প্রতিটি বিষয়েরই উত্তরপত্র দেখা যাবে।—ফাইল চিত্র
পশ্চিমবঙ্গের বিস্তৃর্ণ অঞ্চল, বিশেষ করে সুন্দরবন, মেদিনীপুরের পশ্চিমাঞ্চল, ঝাড়গ্রাম, ডুয়ার্স প্রভৃতি এলাকা শিক্ষার আলোকে আলোকিত নয়। স্কুল আছে, ছাত্রছাত্রী আছে, প্রান্তবাসীদের আলোর আকাঙ্ক্ষা আছে, নেই শুধু আলো জ্বালাবার লোক। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্বেগ সঙ্গত। সঙ্কটমোচনে তিনি স্কুলে ইন্টার্ন নিয়োগের কথা ভাবছেন। প্রাথমিক স্তরে দু’হাজার টাকা সাম্মানিকে সদ্য স্নাতক, উচ্চ প্রাথমিক-মাধ্যমিকে আড়াই হাজারে অনার্স/স্নাতকোত্তর নিয়োগ, সঙ্গে শংসাপত্র যা ভবিষ্যতে নিয়োগে সহায়ক, আর ভাল পড়ালে ভাতা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি। বিষয়টি যে হেতু ভাবনার স্তরে, তাই বিশেষ বিবেচনার সুযোগ আছে। সেই প্রেক্ষিতে কিছু কথা।
১) লোকাভাব সমস্যাটি সদ্যোজাত নয়। দিনে দিনে জমে ওঠা সমস্যার পুঞ্জীভূত রূপ। স্কুলগুলিতে শিক্ষক ছিল, পড়াশুনা হত, ওই সব এলাকা থেকে বহু ছাত্রছাত্রী সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার পর কিছু শিক্ষক অবসর নিয়েছেন, কেউ কেউ স্থানান্তরিত হয়েছেন, নিয়োগ বিলম্বিত হওয়ায় স্কুলগুলিতে শূন্যতা সৃষ্টি ও পঠনপাঠনে অচলাবস্থা। এই অন্ধকার দূরীকরণে স্থায়ী ভাবনা ও ব্যবস্থাপনা জরুরি, ‘রেডিমেড’ দাওয়াই নয়।
২) রাজ্যে শিক্ষার অধিকার আইন চালু আছে, ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর টিচার এডুকেশন (এনসিটিই) নিয়মাবলির মান্যতা আছে, প্রশিক্ষিত লোকজনের অভাব নেই, প্রশিক্ষণের কলেজ আছে, এমনকি এখন আবার বি এড-সহ স্নাতক কোর্স পড়ার ব্যবস্থা হতে চলেছে। এই অবস্থায় প্রশিক্ষণহীন ব্যক্তিদের নিয়োগের যথার্থতায় প্রশ্ন আসতেই পারে।
৩) প্রশ্ন শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে। শিশুশিক্ষায় প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা শিক্ষাবিজ্ঞান, শিক্ষাবিদগণের দ্বারা স্বীকৃত, বিভিন্ন কমিশন-কমিটিতে অনুমোদিত। শিক্ষক নবিশ, শিক্ষার্থীও নবিশ; শিক্ষার মান কোন স্তরে যাবে, তা সহজেই অনুমেয়।
৪) এই ভাবনা দ্বৈত ব্যবস্থাপনার জন্ম দেবে। গ্রামীণ এলাকায় এক রকম, শহরে অন্য রকম। সব কিছু ভাল শহরে, কাজ চলার মতো গ্রামে। গ্রাম সেই হাতুড়ে ব্যবস্থার পরিসরে থেকে যাবে যা সামাজিক বৈষম্য ও হীনম্মন্যতা বাড়াবে।
৫) নিয়োগের মানবিক দিকটি উপেক্ষার নয়। পশ্চিমবঙ্গের ন্যূনতম মজুরি আইন অনুযায়ী এক জন অদক্ষ শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ২২৭ টাকা, মাসিক দাঁড়ায় ৬৮১০ টাকা। এক জন ইন্টার্ন শিক্ষক পাবেন মাসে ২০০০ টাকা। যে আয়ের দ্বারা বাঁচার ন্যূনতম প্রয়োজন মেটে না, অভাব-জর্জর সেই শিক্ষকের কাছে কতটা উন্নত শিক্ষা ভাবনা প্রত্যাশিত? পুরো সময়ের শিক্ষকের সঙ্গে একই জায়গায় একই ধরনের কাজ করতে হবে আকাশ-জমিন বেতন বৈষম্যকে সামনে রেখে। এই অসম পরিস্থিতিতে তৈরি হওয়া মানসিক ব্যবধান শিক্ষা সহায়ক নয়।
আশু ভাবনা হওয়া উচিত স্থায়ী নিয়োগ সুনিশ্চিত করা। দ্রুত নিয়োগ সর্বত্র। স্থান বিশেষীকরণ নয়, কর্মপ্রার্থীকে যেতে হবে যে কোনও স্থানে, যেমন সরকারি কর্মীরা যান। সুযোগ থাকবে বদলির, সময়ান্তরে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া গ্রামে এখন রাস্তা আছে, বিদ্যুৎ আছে, পানীয় জল আছে, শিক্ষাকে ভালবাসার লোক আছে, শিক্ষক থাকবে না কেন? নিয়োগ ভাবনাটি হোক বাস্তবমুখী। পার্শ্বশিক্ষক, আংশিক শিক্ষক— অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে, আর নয়। এ বার হোক শিক্ষার স্বার্থে ‘সমগ্র’-এর চিন্তা।
শ্রীদামচন্দ্র জানা
রাজ্য সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ প্রধানশিক্ষক সমিতি
বদলির বৈষম্য
সারা দেশে এখন শিক্ষা অধিকার আইন চালু হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩০ জন ছাত্র পিছু এক জন করে শিক্ষক অথবা শিক্ষিকা থাকা উচিত। কিন্তু বাস্তবে এত দিন এই নিয়ম অনুসরণ করা হত না। বিভিন্ন জেলার শহরাঞ্চলের প্রাথমিক স্কুলগুলিতে ছাত্র অনুপাতে শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা অনেক বেশি। আবার গ্রামীণ স্কুলগুলিতে ছাত্র অনুপাতে শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা একেবারে কম। এমনকি কোনও কোনও গ্রামীণ এলাকার স্কুলগুলিতে এক জন শিক্ষক-শিক্ষিকাকেই স্কুল চালাতে হয়। যদিও এখন মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কোনও বিদ্যালয়ে এক জন শিক্ষক রাখা যাবে না।
এই সরকারের আমলেও দু’দফায় কয়েক হাজার প্রাথমিক শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ হয়েছে। তাতে দেখা গিয়েছে যে সব এলাকায় শিক্ষক কম আছেন, সেখানে নিয়োগ করা হয়নি। বরং যেখানে শিক্ষক প্রয়োজন নেই, সেখানে শিক্ষক দেওয়া হয়েছে। তাই এত দিনে সরকার ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতে সমস্ত বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সমবণ্টন প্রক্রিয়া গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে শুরু করেছে। জেলা শাসককে চেয়ারম্যান করে প্রতি জেলায় একটি বিশেষ কমিটি তৈরি হয়। বিদ্যালয় পরিদর্শকেরা ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতে অতিরিক্ত শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা এই কমিটির কাছে পাঠান। প্রতি জেলায় ডিআই ও চেয়ারম্যান সেই তালিকা স্ক্রুটিনি করে রাজ্য শিক্ষা দফতরে পাঠান।
সম্প্রতি রাজ্যের শিক্ষা দফতর থেকে আটটি জেলায় কয়েক হাজার প্রাথমিক শিক্ষককে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বদলির আদেশনামা পাঠানো হয়েছে। এই বদলিগুলি বেশির ভাগ ভুলে ভরা ও বৈষম্যমূলক। কোনও রকম ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত বজায় না রেখে শিক্ষকদের ৫০-৬০ কিমি দূরে অন্যায় ভাবে বদলি করা হয়েছে। এই বদলি প্রক্রিয়ায় শিক্ষিকাদের বাদ রাখা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু দীর্ঘ দিন বাড়ির কাছের স্কুলে চাকরি করছেন এমন শিক্ষকদেরও দূরের স্কুলে বদলি করা হয়েছে।
গড়বেতা দক্ষিণ চক্রের টেলটোকা প্রাথমিক ও ঘোষকিরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র সংখ্যা ১০০-র কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও চার জনের দু’জন করে শিক্ষককে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। খড়্গপুরের একটি স্কুলের দু’জন স্থায়ী শিক্ষককে বদলি করা হয়েছে। অথচ মেদিনীপুর সদর চক্রে অতিরিক্ত শিক্ষক প্রায় ১০০ জন থাকা সত্ত্বেও কিছু জনকে মাত্র বদলি করা হয়েছে। শিক্ষকদের দাবি, সরকার বদলি করুক কিন্তু নিয়ম মেনে করা হোক। তৃণমূল শিক্ষক সংগঠনের দাবি, তাদের অন্ধকারে রেখে এই বদলি প্রক্রিয়া হয়েছে। তাই অধিকাংশ জায়গায় সমস্যা তৈরি হয়েছে।
শিক্ষার স্বার্থে এই বদলি প্রয়োজন ঠিকই। কিন্তু অধিকাংশকে বাড়ি থেকে প্রায় ৫০-৬০ কিমি দূরে বদলি করলে তাঁরা কী ভাবে সময়মতো স্কুল করবেন ও ছাত্রকে পাঠদান করবেন? প্রাথমিক শিক্ষকদের অন্যায় বদলি করে বিভিন্ন জেলায় শিক্ষাক্ষেত্রে একটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
মানুষ গড়ার কারিগর যাঁরা, তাঁরাই আজ বঞ্চিত ও বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার। তাঁদের বেতন বঞ্চনা দূর করতে না পেরে তাঁদের আন্দোলন করতে দমন করতে এই ভাবে বদলি করা সম্পূর্ণ অনৈতিক।
চিত্তরঞ্জন মান্না
চন্দ্রকোনা রোড, পশ্চিম মেদিনীপুর
এক জনই
সরকারি ও সরকার পোষিত মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলির শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে বাধ্য। এক জন শিক্ষক বা শিক্ষিকা অসুস্থ হলেও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক দু’টি পরীক্ষারই উত্তরপত্রের মূল্যায়ন করছেন। আবার সেই সঙ্গে নিজের স্কুলের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র রচনা, পরীক্ষাগ্রহণ ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন করছেন। ভোটের ডিউটিও করছেন। আবার সেই বিদ্যালয়ের সেই বিষয়ের অনেক শিক্ষক বা শিক্ষিকা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষকজীবনে এক বারও উত্তরপত্র মূল্যায়ন না করেই অবসর নিচ্ছেন। যেমন, আমার বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ৬। কিন্তু এক জন মাত্র শিক্ষিকা বছরের পর বছর দু’টি পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন করে চলেছেন। পরীক্ষক নিয়োগের সময় যদি মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ একসঙ্গে বসে ঠিক করে নেয়, কোন পরীক্ষককে মাধ্যমিক ও কোন পরীক্ষককে উচ্চ মাধ্যমিকের উত্তরপত্র মূল্যায়নের দায়িত্ব দেওয়া হবে, ভাল হয়।
কল্যাণ কুমার রঞ্জিত
জোয়ারগোড়ী, হাওড়া
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও