একুশ শতকের গোড়ার দিকে ইনফোসিস-এর অসামান্য সাফল্যের রূপকার এন আর নারায়ণমূর্তিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কোন মন্ত্রের জোরে এত সফল হলেন তাঁরা? তাঁর স্বভাবসিদ্ধ সংক্ষিপ্ত উত্তর ছিল: প্রতিশ্রুতি কম দিয়ে তার তুলনায় কাজ বেশি করে দেখাও। মোদী সরকারের মন্ত্র ঠিক যেন উল্টো: প্রতিশ্রুতি বেশি, কাজ কম।
স্বপ্ন দেখতে যাঁরা ভালবাসেন, ২০১৪ সাল ছিল তাঁদের স্বর্ণযুগ। অনেক দিন পরে এক জন রাজনীতিক অর্থনৈতিক উন্নয়নকে নিজের নির্বাচনী প্রচারের কেন্দ্রে রেখেছিলেন। জাতপাত নয়, ধর্ম নয়, তাঁর সোজাসাপ্টা জোরদার প্রতিশ্রুতি ছিল: সকলের অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা ভাল করব এবং দুর্নীতি নির্মূল করব। পাঁচ বছর পরে বাস্তব ছবিটা কী দাঁড়াল? একটা দেশের অর্থনীতির স্বাস্থ্য যাচাইয়ের প্রচলিত কয়েকটি মাপকাঠি ব্যবহার করা হবে এই লেখায়। পরিসংখ্যান নেওয়া হবে কয়েকটি স্বীকৃত জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নথি থেকে।
আয়বৃদ্ধি
নরেন্দ্র মোদীর অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল, দ্বিতীয় ইউপিএ জমানায় মন্দাক্রান্ত অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ঘটাবেন তাঁরা। বাস্তব পরিস্থিতি কী? গত ডিসেম্বরে নীতি আয়োগ, রীতিমতো অভূতপূর্ব ভাবেই, সিএসও-র ‘সংশোধিত তথ্য’ প্রকাশ করে। দেখা যায়, এর আগে জিডিপি বৃদ্ধির যে হার পাওয়া গিয়েছিল, সংশোধিত হিসাবে আয়বৃদ্ধির হার তার চেয়ে বেশি— ৭.৩ শতাংশ। ভোট আরও কাছে এল, ৩১ জানুয়ারি সিএসও নতুন সংশোধিত হিসাব প্রকাশ করল। দেখা গেল, জিডিপি বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৭.৭ শতাংশ! অথচ বিশ্বব্যাঙ্কের ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট ইন্ডিকেটরস-এর সাম্প্রতিকতম সংস্করণ অনুসারে, গত ১৫ বছরের মধ্যে মাত্র পাঁচটি বছরে ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এবং, সাম্প্রতিক অতীতে তিন বার ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের নীচে নেমেছে— ২০০৮-০৯ সালের বিশ্ব আর্থিক সঙ্কটের পরে, দ্বিতীয় ইউপিএ জমানার শেষ তিন বছরে (তথাকথিত নীতিপঙ্গুতার পর্বে) এবং নরেন্দ্র মোদীর নোট বাতিলের পরের বছরে।
যিনি বলেছিলেন, মোদীনমিক্স-এর ম্যাজিক দিয়ে ভারতের অর্থনৈতিক শক্তিকে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত করবেন, তাঁকে এখন যদি এই বলে বড়াই করতে হয় যে, তাঁর আমলে জিডিপি বৃদ্ধির হার বছরে গড়পড়তা ৭ শতাংশ (বিশ্বব্যাঙ্কের হিসাব), কিংবা ৭ শতাংশের সামান্য নীচে (সিএসও-র আগের পরিসংখ্যান, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক হ্যান্ডবুক-এর সাম্প্রতিকতম সংস্করণে যা দেওয়া হয়েছে) অথবা মেরেকেটে ৭.৭ শতাংশ (সিএসও-র শেষ সংশোধন), তবে নিতান্ত অন্ধ ভক্ত ছাড়া আর কেউ তাঁর কৃতিত্বে মুগ্ধ হবে কি?
কর্মসংস্থান
তবে জিডিপির অঙ্কে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আর্থিক সঙ্কটের পরিচয় মোটেই মেলে না, এবং মোদীর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা সেই ক্ষেত্রেই। অর্থনীতি চালনায় তাঁর সাফল্য বা ব্যর্থতা যাচাইয়ের জন্য জিডিপি নিয়ে কচকচির চেয়ে অনেক বেশি জরুরি এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যে, গত চার বছরে ভারতের সাধারণ নাগরিকের হাল কতটা ভাল বা খারাপ হয়েছে।
অধিকাংশ মানুষের জীবনে মূল সমস্যা হল জীবিকার সংস্থান। মোদীর প্রতিশ্রুতি ছিল, তিনি ক্ষমতা পেলে দশ বছরে পঁচিশ কোটি চাকরি হবে। মানে, বছরে গড়ে আড়াই কোটি। গৃহস্থালির সমীক্ষার ভিত্তিতে সিএমআইই ২০১৬ সাল থেকে কর্মসংস্থানের যে হিসাব কষছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৭ সালে দেশে মোট কর্মীর সংখ্যা ছিল ৪০ কোটি ৬৭ লাখ। ২০১৮ সালে সেটা কমে দাঁড়ায় ৪০ কোটি ৬২ লাখ, ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারিতে তা ৪০ কোটিতে ঠেকেছে। ২০১৭ সালে নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে ১৮ লাখ, কিন্তু এটা সেই বছরের নতুন কর্মপ্রার্থীর সংখ্যার ১২ শতাংশ, আর মোদী বছরে যে আড়াই কোটি নতুন কাজ দেওয়ার কথা বলেছিলেন, তার ৭ শতাংশ! সিএমআইই-র অন্য এক রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৪ থেকে ২০১৮, এই চার বছরে দেশে কর্মসংস্থানের বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার ছিল ১.৯ শতাংশ। আগের দশকের চেয়ে এই হার কম। অর্থাৎ, ইউপিএ-র দশ বছরে যে হারে নতুন কাজ তৈরি হয়েছিল, গত চার বছরে কাজ তৈরি হয়েছে তার চেয়ে কম হারে।
সরকারি পরিসংখ্যান দেখলে, লেবার বুরো-র হিসাবে, ২০১৫-১৬ সালে বেকারত্বের অনুপাত ছিল ৩.৭ শতাংশ। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থার (এনএসএসও) তথ্য হিসেবে সংবাদমাধ্যমে যা প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখছি, ২০১৭-১৮ সালে বেকারত্বের হার দাঁড়ায় ৬.১ শতাংশ, গত চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশন অনুমোদন করা সত্ত্বেও মোদী সরকার এই রিপোর্টটি প্রকাশ করেনি, এবং সংস্থাটির দু’জন সদস্য এর ফলে পদত্যাগ করেছেন। এই রিপোর্টের আরও উদ্বেগজনক একটি তথ্য: শহরের তরুণদের প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ বেকার! সরকারি নথি থেকে পাওয়া এই পরিসংখ্যান দেখিয়ে দেয়, কর্মসংস্থানে মোদীর রেকর্ড শোচনীয়। শহর ও আধা-শহরে তরুণ কর্মপ্রার্থীর সংখ্যা বছরে গড়ে দেড় কোটি করে বাড়ছে। সেখানে এই ব্যর্থতা বিপুল হতাশা সৃষ্টি করতে বাধ্য।
এই বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সরকার অস্বস্তিকর তথ্য পরিসংখ্যান চেপে দিতে চেয়েছে, অন্তত নির্বাচন অবধি। কিন্তু ইতিমধ্যে সে তথ্য ফাঁস হয়ে গিয়েছে, যার ফলে আন্তর্জাতিক পরিসরে ভারতের তথ্য পরিসংখ্যান সরবরাহের ব্যবস্থা সম্পর্কে আস্থায় বড় রকমের আঘাত লেগেছে, যার পরিণাম সুদূরপ্রসারী হতে পারে। প্রসঙ্গত, দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে ১০৮ জন অর্থনীতিবিদ খোলা চিঠি লিখে অভিযোগ করেছেন যে, ভারতে রাজনৈতিক কারণে পরিসংখ্যানের অপব্যবহার করা হচ্ছে।
কৃষি
কৃষির হাল আরও অনেক বেশি খারাপ। লক্ষণীয়, ভারতের কর্মজীবী মানুষের অর্ধেকই এখনও কৃষিনির্ভর। মোদী কৃষকদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, তাঁরা চাষের খরচের উপর ৫০ শতাংশ লাভ পাবেন এবং ২০২২ সালের মধ্যে কৃষির আয় দ্বিগুণ হবে। সে সবের চিহ্নমাত্রও নেই, উল্টে ভারতীয় কৃষি ব্যাপক সঙ্কটে। ২০১৪ থেকে ২০১৭’র মধ্যে কৃষি আয়ের বৃদ্ধি-হার বার্ষিক গড় ২.৫১ শতাংশ। আগের দশকে (২০০৪-১৪) এই হার ছিল ৩.৭ শতাংশ, তার আগের দশকে (১৯৯৪-২০০৪) ২.৮৮ শতাংশ। আট বছরে কৃষির আয় দ্বিগুণ করতে গেলে আয়বৃদ্ধির বার্ষিক হার অন্তত ৯ শতাংশ হওয়া দরকার। সেটা তো অলীক স্বপ্নমাত্র। বাস্তব হল, আগের দুই দশকের চেয়েও মোদী যুগে কৃষির বৃদ্ধি-হার কম!
গ্রামীণ মজুরি বৃদ্ধির হারও দশ বছরে এত কম কখনও হয়নি। ২০১৮ সালে গ্রামীণ মজুরি মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গেও পাল্লা দিতে পারেনি, অর্থাৎ প্রকৃত মজুরি কমেছে। পাশাপাশি, কৃষিপণ্যের দাম বেড়েছে অন্যান্য পণ্যের চেয়ে অনেকটা কম হারে, নোট বাতিলের পরে নানা ফসলের দাম কমার প্রবণতা বেড়েছে। ফলে কৃষিনির্ভর মানুষের প্রকৃত আয় তথা আপেক্ষিক ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। নোট বাতিলের ধাক্কায় কাজের সুযোগও কমেছে, ফলে কমেছে গ্রাম থেকে অভিবাসনের মাত্রা, গ্রামীণ আয় তার ফলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে ভারতের গ্রামজীবনে এত খারাপ সময় সাম্প্রতিক কালে আসেনি।
শিল্প
গত পাঁচ বছরের আর একটা বড় সমস্যা হল শিল্পবাণিজ্যের মন্দগতি এবং নতুন বিনিয়োগে কর্পোরেট সংস্থাগুলির প্রবল অনাগ্রহ। অদ্ভুত ব্যাপার হল, সরকারি পরিসংখ্যানে যখন জিডিপির দ্রুত বৃদ্ধি দেখানো হচ্ছে, সেই সময়েই, গত চার বছরে, কর্পোরেট মুনাফার হিসাবে মন্দা চলছে! বেশির ভাগ কোম্পানির উৎপাদন ক্ষমতার বিরাট অংশ চাহিদার অভাবে অব্যবহৃত রয়েছে। সেই কারণেই তারা নতুন বিনিয়োগে নারাজ। কলকারখানা, যন্ত্রপাতি ইত্যাদিতে বিনিয়োগের অঙ্ক ২০১৪ সালে ছিল জিডিপির ৩৪.৩ শতাংশ, ২০১৭ সালে সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ৩০.৭ শতাংশ। ইউপিএ আমলে এই অনুপাত ছিল গড়পড়তা ৩৯ শতাংশ, মোদী জমানার গড় হল ৩১.৮ শতাংশ। পাশাপাশি, খাদ্য ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে দেওয়া ব্যাঙ্কঋণের অঙ্কও গত চার বছরে অত্যন্ত কম। সেটাও অর্থনীতির মন্দগতির পরিচয় দেয়। শিল্পক্ষেত্রে প্রদত্ত ব্যাঙ্কঋণের গতিপ্রকৃতি যদি দেখি, তা হলে ছবিটা আরও করুণ।
শিল্পবাণিজ্য সংস্থাগুলি যখন কলকারখানা ও যন্ত্রপাতিতে নতুন বিনিয়োগ করে না, ঋণের ধারা যখন শীর্ণ হয়, তখন কাজের সুযোগ সঙ্কুচিত হওয়াই স্বাভাবিক। এখন ঠিক সেটাই হচ্ছে। বাড়তি চাহিদা আসতে পারত রফতানি থেকে, কিন্তু এই জমানায় সেখানেও ভাটার টান। ২০১৪ সালের আগের দুই দশকে ভারতের রফতানি বছরে গডপড়তা ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ বেড়েছে, গত চার বছরে সেই হার কমে দাঁড়িয়েছে ১.৬ শতাংশ! এর ফলে চলতি খাতে বিদেশি মুদ্রার ঘাটতি অনেকটা বেড়ে ২.৯ শতাংশে পৌঁছেছে। এটাই মার্কিন ডলারের দাম চড়তে চড়তে ৭০ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার একটা বড় কারণ। অথচ এই সময়েই বাংলাদেশ বা ভিয়েতনামের মতো দেশ নানা শ্রমনিবিড় শিল্পে উৎপাদন ও তার পণ্যের রফতানি বাড়িয়ে বিদেশি মুদ্রা উপার্জনের পাশাপাশি কর্মসংস্থানও করতে পেরেছে অনেক বেশি। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগান শুনতে ভাল, কিন্তু মোদী জমানায় অর্থনীতির হাল যা দাঁড়াল তাকে বলা ভাল— ‘মেস ইন ইন্ডিয়া’।
সংগঠিত ক্ষেত্রের বাইরে সঙ্কট গভীরতর। মাঝারি ও ছোট শিল্প (এমএসএমই) নোট বাতিলের অভিঘাত আজও সামলে উঠতে পারেনি। সিএমআইই-র হিসাবে, নোট বাতিলের পরে অসংগঠিত ক্ষেত্রে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। ‘ধর তক্তা মার পেরেক’ কায়দায় জিএসটি চালু করে দেওয়ার ফলেও সমস্যা হয়েছে।
এর সঙ্গে যোগ করতে হবে এনডিএ সরকারের শোচনীয় শিক্ষা নীতি। কলেজ থেকে পাশ করে যাঁরা বেরোচ্ছেন তাঁরা কাজ পাওয়ার যোগ্য হবেন, এটাই স্বাভাবিক লক্ষ্য। অথচ এ দিকে সরকারের কোনও নজর নেই। জাতীয় আয়ের অনুপাত হিসেবে শিক্ষায় সরকারি ব্যয়ের মাত্রা গত চার বছরে কমেছে। শিক্ষা নিয়ে যা কিছু সংবাদ এই জমানায় পেয়েছি, তার প্রায় সবই হল শিক্ষাব্যবস্থায় নানা ভাবে সরকারি হস্তক্ষেপ সংক্রান্ত, তার সঙ্গে আছে শিক্ষার গৈরিকীকরণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে একটা সম্পূর্ণ পশ্চাৎমুখী ‘সবই ব্যাদে আছে’ মার্কা মানসিকতা।
দারিদ্র ও অসাম্য
কিন্তু এটাও পুরো ছবি নয়। প্রথমত, এটা শোচনীয় ব্যাপার যে, ২০১১-১২ সালের পর থেকে দারিদ্রের কোনও সরকারি তথ্যই নেই। তবে আরও ভয়ঙ্কর হল, কোটি কোটি ভারতবাসী যখন বেঁচে থাকার জন্য কঠিন সংগ্রাম করে চলেছেন, তখন ধনীদের আয় ও সম্পদ হুহু করে স্ফীত হচ্ছে। বিশ্বের অর্থনৈতিক অসাম্য নিয়ে অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি ও তাঁর সতীর্থদের তৈরি ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি ডেটাবেস-এর সাম্প্রতিকতম তথ্য অনুসারে, দেশের গড়পড়তা আয় ও সম্পদ যে হারে বাড়ছে, সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশের আয় ও সম্পদ বাড়ছে তার চেয়ে অনেক বেশি হারে। আর, আয় ও সম্পদে নীচের তলার অর্ধেক মানুষের ভাগ ক্রমশই কমছে। এই বাস্তবের পাশে মোদীর ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’ স্লোগান কেমন শোনায়, সেটা নিশ্চয় দেশের মানুষ জানেন।
রাজকোষ পরিচালনা
সরকারি আয়ব্যয়ের ব্যবস্থাপনায় নিজেদের দক্ষতা নিয়ে এই জমানার শাসকরা বিস্তর বড়াই করেন। তাঁদের গর্ব, রাজকোষ ঘাটতিকে ৩.৩ শতাংশে সীমিত রেখেছেন। এটা ঠিকই যে, ইউপিএ-র তুলনায় মোদী সরকার ঘাটতির অনুপাত কিছুটা কমাতে পেরেছে। কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত সিএজি রিপোর্ট বুঝিয়ে দেয়, এর প্রধান কারণ দু’টি: এক, পেট্রোলিয়মের দাম অনেক কমেছে, ফলে সরকার চুপচাপ তার উপরে আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দিতে পেরেছে, পরিণামে কেন্দ্রের রাজস্বও স্ফীত হয়েছে; দুই, কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রদেয় অর্থ বাকি রেখে, চতুর্দশ অর্থ কমিশনের পরামর্শ অনুযায়ী রাজস্বের যে অংশ রাজ্যগুলির প্রাপ্য তার কিছু অংশ বাকি রেখে, এবং অনুরূপ নানা হিসাবের কারসাজি করে খরচ কম দেখানো হয়েছে।
আর রাজস্ব? সরকারের দাবি, জিএসটি প্রবর্তনের ফলে পরোক্ষ করদাতার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। কিন্তু কর আদায়ের অঙ্কে অন্তত তার বিশেষ প্রতিফলন নেই। তেমনই, নোট বাতিলের ফলে অনেক বেশি মানুষ আয়কর দিচ্ছেন— এই ছিল সরকারি দাবি। কিন্তু কেন্দ্রীয় প্রত্যক্ষ কর বোর্ডের (সিবিডিটি) তথ্যে এখনও পর্যন্ত এ দাবির বিশেষ সমর্থন মেলেনি।
আর একটি দাবি— ইউপিএ আমলের তুলনায় মোদীর শাসনে মূল্যবদ্ধির হার কমেছে। এটা ঠিকই, ভোগ্যপণ্যের মূল্য সূচকের বিচারে ইউপিএ আমলে গড় বার্ষিক মূল্যবৃদ্ধি ছিল ৮.১ শতাংশ, এনডিএ আমলে সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ৫ শতাংশ। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতিতে মূল্যবৃদ্ধির গড় হারও এই সময় কমেছে, এবং তার সঙ্গে ভারতীয় বাজারে মূল্যবৃদ্ধির তফাতটা যদি দেখি, ইউপিএ আমলে সেটা ছিল ৩.৭ শতাংশ, এই আমলে ৩.১ শতাংশ। অর্থাৎ মোটামুটি একই। অর্থাৎ, মোদী সরকার মূল্যবৃদ্ধি প্রতিরোধে কিছুটা সফল বটে, তার একটা বড় কারণ হল বিশ্ব বাজারে পট পরিবর্তন। এখানেই মনে করে নেওয়া দরকার মোদী সরকারের একটা বড় সৌভাগ্যের কথা— তাদের বেশির ভাগ সময়টা জুড়েই বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে। বস্তুত, এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে তারা অনেক কিছু করতে পারত, কিন্তু সেই সুযোগ এ সরকার হেলায় হারিয়েছে।
উপসংহার
যে ‘রিফর্মওয়ালা’রা ২০১৪ সালে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিপজ্জনক চরিত্রটিকে জেনে ও বুঝেও এই আশায় তাকে সহ্য করেছিলেন যে আর্থিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে, তাঁরা অর্থনীতির একটি মৌলিক সত্যকে অগ্রাহ্য করেছিলেন: সমস্ত সামাজিক বিভেদ ও বিভাজন ছাপিয়ে এক ধরনের নাগরিক ঐক্য ও সংহতির বোধ না থাকলে ধারাবাহিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। অর্থনীতির ময়দানে এমন করুণ ব্যর্থতার পরেও পাকিস্তানে বিমানহানার ফোলানো-ফাঁপানো প্রচারের উপর ভর করে যদি মোদী শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় ফেরেন, সেটা হবে এক নিষ্ঠুর পরিহাস। সে ক্ষেত্রে আমাদের গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত চরিত্র নিয়ে, এবং দেশের পরবর্তী সরকারগুলির নীতি নির্ধারণ নিয়েও গভীর উদ্বেগের কারণ থাকবে।
সূত্র: The Mirage of Modinomics
(www.theindiaforum.in)