সম্পাদক সমীপেষু: তিনি ভয় পাবেন?

আমি সৌভাগ্যবান, সুভাষদাকে আমার তরুণ বয়স থেকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, প্রায় ৪০ বছর। তাঁর সঙ্গে কাজও করেছি দীর্ঘ কাল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৮ ০০:৩০
Share:

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে ‘তিনি ছিলেন ভারতের পাবলো নেরুদা’ (পত্রিকা, ২৬-৫) শীর্ষক লেখায় সুবোধ সরকার এমন কিছু মন্তব্য করেছেন যার সঙ্গে আমাদের অভিজ্ঞতা মেলে না। সুভাষদা নাকি সুবোধবাবুকে বলেছেন, ‘‘রাশিয়াতে চুরি হত, ডাকাতি হত, ধর্ষণ হত।...সেগুলো লিখতে দেয়নি ওরা।’’ সুবোধবাবু বললেন, কারা দেয়নি? ‘‘এই আমাদের পাড়ার স্তালিনগুলো, তবে শোনো, রাশিয়ার একটা জিনিস খুব ভাল। তার নাম ভদকা।’’ সুবোধবাবু আর এক জায়গায় লিখেছেন, সুভাষদা তাঁকে বলেছেন, ‘‘নীরেনের (কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী) কবিতা আমার খুব ভাল লাগে। সেটা আমি কাউকে বলতে পারিনি। বললে ওরা আমার দিকে খারাপ চোখে তাকাত।’’ পড়লে মনে হতেই পারে, সত্যি কথা লিখতে বা বলতে সুভাষদা ভয় করতেন। রক্তচক্ষুকে ভয়— তাই নিজেকে বাঁচাতে, যখন যেমন তখন তেমন তাল দিয়ে চলাটাই তাঁর পছন্দ। এখন অনেকে যেমন করে থাকেন।

Advertisement

আমি সৌভাগ্যবান, সুভাষদাকে আমার তরুণ বয়স থেকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, প্রায় ৪০ বছর। তাঁর সঙ্গে কাজও করেছি দীর্ঘ কাল। ‘সপ্তাহ’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর তিনি সভাপতি ছিলেন ১৯৮০ থেকে আমৃত্যু। তাঁর অধীনে এর সম্পাদনার কাজেও আমি যুক্ত ছিলাম দুই দশক। সুভাষদা ষাটের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশে যখন যান, তখন আমি তরুণ সাংবাদিক হিসাবে ওই দেশে। সুভাষদার সঙ্গে একাধিক বার দেখা হয়েছে, কিন্তু সুবোধবাবু বর্ণিত সুভাষদার এই প্রতিবাদবিমুখ ছবি চোখে পড়েনি। আমার অভিজ্ঞতায়, স্তালিন, স্তালিনবাদ এবং স্তালিনবাদীদের সম্পর্কে সুভাষদার ভাবনা এক এক রকম। স্তালিনের মৃত্যুর পর তিনি লেখেন বিখ্যাত কবিতা ‘কমরেড স্ট্যালিন’। এই কবিতায় লিখলেন, ‘‘স্ট্যালিন জীবন হোক/আজ থেকে মৃত্যুহীন জীবনের/ নাম হোক/ কমরেড স্ট্যালিন’’।

১৯৬৭-৬৮ সালে সুভাষদার সঙ্গে মস্কোয় এবং বুদাপেস্টে দেখা হয়েছে। বিভিন্ন দেশে তরুণ সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁর আড্ডাও হয়েছে। সমাজবাদী দেশের কিছু কিছু বিষয় নিয়ে তাঁকে প্রশ্নও করেছি। সুভাষদা জোর দিয়ে বলেছেন, ‘‘যুদ্ধে দু’কোটি মানুষ মারা গেছে— অর্থনীতি ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু দেখ, কত দ্রুত ওরা উঠে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সর্বদা নিপীড়িত মানুষকে সাহায্য করছে। কাজ, খাওয়া, স্বাস্থ্য, শিক্ষা নিয়ে কাউকে ভাবতে হয় না। সামাজিক নিরাপত্তা কত ভাল। তাই খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ নেই। তবে এখানে একটা সুবিধাভোগী শ্রেণি আছে। তারা হচ্ছে শিশুরা। গরিব বড়লোক ভেদাভেদ নেই। সকলেরই সুবিধা।’’ সুরা নিয়ে কখনও কথা বললেও, রাশিয়ার একটা জিনিসই ভাল, তা হল ভদকা, এ রকম অদ্ভুত মন্তব্য করতে শুনিনি।

Advertisement

সুভাষদাকে নিয়ে পঞ্চাশের দশক থেকে নানা বিষয়ে বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু তিনি নিজের স্পষ্ট বক্তব্য পেশ করেছেন— কোনও রক্তচক্ষুকে ভয় করেননি। ১৯৫৫ সালে মার্ক্স-এর লেখা ‘ওয়েজ লেবার অ্যান্ড ক্যাপিটাল’ নিয়ে তিনি লেখেন ‘ভূতের বেগার’। ১৯৫৫-র ১৮ সেপ্টেম্বর পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী পার্টিকর্মীদের বইটি পড়তে এবং বিক্রি করতে নিষেধ করে ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় বিবৃতি দেয়। সুভাষদা ‘ভূতের বেগার’ বইটি প্রত্যাহার করেননি।

১৯৭৬-এর ১৮ ডিসেম্বর থেকে আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘আবার ডাক বাংলার ডাকে’ শীর্ষক রিপোর্টাজ লেখা শুরু করেন। সিপিআই রাজ্য কমিটির সভায় অনেকে সুভাষদাকে এই লেখা বন্ধের জন্য বলেন অথবা তাঁকে শাস্তি দেওয়ার কথা বলেন। সুভাষদা লেখা বন্ধ করতে রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হস্তক্ষেপে বিষয়টি স্থগিত হয়। ১৯৭৮-এর ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত লেখাটি আনন্দবাজারে প্রকাশিত হয়। ১৯৭৮-এ মরিচঝাঁপিতে উদ্বাস্তুদের উপরে বামফ্রন্ট সরকারের সন্ত্রাস। সুভাষদা পার্টি সদস্য, কিন্তু প্রতিবাদে লেখেন, ‘‘ঘেন্নায় মরি ছিঃ/কাড়ে না কেউ রা/ যত ভাল মানুষের ছা’’।

১৯৭৮-এ আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয় সুভাষদার কবিতার বই ‘একটু পা চালিয়ে ভাই’। বইয়ে সলঝেনেৎসিন-এর চারটি কবিতা তিনি যোগ করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃত্ব তাঁকে বলল, ‘‘সলঝেনেৎসিন এখন সোভিয়েত বিরোধী। অতএব এই বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ থেকে ওই কবিতাগুলি প্রত্যাহার করতে হবে।’’ সুভাষদা রাজি হলেন না। বললেন, ওই কবিতা যখন অনুবাদ করেছেন তখন সলঝেনেৎসিন সোভিয়েত নাগরিক। আর, কোনও লেখককে বিচার করতে হবে তাঁর লেখা দিয়ে।

১৯৮০ সালে ‘সপ্তাহ’ পত্রিকায় কিছু লেখা নিয়ে সিপিআই নেতৃত্ব ক্ষুব্ধ হন এবং তাঁরা সমর্থক ও সদস্যদের এই পত্রিকা পাঠে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রকাশ্যে ঘোষণা করে ওই পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি হন। এই ঘটনার প্রায় সাত বছর পর উনি কবি সুবোধ সরকারকে বলছেন, নীরেনবাবুর কবিতা তাঁর ভাল লাগলেও এ কথা কেউ রক্তচক্ষু দেখাবে ভেবে তিনি বলতে পারেননি! পড়লে মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক।

১৯৮০ থেকে তিনি সিপিআই দলের সদস্যপদ নবীকরণ করেননি। অন্য কোনও রাজনৈতিক দলেও যোগ দেননি। তবে তাঁর সহমর্মিতা ছিল এস এ ডাঙ্গের অনুগামীদের প্রতি। তা প্রকাশ্যে জানাতেও দ্বিধা করেননি। ওই সময় সিপিআই এবং কিছু বামপন্থী দল সুভাষদার বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করে। ১৯৮০-র ৩০ অগস্ট আনন্দবাজার পত্রিকায় তিনি এক দীর্ঘ নিবন্ধ লেখেন, ‘আমি ছেড়ে যাইনি এক পাশে শুধু উত্তরের অপেক্ষায় আছি’। লেখাটি রাজনীতির সঙ্গে সংস্কৃতির এবং ব্যক্তির সঙ্গে পার্টির সম্পর্ক বিষয়ে এক অমূল্য দলিল। এটি সত্য, ১৯৮৪-তে ইন্দিরা গাঁধীর মৃত্যুর পরে তিনি কলকাতা শহর ও শহরতলিতে কংগ্রেসের হয়ে ২০টি সভা করেছেন। এর পর অন্য কারও হয়ে নির্বাচনী প্রচারে যাননি। সংগ্রামী ভূমিকার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল, কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে কোনও নির্বাচনী সভায় যাননি। তবে ওই দলের বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচিতে অনেক সময়ে গিয়েছেন। মমতা এনডিএ-তে যোগ দেওয়ায় তাঁর ক্ষোভও তিনি প্রকাশ্যেই ব্যক্ত করেছেন। ২০০৩ সালে মৃত্যুর আগে তিনি সারা ভারতের ছোট ছোট কমিউনিস্ট পার্টিগুলির মিলিত কনভেনশন ডাকার উদ্যোগ করেছিলেন, যার মধ্যে স্তালিনবাদীরাও ছিল, কিন্তু তাঁর জীবনাবসানে তা হয়ে ওঠেনি।

দিলীপ চক্রবর্তী কলকাতা-১২

আশ্চর্য মানুষ

‘বাংলা প্রবর্তন সমিতি’র সূত্রে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করেছি। সমিতির দাবি ছিল, সরকারি কাজে বাংলা চালু করতে হবে। বিভিন্ন সরকারি অফিসে গিয়ে মিটিং হত। লিফলেট বিলি করতাম। আমি ও সুভাষদা শিয়ালদহ ও হাওড়া স্টেশনে বিকেলে হাজার হাজার রেলযাত্রীর হাতে গুঁজে দিতাম প্রচারপত্র।

আমার অফিস ছিল ডালহৌসি পাড়ায়। সুভাষদা ও দিকে এলে মাঝে মধ্যে আমার ঘরে আসতেন। বলতেন, ‘‘চা খাওয়াও।’’ বলতাম, আর কী খাবেন? ঢোলা পাঞ্জাবির ঝোলা পকেট থেকে এক মুঠো ছোলাভাজা বার করে বলতেন, ‘‘এই তো খাচ্ছি। তুমি খাবে? বেশি খেলে দৌড়তে পারব না। এই তো এসপ্ল্যানেড ইস্টে মিটিং করছিলাম। পুলিশ তাড়া করল। ডেকার্স লেন দিয়ে ছুটে চলে এলাম।’’

আমরা অনেক রবিবারে দক্ষিণ কলকাতায় এক বিখ্যাত ডাক্তারের বাড়িতে সমিতির মিটিং করতাম। ডাক্তারবাবু তাঁর বড়লোক রোগীদের কাছ থেকে বিভিন্ন মিষ্টি উপহার পেতেন। আদর করে সেগুলো আমাদের খাওয়াতেন। এক দিন সুভাষদা আমার অফিসে এসে বললেন, ‘‘ডাক্তারবাবুর বাড়ি থেকে আমাদের ঠেকটা উঠল। উনি কবিতা লেখেন। সে দিন আমাকে বললেন, আনন্দবাজারের সন্তোষ ঘোষের সঙ্গে তো আপনার বন্ধুত্ব আছে। আমার কয়েকটা কবিতা ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপিয়ে দিতে পারেন?’’ তার পর সুভাষদা অসহায় ভাবে আমার দিকে তাকালেন। এমন অসহায় মুখ ওঁর কোনও দিন দেখিনি।

শিশিরকুমার নিয়োগী কলকাতা-৯১

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।

ই-মেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন