কমল হাসন। —ফাইল চিত্র।
এত দিন তর্ক শোনা যাইত, বিপ্লবী আর সন্ত্রাসবাদী এক কি না, সেই বিষয়ে। আর এখন, তর্ক শুনিতে হইতেছে, আততায়ীকে সন্ত্রাসবাদী বলা যায় কি না, তাহা লইয়া। সম্প্রতি নাথুরাম গডসেকে স্বাধীন ভারতের ‘প্রথম হিন্দু সন্ত্রাসবাদী’ আখ্যা দিয়া বিজেপির ঘোর আক্রমণের মুখে পড়িয়াছেন রাজনীতিতে নবাগত নেতা তথা দক্ষিণী অভিনেতা কমল হাসন। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীকে নাথুরাম গডসে যে ভাবে খুন করিয়াছিলেন, তাহাতে বলা যায় তাঁহাকে দিয়াই হিন্দু সন্ত্রাসবাদ এ দেশে শুরু হইয়াছিল— ইহাই ছিল তাঁহার মন্তব্য। মন্তব্যটিকে স্বভাবতই ‘হিন্দুবিরোধী’ বলিয়া ঘোষণা করিতে ব্যস্ত বিজেপি ও আরএসএস নেতাকর্মীরা। দুইটি যুক্তি শোনা যাইতেছে। এক, কোনও ব্যক্তি খুনি হইলেই কি তাহাকে সন্ত্রাসবাদী বলা যায়? এবং দুই, এক জন খুনির জন্য কি গোটা হিন্দুত্ববাদের মধ্যেই সন্ত্রাসের সন্ধান করা উচিত? যুক্তি দুইটি ঈষৎ হাস্য উদ্রেক না করিয়া পারে না। স্পষ্ট বুঝা যায়, হিন্দুত্ব-প্রচারকদের ভাবনায় অযুক্তির অনেকখানি মিশেল আছে বলিয়াই তাঁহারা নিজেদের জন্য এক রকম মানদণ্ড ব্যবহার করিতে পারেন, অন্যদের জন্য আর এক রকম। তাই, পুলওয়ামা হামলায় ভারতীয় সেনাদের মারিল যাহারা, তাহাদের সন্ত্রাসবাদী বলিয়া চেনা সহজ হয়, কিন্তু মহাত্মা গাঁধীর সামনে দাঁড়াইয়া কয়েকটি বুলেটে যিনি আজীবন অহিংস নেতার প্রাণবায়ু বাহির করিয়া দেন, তিনি— নেহাত ‘খুনি’ বা ‘আততায়ী’। সম্ভবত এই যুক্তি শুনিতে পাইলে সবচেয়ে বেশি দুঃখ পাইতেন নাথুরাম গডসে নিজে। না, খুনি বা আততায়ীর কোনও আদর্শ থাকে না, প্রাণনাশের মাধ্যমে কোনও ‘মহৎ’ লক্ষ্যে পৌঁছাইবার ব্রত থাকে না। গডসে-র কিন্তু তাহা বিলক্ষণ ছিল। এই হত্যাকর্মের মাধ্যমে একটি গভীর সামাজিক ব্রত পালন করিতেছেন তিনি, এমনই ভাবিয়াছিলেন গডসে— পুলওয়ামার জঙ্গিরা যাহা ভাবিতেছিল, ঠিক তাহাই।
দ্বিতীয় যুক্তিটি, অবশ্যই, না মানিয়া উপায় নাই। তাহাই তো। একটি-দুইটি মানুষের কুকর্মের জন্য একটি গোটা ধর্মসমাজ ও ধর্মবোধ বিষয়ে কোনও ধারণা তৈরি করা নিশ্চয় অত্যন্ত ভুল কাজ। অভিনেতা বিবেক ওবেরয় খেপিয়া গিয়া প্রশ্ন করিয়াছেন, গডসে এক জন সন্ত্রাসবাদী, এইটুকু বলিলেই যেখানে যথেষ্ট হইত, সেখানে ‘হিন্দু’ কথাটি অতিরিক্ত ভাবে উল্লেখ করিবার দরকার কী। বাস্তবিক, ইহা একেবারে গোড়ার প্রশ্ন। কমল হাসনের ইহা অবশ্যই মনে রাখা উচিত ছিল। এবং বিবেক ওবেরয়দেরও মনে রাখা উচিত ছিল, গত পাঁচ বৎসরে এবং সারা জীবনে, যত বার তাঁহারা ‘সন্ত্রাসবাদী’ শব্দের আগে ‘মুসলিম’ বা ‘ইসলামি’ শব্দটি ব্যবহার করিয়াছেন, কত অন্যায় করিয়াছেন! পুলওয়ামার কথা না-হয় ঊহ্য রহিল। গুজরাতের গোধরায় কিছু মানুষের কুকর্মের জন্য যখন নারীশিশুঅথর্ব-নির্বিশেষে মুসলিমদের জবাই করা হইয়াছিল, কিংবা উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরপুরে যখন গোটা অঞ্চলের মুসলিমদের আশ্রয়হীন করিয়া প্রতিশোধ লওয়া হইয়াছিল, তখন কিন্তু বিবেক ওবেরয়দের রাজনৈতিক বন্ধুরা এই সব যুক্তির কথা ভুলিয়া গিয়াছিলেন। তখন তাঁহাদের নিকট সন্ত্রাস শব্দটির একটিমাত্র ধর্মপরিচয় ছিল। আর বিপরীত দিকে যাহা ছিল, ‘সন্ত্রাস’-এর বদলে তাহা কেবল ন্যায়প্রতিষ্ঠার আবেগ।
আরএসএস বা বিজেপির এই দ্বিচারিতা নূতন ব্যাপার নহে। তবে এডিএমকে নেতারাও যখন হিন্দু জাতির উপর দোষারোপ করিবার ‘দোষ’-এ কমল হাসনের ‘জিভ কাটিয়া লইবার’ কথা বলেন, তখন বুঝা যায় মোদী রাজত্বের সংস্কৃতি কী ভাবে দেশব্যাপী প্রসারিত হইয়াছে। হিন্দুত্বের নামে সকল কুযুক্তিই এখন গা-সহা, শারীরিক নির্যাতনের হুমকি এখন রাজনীতি। সুতরাং অক্লেশে জিভ কাটিবার কথা যাঁহারা বলেন, তাঁহারাও দুর্বৃত্ত দুরাচারী নহেন, সন্ত্রাসবাদী তো নহেনই— নেহাত সদাচারী সচ্চরিত্র রাজনীতিক।