সম্পাদক সমীপেষু: আসল ছবিটা অন্য

শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার নিরিখে ‘এগিয়ে বাংলা’ অন্য অনেক রাজ্যের থেকে অনেক ‘পিছিয়ে’ আছে, বলাই বাহুল্য। কাজের লোকের অভাব নেই, কাজের লোক পেতে সর্বাগ্রে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

‘কে বেকার, কে নয়’ (১-১১) নিবন্ধে সুগত মারজিতের ‘‘কথায় কথায় আমরা দারিদ্র এবং বেকারত্বের কথা বলি, অথচ কলকাতায় বাড়ির কাজের লোক, জলের মিস্ত্রি, বিদ্যুতের কারিগর পেতে জেরবার’’ বক্তব্যটি থেকেই পরিষ্কার যে নিবন্ধকার সমস্যাটির একটা দিকমাত্র দেখেছেন। বেঙ্গালুরু, দিল্লি, মুম্বই শহরে চাকরির জন্য বাংলা থেকে গিয়ে যাঁরা থাকেন তাঁদের তো কাজের লোকের অভাব হয় না। বেঙ্গালুরুতে রান্নার কাজ করে পাওয়া যায় ন্যূনতম মাসিক ৩০০০ টাকা, এক ঘণ্টার কাজ, সপ্তাহে এক দিন ছুটি। আর বাসন মাজা, ঘর মোছার জন্য ন্যূনতম মাসিক ১৫০০ টাকা, ৩৫-৪০ মিনিটের কাজ। এক জন কমপক্ষে ১০টি ফ্ল্যাটে কাজ করেন, সহজেই তাঁদের মাসিক রোজগার অনুমান করা যায়। কাজের এই পরিবেশ ও রোজগার এখানে ক’জন পান? তাই তো বাড়ির কাজের মানুষরাও আজ বাংলা ছেড়ে অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছেন। নির্মাণকাজে সাহায্যকারীরা এখানে দৈনিক মজুরি পান ৩০০-৪০০ টাকা। কেরল, মহারাষ্ট্র, দিল্লিতে একই কাজে পাওয়া যায় ৬০০-৭০০ টাকা। তাঁরা প্রয়োজন মিটিয়েও মাসে কমপক্ষে হাজার পাঁচেক টাকা বাড়িতে পাঠাতে পারেন, বাড়ির লোকেরাও তাই সন্তানের কাজের জন্য অন্য রাজ্যে যাওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি করেন না।

Advertisement

শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার নিরিখে ‘এগিয়ে বাংলা’ অন্য অনেক রাজ্যের থেকে অনেক ‘পিছিয়ে’ আছে, বলাই বাহুল্য। কাজের লোকের অভাব নেই, কাজের লোক পেতে সর্বাগ্রে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। আমাদের রাজ্য ১০০ দিনের কাজে দেশে এক নম্বরে, এটা মোটেই গর্বের বিষয় নয়। কাজের অভাব, তাই ১০০ দিনের কাজের দৈনিক মজুরি ১৯০ টাকা পাওয়ার জন্যই এখানে মানুষ অপেক্ষা করে থাকেন। কাজের অভাব, তাই ৯৮% অবৈধ বাজি কারখানা চলতে দেওয়া হয়, শিশুরা সেখানে কাজ করছে জেনেও চলতে দেওয়া হয়, ১০০% মোটরচালিত ভ্যান সুপ্রিম কোর্টে অবৈধ ঘোষণা হলেও চলতে দেওয়া হয়।

এ বার সরকারি চাকরির কথায় আসি। অগস্ট মাসে পার্লামেন্টের প্রশ্ন-উত্তর পর্বে উঠে এসেছে, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরে প্রায় ২৪ লক্ষ পদ ফাঁকা পড়ে আছে, যার মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে ১০ লাখের বেশি, পুলিশে ৫.৪ লাখ, রেলে ২.৪ লাখ, স্বাস্থ্যে ১.৫ লাখ, সেনাবাহিনীতে ৬২ হাজার, আধা সেনায় ৬১ হাজার, ডাক বিভাগে প্রায় ৫৪ হাজার ইত্যাদি। পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন দফতরে ফাঁকা পদের মোট সংখ্যা ১ লাখ ৭৯ হাজার। ফাঁকা পদের অর্ধেক নিয়োগ হলেও বেকারত্ব নিয়ে এত কথা হত না, কেন্দ্রের, রাজ্যের প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিদের বেকারদের তেলেভাজা, পকোড়া ভাজার পরামর্শ দিতে হত না, আর নিবন্ধকারকেও বেকারদের যে কোনও কাজ করার মানসিকতা তৈরির পরামর্শ দিতে হত না।

Advertisement

বি লিব, এম লিব পাশ করে লাইব্রেরির কাজের প্রত্যাশা করা অন্যায়? গত আট বছরে এখানে নিয়োগই হয়নি, এই সময়ে ৩০০ লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে, অথচ কয়েক হাজার ছেলেমেয়ে পাশ করে বসে আছে। এত পদ ফাঁকা রাখার একটা কারণ, এর ফলে বেসরকারি সংস্থাগুলি শিক্ষিত কর্মচারীর প্রয়োজন সহজেই মেটাতে পারছে। সম্প্রতি রাজ্য সরকার এক লপ্তে হাজারের উপর নার্স নিয়োগ করায় নামী নার্সিংহোমগুলিতে প্রশিক্ষিত নার্সের ঘাটতি অনুভূত হচ্ছে, নার্সিংহোমের কাজ ছেড়ে অনেক নার্স চলে গিয়েছেন। জনস্বার্থের একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট নার্সদের বেতন ন্যূনতম ২০,০০০ টাকা করার নির্দেশ দিলেও আজও সেটা হয়নি। সম্প্রতি স্বাস্থ্য দফতর উদ্যোগী হয়েছে। বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বেতনও খুব কম, জনস্বার্থের মামলা ছাড়া এঁদেরও অবস্থার পরিবর্তন হবে না।

আর একটি কারণ, সরকারের আর্থিক সাশ্রয় হচ্ছে, সরকার এই অর্থ ভর্তুকি, অনুদান দিতে ব্যয় করছে। অনেক ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে প্রতিযোগিতাও দেখা যাচ্ছে, রেশনে চাল, গম কেজিপ্রতি ৭ টাকা থেকে কমিয়ে কেন্দ্র ৩ টাকা করলে, রাজ্য আরও এক টাকা ভর্তুকি দিয়ে চাল, গম ২ টাকা দরে দিচ্ছে। ভোট যেখানে বড় বালাই, সেখানে প্রতিযোগিতা চলবে, কিন্তু এত বিপুল সংখ্যক কর্মচারীর ঘাটতি নিয়ে সরকারের বিভিন্ন দফতরের কাজকর্ম চলছে কী করে? চলছে না যে, তা শিক্ষা স্বাস্থ্যক্ষেত্রের দিকে তাকালেই দেখা যায়। শিক্ষকের নিদারুণ অভাবে ডাক্তারি ছাত্রদের ক্লিনিক্যাল শিক্ষার করুণ অবস্থা ধারাবাহিক ভাবে এই সংবাদপত্রেই প্রকাশিত হয়েছিল। স্কুল-কলেজ সর্বত্র শিক্ষকের অভাবে অর্ধেক ক্লাসই হয় না, কোচিং সেন্টারের উপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। অবস্থার সামাল দিতে এবং সেই সঙ্গে আর্থিক সাশ্রয় করতে কোথাও অবসরপ্রাপ্তদের কাজে বহাল করা হচ্ছে, আবার কোথাও চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ করা হচ্ছে। চুক্তির কাজে ‘ফাঁকি’ নেই, ‘ঝুঁকি বেশি’, যে কোনও সময় কাজ চলে যেতে পারে, কাজের নির্দিষ্ট সময় নেই, ভবিষ্যৎ আর্থিক কোনও সুবিধা নেই, তা হলে এঁদের বেতন এত কম হবে কেন? যে হেতু কাজের লোকের অভাব নেই? এই শোষণ নিয়ে নিবন্ধ লেখা হয় না কেন?

অসিত কুমার রায়

ভদ্রেশ্বর, হুগলি

সিস্টেমের দোষ

সুগত মারজিত লিখেছেন ‘‘সরকারি চাকরি,তাই পেনশন পাবে। তা ছাড়া, প্রতি দিন যেতে হবে না, দেরি করে গেলেও চলবে,কাজ না করলে চাকরি যাবে না,আর শুনেছে সাইডে টুকটাক কাজ করার সুযোগ থাকবে।’’ বেসরকারি সংস্থায় ১২-১৩ ঘণ্টার পরিশ্রম এবং অনিশ্চয়তার বিপরীতে সরকারি চাকরির বাঁধা সময়ের বিবিধ সুযোগ সুবিধা, সামাজিক মর্যাদা, তদুপরি নিরাপত্তার হাতছানিতে শিক্ষিত বেকারের সরকারি চাকরির প্রত্যাশা করাটাই তো স্বাভাবিক। তাতে কি মনে করা যায় তিনি কর্মবিমুখ? এমন বহু উদাহরণ আছে, বেসরকারি চাকরি ছেড়ে সরকারি চাকরির ফাঁকিবাজির পরিবেশে অনেকে মানিয়ে নিতে পারেন না। প্রশ্ন হল, কে তাকে ফাঁকি শিখিয়েছে? অবশ্যই সেটি প্রশাসনিক মদতে তৈরি একটি সিস্টেম। যেখানে কোনও নজরদারি নেই। সুগতবাবু সেই সিস্টেমকে দায়ী না করে দায়ভার চাপাচ্ছেন শিক্ষিত বেকারের ঘাড়ে।

নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় তিনি দেখেছিলেন ‘‘...অবশ্য দুপুর একটার আগে তিনি আসতেন না, সংগঠনের কাজ করতেন। আর অনেক দিন বিকেলে ‘পার্টির মিটিং’ থাকত।’’ এ কথা ঠিক, বাম জমানায় অতি রাজনীতি কর্মসংস্কৃতির বিনাশ ঘটিয়েছে। তেমনই, এক ধাপ এগিয়ে বর্তমান সরকারের উৎসবের অছিলায় কথায় কথায় ছুটি ঘোষণায় সরকারি কর্মদিবসগুলোই তো হাওয়া হয়ে যাচ্ছে, সেটা সুগতবাবুর নজরে এল না? তিনি অবশ্য আনন্দিত, ‘‘এ রাজ্যে ‘ব্যবসায়ী’ হবে বললে শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের ভর্ৎসনা করা হয়। অত্যন্ত আনন্দের কথা, ইদানীং সে আবহাওয়া কিছুটা পাল্টেছে।’’ বাস্তবে যেটা চোখে পড়ে, পরিবহণ ক্ষেত্রে অটো, টোটো আর সিন্ডিকেটের দৌলতে ইট-ইমারতের ব্যবসায় আবহাওয়া পাল্টেছে।

দেবব্রত সেনগুপ্ত

কোন্নগর ,হুগলি

আর এঁরা?

সুগতবাবুকে জিজ্ঞেস করি, বেসরকারি ক্ষেত্রে তাঁর এমন লোক চোখে পড়ে না যিনি দেরি করে কাজে আসেন ও নিজের কাজ ঠিকমতো না করে অতিরিক্ত উপার্জন করেন? ডাক্তারবাবুরা হাসপাতালে সময়মতো আসেন? যে চিকিৎসা হাসপাতালেই করা যায়, তা না করে নিজের চেম্বারে আসতে বলেন, মোটা টাকা উপার্জন করেন। নির্দিষ্ট ওষুধ কোম্পানি, প্যাথলজিক্যাল ল্যাবের নাম লেখেন, কমিশনের বিনিময়ে। শিক্ষকরা সময়মতো ক্লাসে যান? যা ক্লাসে পড়ানো উচিত তা বাড়িতে টোল খুলে পড়ান। টাকার বিনিময়ে নোটস বিক্রি করেন। আর সংগঠনের জন্য কাজ করা তো বাংলার সংস্কৃতি, কমবেশি সবাই যুক্ত।

অলোক চৌধুরী

উত্তর ২৪ পরগনা

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।

ইমেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন