ভোট প্রচারের বাজারে ব্রাত্য শিশুর মৌলিক অধিকার

অসংখ্য ভোলাদের দিন কাটছে চায়ের দোকানে বাসন ধুয়ে, স্টেশন-প্ল্যাটফর্মে জুতো পালিশ করে। শৈশব বিকিয়ে অথবা শিশুপাচারকারীর খপ্পরে পড়ে। তাদের কথা ভাবছে কে? লিখছেন দীপক সাহাভোট মরসুমে তাদের খেলার সরঞ্জাম রাজনৈতিক দলের লাল-নীল-সবুজ-গেরুয়া  পতাকা। ছেঁড়া পতাকা নিয়েই ভোলা পাড়ার আর সব কচিকাঁচার সঙ্গে হইচই, হুল্লোড় করেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটিয়ে দিচ্ছে।

Advertisement

দীপক সাহা

শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৯ ০১:২৩
Share:

ঠিকানা, বিলপাড়, শিকারপুর। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী নদিয়া জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম। ভোলা সর্দার। বয়স ছয় বছর।

Advertisement

এই পাড়ার সব বাচ্চার দারিদ্রক্লিষ্ট চেহারাকে আলাদা করে চিহ্নিত করা কঠিন। সব বাচ্চাকেই এক মনে হয়। প্রত্যেকের চোখে-মুখে সারল্যের ছাপ লেপ্টে আছে। ভোট মরসুমে তাদের খেলার সরঞ্জাম রাজনৈতিক দলের লাল-নীল-সবুজ-গেরুয়া পতাকা। ছেঁড়া পতাকা নিয়েই ভোলা পাড়ার আর সব কচিকাঁচার সঙ্গে হইচই, হুল্লোড় করেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটিয়ে দিচ্ছে। মা দশ কিমি দূরে সীমান্ত শহর করিমপুরে অফিসবাবুদের ফ্ল্যাটে কাজ করেন। বাসনমাজা, ঘরমোছার। প্রতি দিন সকালে বেরিয়ে যান। বাবা কোথায় যান ভোলা জানে না। অনেক রাতে চুল্লু খেয়ে বাবা ফেরেন। মাঝরাতে চিৎকার-চেঁচামেচিতে ভোলার ঘুম ভেঙে যায়। মা-বাবার মধ্যে খিস্তিখেউড়ের বান রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে দেয়। ভোলা ভয়ে তেলচিটে বালিশে মুখ গুঁজে চুপটি করে থাকে। পরের সকালে বাবা আবার বেরিয়ে যান। মা-ও বাবুদের ফ্ল্যাটের দিকে হনহনিয়ে রওনা দেন।

দ্বিতীয় চিত্র। দৈনিক এক বাংলা পত্রিকায় প্রকাশ, শিলিগুড়ি ও তার আশেপাশে বস্তি এলাকাতে বহু শিশু কিশোর এখন ভয়ঙ্কর নেশায় ডুবে যাচ্ছে। এই সব শিশু-কিশোরের ভোট নেই। কিন্তু তবুও গত ভোটের দিন তাদের বুথের কাছে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে। উদ্দেশ্য কিছু ভিক্ষা পাওয়া। সেই ভিক্ষার টাকায় সকলের অলক্ষ্যে তারা নিভৃতে নেশায় মগ্ন। কেউ সিগারেটে গাঁজা ভরে টানছে, কেউ ডেনড্রাইট বা অন্য নেশায় আচ্ছন্ন। এরা স্কুলের দরজায় টোকা মারতে পারেনি। চরম দারিদ্র ও তাচ্ছিল্যকে সঙ্গী করে অন্ধ গলিপথে তারা পা বাড়ায় অপরাধ জগতে।

Advertisement

এই রকম খন্ড খন্ড ভোলাদের সাদা-কালো-রঙিন গল্প ছড়িয়ে আছে দেশের আনাচে-কানাচে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ইস্তাহারে ঝলমলে মনধাঁধানো প্রতিশ্রুতির ঢেউ। কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহার ‘হাম নিভায়েঙ্গে’র পাল্টা জবাব বিজেপির ইস্তাহার ‘সংকল্প পত্র’। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে বাম, ডান, মধ্য কোনও দলের ইস্তাহারে শিশুদের অধিকার নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য নেই।

পড়ন্ত বেলায় মাঝে মাঝে কলোনিতে ঢুকে বাচ্চার মা-বাবাকে খুশি করতে সর্দি-গড়ানো নাকের ডগা টিপে আলতো আদর করে এসি গাড়িতে উঠেই লিকুইড স্যানিটাইজারে আঙুল পরিষ্কার করে নিচ্ছেন প্রার্থীরা। সে দিন আমাদের পাড়ার প্রবীণ নাগরিক সাধন জ্যেঠু চায়ের দোকানে লাঠি ঠুকে বলছিলেন, ‘‘ভোটযুদ্ধের সংখ্যাতত্ত্বে বাচ্চারা মিসিং। কারণ তাদের ভোটাধিকার নেই। ফলে তারা রাজনৈতিক দলের হিসেবের খাতার বাইরে।’’ অকাট্য যুক্তি। ভোটের ঢক্কাধ্বনিতে ধামাচাপা পড়ে যায় শিশুদের বঞ্চিত করার মৌলিক অধিকারের পরিসংখ্যান। ভোটের বাজারে রাজনীতির ধারক-বাহকেরা বলেন না, আমাদের দেশে জন্মের ২৯ দিনের মধ্যে যে সমস্ত শিশু মারা যায়, তাদের মধ্যে ৪৮.১ শতাংশ শিশু জন্মায় অত্যন্ত কম ওজন নিয়ে। ভোটের প্রচারে বিষয় হয় না— ভারতে ছয় বছরের নীচে ১৯.৮ মিলিয়ন শিশু অপুষ্টিতে ভোগে। ভোটের খবরে স্থান পায় না— ৬ মাস থেকে ৫ বছরের শিশুদের প্রায় ৫৮ শতাংশই রক্তাল্পতার শিকার। তাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন শৈশব অপুষ্টির ভাঁড়ারকে আরও পুষ্ট করে হারিয়ে যায় অপরাধ জগতের অন্ধকার অলিগলিতে। যে শিশুর শৈশব হেলায় পদদলিত করেছে রাষ্ট্র, সেই শিশুকে অপরাধী তকমা জুড়ে দেওয়া কতটা ন্যায়সঙ্গত, তা নিয়ে তর্কযুদ্ধ চলতেই থাকে। মীমাংসা অধরা।

পাহাড়প্রমাণ উপেক্ষা, অবহেলা, চুরি-যাওয়া শৈশবের অমীমাংসিত প্রশ্নগুলোর উত্তর কেমন যেন কেন্নোর মতো গুটিয়ে যায় ভোট আসলেই। রাম-রহিম তরজা, পুলওয়ামা কাণ্ডের পর সার্জিক্যাল স্ট্রাইক কার ভোটঝুলিকে ভারী করল, রোহিঙ্গাদের কে কতটা বুকে টেনে নিল না ছুড়ে ফেলে দিল, দলিত না চলিত ভোট, কৃষকদের পরমবন্ধু হওয়ার আপ্রাণ কৃত্রিম চেষ্টা, বেকারদের দিবাস্বপ্নকে আরও রঙিন করা, নীরব না সরব মোদী, নোটবন্দি না দুর্নীতি, উন্নয়ন রাস্তায় না ভাগাড়ে— এই সব বর্ণময় আলোচনার ঢক্কানিনাদ শব্দের ডেসিবেল সীমা পার হয়ে যাচ্ছে প্রতি দিনই। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ভোট উৎসবে ঢাকে কাঠি পড়ে। নিয়ম করে জনতার দরজায় করজোড়ে হাজির হন ভোটভিক্ষুকের দল। তাঁদের প্রতিশ্রুতির বাহারি পসরা নিয়ে। আর নিরীহ সাধারণ মানুষ তাঁদের কথার যাদুমন্ত্রে সম্মোহিত হয়ে আবার ভোটের লাইনে পা মেলান।

প্রতিশ্রুতির দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর তালিকায় ঠাঁই পায় না ভোলাদের সংবিধানস্বীকৃত মৌলিক অধিকারগুলি। তালিকায় বাদ পড়ুয়াদের মিড-ডে মিল ও অঙ্গনওয়াড়ি বাচ্চাদের ক্যালোরিযুক্ত পুষ্টিকর খাবারের সংস্থান, নেই দরিদ্র বাচ্চাদের স্কুলমুখী করার বাস্তব পরিকল্পনা। শিশুর (১২-২৩ মাস) দৈহিক ও প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নতির জন্য উল্লেখযোগ্য সময় ১২ মাস থেকে ২৩ মাস। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, আমাদের দেশে ৭২.৫ শতাংশ শিশুর ঠিক সময়ে টিকাকরণ হয় না। সরকারি নথি বলছে, উচ্চ-প্রাথমিক পর্যায়ে স্কুলে ভর্তির হার সারা দেশে মাত্র ৫০ শতাংশ। বুনিয়াদি শিক্ষায় স্কুলছুটের গড় হার ৪০ শতাংশের বেশি। ৬০ শতাংশ প্রাথমিক স্কুলে মাত্র দু’জন শিক্ষক। ২০০০ সাল থেকে তার পরবর্তী পর্যায়ে পাঁচ বছরের কমবয়সী তফসিলি জাতি ও উপজাতির ক্ষেত্রে শিশুমৃত্যুর গড় হার ৫৯ শতাংশ।

কিন্তু নির্বাচনের বাজারে সাধারণ শিশুদের প্রতি সব পক্ষই উদাসীন, নির্লিপ্ত। সারা দেশ জুড়ে ১৭ কোটিরও বেশি শিশুর ক্ষেত্রে কোনও না কোনও মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়ে চলছে প্রতিনিয়ত। শিশুমৃত্যু, শিশুর অপুষ্টি, শিশুশিক্ষা, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম, শিশুদের উপর যৌননির্যাতন প্রভৃতি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি ভোট প্রচারের মানচিত্রে দাগ কাটতে পারে না।

আরও অসংখ্য ভোলাদের দিন কাটছে চায়ের দোকানে বাসন ধুয়ে, স্টেশন-প্ল্যাটফর্মে জুতো পালিশ করে, ইটভাটায়, বাজি কারখানায়, গ্যারেজে, বিড়ি বাঁধার কাজে শৈশব বিকিয়ে অথবা শিশুপাচারকারীর খপ্পরে পড়ে। অন্য দিকে ভোলার মা-বাবার ভোটে বলীয়ান হয়ে নেতাদের সন্তানেরা বিলাসবহুল স্কুল,কলেজ, হাসপাতালের সুযোগসুবিধা ভোগ করছে। রাজনীতির পাশাখেলায় ভোলার বাবা-মায়ের ভোটকে হাতিয়ার করে কিস্তিমাত করছে রাজনৈতিক দলগুলি। শিশুদের বর্ণহীন শৈশবের অধিকার সুরক্ষায় রাজনৈতিক দলগুলি আশ্চর্যজনক ভাবে ভীষণ নীরব। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় নেলসন ম্যান্ডেলার বিখ্যাত উক্তি— ‘‘There can be no keener revelation of a society's soul than the way in which it treats its children.’’

শিকারপুর উচ্চ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন