পুলওয়ামা, এয়ার স্ট্রাইক, তিনশো জইশ, মাসুদ আজহার, পাকিস্তান। এবং বেকারত্ব, ঋণ মকুব, বেসরকারিকরণ, শিক্ষায় ব্যয় সঙ্কোচ, নোটবন্দি। বাজারে কিছু শব্দ ঘুরপাক খাচ্ছে। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচন আসতেই যুযুধান হয়েছে দুটো গল্প। এগুলো তার চাবি-শব্দ।
শুক্রবার কোরাপুটের জনসভায় নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, ‘‘এক মাস হয়ে গেল, পাকিস্তান এখনও মৃতদেহ গুনতে ব্যস্ত, আর এরা প্রমাণ চাইছে!’’ সারকথা জাতীয়তাবাদ। শক্তিশালী এক জাতি তৈরি করতে হবে। যারা একসঙ্গে জোটবদ্ধ থাকবে, এক রকম করে কথা বলবে। রাষ্ট্রের (পড়ুন সরকারের) বিপক্ষে কোনও প্রশ্ন তাদের মনে জাগবে না। ব্যক্তিগত সঙ্কটের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবে দেশের সঙ্কটকে। তা হলে বহিঃশত্রু তাকে ভয় পাবে, এবং বহিঃশত্রুকেও সহজেই মোকাবিলা করা যাবে। সেটা কী ভাবে সম্ভব? মোদী বলছেন, যদি মোদী ক্ষমতায় থাকেন, তবেই।
শুক্রবার কার্নালের জনসভায় রাহুল গাঁধী বলেছেন, ‘‘আমাদের সরকার তৈরি হলে দেশের সবচেয়ে গরিব ২০ শতাংশ পরিবারকে বছরে ৭২ হাজার টাকা করে সাহায্য করা হবে।’’ সারকথা সুরক্ষা। নানা কারণে সমাজে যারা সব থেকে পিছিয়ে পড়েছে, তাদের হাত ধরা, একটু উপরে উঠতে সাহায্য করা, নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা তৈরি করা। এবং তার প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরছেন, ছত্তীসগঢ়-রাজস্থান-মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতায় আসার দশ দিনের মধ্যে কৃষিঋণ মকুব করে দেওয়া।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
সাধারণ বুদ্ধি বলে, দুই আখ্যানের মধ্যে দ্বিতীয়টাই জয়ী হওয়ার কথা। কারণ পেটে খেলে পিঠে সয়। আগে খেয়ে পরে নিজের প্রাণ বাঁচুক, তার পরে দেশ, বহিঃশত্রু আরও বহু দূর। তবু, ইতিহাসে জাতীয়তাবাদও জয়ী হয়। কেন? ভয়, নিরাপত্তাহীনতা। কিসের? এই যে আমার অস্তিত্ব, তা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ভয়। চাকরি পরেও পাওয়া যাবে, দিনকয়েক একটু আধপেটা খেয়েও থাকা যাবে, কিন্তু দেশটা পাকিস্তানের হাতে চলে গেলে তখন আমিই কি আর থাকব? আর এ এক নেশার মতো। মজে গেলে অন্য সব বাস্তব লোপ পায়।
ভারতের ইতিহাস কী বলে? ২০১৪ নির্বাচনে প্রধান বিষয় ‘অচ্ছে দিন’। মোদী এলেই ভারতে স্বর্গ নেমে আসবে। ইউপিএ-২ সরকার একের পর এক কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত। সেই কালো টাকা আবার বিদেশে গচ্ছিত। তা ফিরিয়ে আনলেই প্রত্যেক দেশবাসীর অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ করে টাকা ঢুকে যাবে। কংগ্রেসের তখন এমনই হতশ্রী দশা, যে প্রায় কিছুই বলার মতো ছিল না।
২০০৯ নির্বাচনে কংগ্রেসের ঝুলিতে ছিল ‘নরেগা’ বা একশো দিনের কাজ। সামাজিক প্রকল্পের ফলে কী ভাবে গ্রামীণ সমাজ ও পিছিয়ে পড়া অংশ স্বস্তি পেয়েছেন, তা তুলে ধরে বলা হয়েছিল, কংগ্রেস আবার এলে এগুলো চালু থাকবে। বিপরীতে, বিজেপির স্লোগান ছিল ‘কুশল নেতা, নির্ণায়ক সরকার’। লক্ষ্য ‘দুর্বল প্রধানমন্ত্রী’র বিপরীতে ‘লৌহপুরুষ’-এর প্রতিষ্ঠা। সন্ত্রাসবাদ বিরোধিতায় জোর দিয়ে বাজপেয়ী আমলের পোটা আইনের কথাও জোর দিয়ে প্রচার করেছিল তারা।
২০০৪ সালে বিজেপির মন্ত্র ছিল ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’। একটা বড় মধ্যবিত্ত ধনী শ্রেণির গড়ে ওঠার কারিগর হিসেবে নিজেদের দেখিয়েছিল তারা। সঙ্গে কারগিল যুদ্ধ, পোখরানের পরমাণু পরীক্ষার প্রচার তো ছিলই। আর কংগ্রেস তখন ‘প্রাচীনপন্থী’— গরিব, গ্রামীণ, নিম্নবিত্ত ও সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি। লড়াইটা প্রায় দাঁড়িয়েছিল এ রকম— ভারতকে এ প্রান্ত-ও প্রান্তে জুড়ে দেওয়া মাখনের মতো এক্সপ্রেস হাইওয়ে ‘সোনালি চতুর্ভুজ’ বনাম জলসঙ্কট-খরা।
কোন নির্বাচনে কী ফল হয়, জানা। কেন, সেটাই একটু মিলিয়ে নেওয়া গেল। তার ভিত্তিতে এ বারের ভোটের অভিমুখটা একটু কষে নিতে হয়।
প্রথমত, আখ্যান তো হাজির হল। পরের পর্বটাও সমান জরুরি: বাগাড়ম্বর। কে, কেমন করে, কতটা, কী ভাবে নিজের গল্পটা মানুষের কাছে উপস্থাপন করতে পারছে। এমনিতে সাধারণ ভোটাররা কী চান, ‘দেবা না জানন্তি’। ছ’খানা বামফ্রন্ট সরকারের আমলে অবিচার কম হয়নি। তবু, কেন যে সবার রাগ সপ্তমের উপরই গিয়ে পড়ল? বিজন সেতু কিংবা ছোট আঙারিয়া যে মারাত্মক অপরাধ, এটা বোঝার জন্য বাঙালিকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম অবধি কেন অপেক্ষা করতে হল? এ বারের ভোটেও তাই বালাকোট আর ‘ন্যায়’-এর মধ্যে জনতা কোনটা বেছে নেবে, কেউ চোখ বুজে বলতে পারবে না।
দ্বিতীয়ত, চোখ খুলেও কি বলতে পারবে? চেষ্টা করা যেতে পারে। বিজেপির সাংগঠনিক দক্ষতা এখন কংগ্রেসের চেয়ে বেশি। অতএব, নিজেদের আখ্যান প্রচার করা তাদের পক্ষে সহজ হবে। কংগ্রেস যতই সামাজিক ন্যায়বিচারের উপর জোর দেবে, বিজেপি ততই চেষ্টা করবে মজবুত সরকারের তত্ত্ব খাড়া করতে। যদি বিজেপি বোঝেও, রোজগারহীনতার সামনে আর কোনও বিষয়ই দাঁড়াচ্ছে না, তবুও গ্রামে বিদ্যুৎ আর ঘরে ঘরে গ্যাস সিলিন্ডারের কথা নমো নমো করে বলেই মোদী ফিরে যাচ্ছেন সেই শক্তিমান রাষ্ট্রের শরণে। কারণ, সুদিনের স্বপ্ন দ্বিতীয় বার বেচা যায় না। অতএব, পাল্টা কংগ্রেস চাইছে, বার বার আলোচনার অভিমুখ চাকরি না হওয়া বা কৃষক আত্মহত্যার দিকে ঘুরিয়ে দিতে। জাতীয়তাবাদের টক্করের চেষ্টা বোধ হয় কংগ্রেস করবে না, ওতে যে বিজেপি অধিক দড়, সে কথা রাহুল বোঝেন। তাঁরা বলবেন, মানুষের পেটে টান পড়াটাই আসল। তবু, মানুষ কত দূর খারাপ আছে, আর এখন কত দূর সহ্য করতে তৈরি, সেটা ভোটের ফলই বলবে।
তৃতীয়ত, বহু মানুষেরই অভিযোগ নরেন্দ্র মোদীর জমানায় ভারত বদলে যাচ্ছে। এবং ২০১৯-এ যদি তারা ফের ক্ষমতায় আসে, তবে দেশটা চিরতরে বদলে যাবে। কী রকম? বহু ধর্ম, বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতিকে ধারণ করার অভ্যাস ভারতের দীর্ঘদিনের। বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতার আমলে মুসলমান ও খ্রিস্টানদের সামাজিক ভাবে পৃথকীকরণ এবং সর্বত্র হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার মতো অভিযোগ বারবার উঠে এসেছে। কংগ্রেসও বলেছে, বৈচিত্রের ভিতর ঐক্যের সুরের বাঁধা নেহরুর ভারতের বিপ্রতীপে গেরুয়া শিবিরের আদ্যোপান্ত নির্ণীত হতে থাকে নাগপুর থেকে। বস্তুত, অরুণাচল থেকে গুজরাত— এক তারে বেঁধে ফেলতে পারলে, তবেই না জাতীয়তাবাদের আখ্যান সফল। আর যে যার মতো কেবল জীবনসংগ্রাম চালিয়ে গেলে নিজস্ব চাওয়াপাওয়ার দিকেই তাকাতে হয়। তখন বিচিত্র সত্তাটুকু বেঁচে থাকে।
ভারত যদি সত্যিই বদলে গিয়ে থাকে, তা হলে মোদীর আখ্যান জিতবেই। আর না হলে রাহুলের আখ্যান জিততেও পারে। কোন গল্পটা জয়ী হল, তা আসলে এও বুঝিয়ে দেবে যে কোন ভারত জয়ী হল। তত দিন, টক্কর চলুক নিজস্ব ঝুলি আর বুলি নিয়ে।