রুদ্রপ্রয়াগের চিতাটির ঘটনাপর্যায় ১৯১৮ সালের। ঘটনাচক্রে সে সময়ে ভারতে স্প্যানিশ-ফ্লু মহামারি ছড়িয়ে গিয়েছিল। দুর্ভাগ্য, একশো বছর পর আমরা এক অন্য ধরনের দ্বিপদী-মানুষখেকোদের মুখোমুখি, যারা এই অতিমারির সুযোগে কালোবাজারি, মৃত্যুর বিনিময়ে মুনাফা করতে বিন্দুমাত্র ইতস্তত করে না।
অ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল গ্রন্থে হান্টার বাংলার ১৭৭৩ সালের মন্বন্তরের সময়কার ঘটনার উল্লেখ করেছেন, যেখানে দুর্ভিক্ষক্লিষ্ট অঞ্চলে পাঠানো ত্রাণ লুট হচ্ছে এবং ত্রাণ বিতরণের দায়িত্বে থাকা রক্ষকরাই ভক্ষক। আজও ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতি, অক্সিজেনের চড়া দাম, ওষুধের কালোবাজারি, অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যবস্থার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। সন্দেহ হয়, আমরা কি আদৌ একুশ শতকে পৌঁছতে পেরেছি?
সুমন মাইতি
আরকানস, আমেরিকা