সুরজিতের কথা মনে পড়াচ্ছেন অন্ধ্রের পোড়-খাওয়া নেতা

চন্দ্রবাবুর হিসেবনিকেশ

এ সপ্তাহে আলোচনা করব চন্দ্রবাবু নায়ডুকে নিয়ে। অন্ধ্রপ্রদেশের এই ৬৮ বছর বয়সি পোড়-খাওয়া মুখ্যমন্ত্রী কেন আলোচ্য বিষয়?

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

এ সপ্তাহে আলোচনা করব চন্দ্রবাবু নায়ডুকে নিয়ে। অন্ধ্রপ্রদেশের এই ৬৮ বছর বয়সি পোড়-খাওয়া মুখ্যমন্ত্রী কেন আলোচ্য বিষয়? আমি জানি, তার কারণও বিলক্ষণ জানেন আপনারা। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে বিরোধী রাজনীতিতে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সর্বভারতীয় চরিত্র হয়ে উঠেছেন চন্দ্রবাবু। এ দেশের বহু আঞ্চলিক নেতা যেটা বুঝেও বুঝতে পারছেন না, এই তেলুগু বিড্ডা সেই সার সত্যটি বুঝেছেন। নরেন্দ্র মোদীর মতো এক প্রবলপরাক্রান্ত শক্তির মোকাবিলায় আর অমিত শাহের মতো বাস্তববাদী এ দেশের এক ‘জীবন্ত মাকিয়াভেলি’কে জাতীয় রাজনীতিতে বিপর্যস্ত করতে এখনই সর্বভারতীয় দল কংগ্রেস এবং রাহুল গাঁধীর সঙ্গে সন্ধি প্রয়োজন। দিল্লি তখত দখল করার জন্য ম্যাজিক নম্বর ২৭২। কংগ্রেস ছাড়া এই সংখ্যা অসম্ভব। এবং শুধু সংখ্যার জন্যই নয়, আঞ্চলিক দলের জোট মানেই যে জগাখিচুড়ি নয়, সেই স্থায়িত্বের আশ্বাস দেওয়ার জন্যও প্রয়োজন রাহুল গাঁধীর কংগ্রেসকে।

Advertisement

চন্দ্রবাবুকে অন্ধ্রপ্রদেশে সবাই ডাকে ‘বাবু’ বলে। বাবুর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন এক তেলুগু তথ্য অফিসার অঞ্চা রাও। ১৯৯৬ সাল। বাজপেয়ীর ১৩ দিনের সরকার সবে বিদায় নিয়েছে। অন্ধ্রভবনে অঞ্চা রাও আমাকে বাবুর সঙ্গে প্রথম আলাপ করান। সে দিন থেকে দেখছি মানুষটার সব চেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল আবেগহীন বাস্তববাদ। প্রথম নজর কেড়েছিল ওঁর চোখ দুটো। স্থির। হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ তখন খুব সক্রিয়। চন্দ্রবাবু সুরজিতের শিষ্য হয়ে গেলেন। সুরজিতের বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি নিজে প্রধানমন্ত্রী হতে চাননি। তিনি জানতেন সেটা সম্ভবও নয়। সহজে তিনি তাই সে সময় যে কোনও দলের যে কোনও নেতার সঙ্গে একান্তে কথা বলতে পারতেন। প্রধানমন্ত্রী পদের প্রত্যাশী কোনও নেতারই তাঁর সঙ্গে দেখা করলে নিরাপত্তার অভাব বোধ হত না।

’৯৬ সালের সেই প্রয়াসকে বাবু আজ পুনর্জীবিত করতে চাইছেন। রাহুল গাঁধী এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক নেতার সঙ্গে গত দু’মাসে একাধিক বার দেখা করেছেন। সকলকে একান্তে প্রথমেই এটা জানিয়েছেন যে তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, এই সহজ সরল সত্যটা তিনি জানেন। তাঁর নতুন রাজ্যে সাকুল্যে ২৫টি লোকসভা আসন। এই পুঁজি নিয়ে, আর যা-ই হোক, সাউথ ব্লকের কুর্সিতে যে বসা যায় না সেটা তিনি খুব ভাল

Advertisement

করে জানেন।

এ বার প্রশ্ন হল, তিনি যে রাহুল গাঁধীর সঙ্গে এতটাই সখ্য রচনায় ব্যস্ত তাতে তার অমরাবতীতে রাজনৈতিক লোকসান হবে না? অন্ধ্রে তো কংগ্রেসও অন্যতম বিরোধী দল। ইতিহাস ভুললে তো চলবে না। ’৫৬ সালে নতুন অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন সঞ্জীব রেড্ডি। যখন হায়দরাবাদ যুক্ত হয় অন্ধ্রের সঙ্গে। চেন্নাই প্রেসিডেন্সি থেকে অন্ধ্রের আলাদা হওয়ার ’৫৩ সালের‌ কাহিনিও তো আমরা জানি। নেহরু এবং রাজা গোপালাচারীর চিন্তার সংঘাতও তো আজ ইতিহাস। ভূগোল বদলানোর ইতিহাস। কিন্তু সেই কংগ্রেসশাসিত অন্ধ্রপ্রদেশ। ’৮৩ সালে এনটিআর-এর তেলুগু দেশমের জন্ম ও ক্ষমতায় আসা। তা সম্ভব হয় জাতীয় কংগ্রেসের অবক্ষয়ের পটভূমিতে। রাজ্যে আঞ্চলিক স্বপ্নের নতুন সওদাগর এনটিআর নামক আইকনের জন্ম। চন্দ্রবাবু কংগ্রেস দলে ছিলেন। ’৮৪ সালে তিনি শুধু প্রথম কংগ্রেস বিধায়ক নন, রাজ্যের নবীনতম মন্ত্রী। পরে এনটিআর তাঁর মধ্যে সম্ভাবনা দেখে মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেন।

বাবু অবশ্য এনটিআর-এর মৃত্যুর পর দলের দুর্দিনও দেখেছেন। রাজশেখর রেড্ডি তথা কংগ্রেসের উত্থান। দশ বছর তিনি বিরোধী নেতাও ছিলেন। সেই কংগ্রেস ২০১৪ সালে আবার অন্ধ্রকে বিভক্ত করে ভূগোল বদলাল। তেলঙ্গানা পৃথক রাজ্য হল। অন্ধ্রের মানুষ এতটাই ক্ষুব্ধ হলেন যে ১৭৫টি বিধানসভার ভোটে ১৭৪টিতে কংগ্রেসের জামানত বাজেয়াপ্ত হল। সেই কংগ্রেসের সঙ্গে এই সখ্য রাজ্যে বাবুকে বিপদে ফেলবে না? রাজ্যে কংগ্রেসকে নিয়ে কোনও ভয় নেই চন্দ্রবাবুর? সম্প্রতি বাবুর সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, তিনি একটা ‘ক্যালকুলেটেড রিস্ক’ নিচ্ছেন। তাঁর ধারণা, এটা লোকসভা ভোট। রাজ্যে মূল লড়াই তেলুগু দেশম বনাম জগন। রাজ্যে কংগ্রেস শূন্য। কিন্তু দিল্লিতে মোদীকে সরাতে জগন+ এবং বিজেপি আঁতাঁতের বিরুদ্ধে রাহুলকে তাঁর প্রয়োজন। ভোট ভাগাভাগি হবে না সে মেরুকরণে। চন্দ্রবাবুকে বোকা ভাবার কোনও কারণ নেই।

এটাও ঠিক, মমতা প্রথম থেকেই বিজেপির বিরুদ্ধে ১:১ সমঝোতার কথা বলেছেন। রাহুল গাঁধীর সঙ্গে দেখা করে চা-চক্রের আয়োজনও করেন। কিন্তু মমতা রাজ্যে বিজেপির মোকাবিলায় কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলাতে প্রস্তুত নন। অনেকে ভাবেন অধীর চৌধুরীর কথা শুনে রাহুল মমতার সঙ্গে রফা করতে রাজি হলেন না, তিনি সিপিএমের সঙ্গে যেতে চান। সত্য হল, মমতা নিজেই কংগ্রেসের সঙ্গে ভোটের আগে জোট করতে রাজি নন। তিনি কেন রাজি হবেন? রাজ্যে আজ তিনিই শেষ কথা। ৪২টা আসনে প্রায় ৪২টাই তিনি দখল করতে মরিয়া। তাই তিনি প্রয়োজনে বোঝাপড়া চান, ভোটের পর। কিন্তু কংগ্রেসের নেতৃত্বে জোটে আস্থা নেই তৃণমূল নেত্রীর।

তবে চন্দ্রবাবুর এই অতিসক্রিয় ভূমিকায় বহু আঞ্চলিক নেতা অখুশিও বটে। ফারুক আবদুল্লা, সীতারাম ইয়েচুরি বাবুর পুরনো বন্ধু। তাঁরা পাশে থাকলেও পওয়ার বা অখিলেশ যাদব কিন্তু বাবুর এই কান্ডারির ভূমিকায় এবং অতি কংগ্রেস ভক্তিতে খুশি নন। বিরোধী রাজনীতির এই জটিলতা, এই ইগোকেন্দ্রিক টানাপড়েন নতুন নয় বাবুর কাছে। আর তাই আপাতত রাহুল-চন্দ্রবাবু অক্ষ অবিচল। বিজেপি চন্দ্রবাবু ও তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে তদন্তের চেষ্টা করেও কিছু পায়নি। বাবুও কাউকে ছেড়ে কথা বলেন না। অমিত শাহের পুত্রের দুর্নীতি থেকে রাফাল, নানা প্রশ্নে সরাসরি মোদীকে আক্রমণের নিশানা করছেন। আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে তিনি সব চেয়ে সরব মোদী-বিরোধী নেতা। চন্দ্রবাবু শেষ পর্যন্ত এই কঠিন ব্রতে সফল হবেন কি না তা দেখার জন্য আমাদের আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে। আজ শুধু এটুকু বলতে পারি, মস্ত বাঁচোয়া, বাবুর কোনও বিতর্কিত ভাই, ভাইপো, শালা বা ভাগ্নে নেই এখনও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন