নীরবতা যে সর্বদা হিরণ্ময় নহে, নরেন্দ্র মোদীকে দেখিয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাহা শিখিতে পারিতেন। অমিতবাক প্রধানমন্ত্রী কিছু নির্দিষ্ট প্রসঙ্গে মুখে কুলুপ আঁটিয়া থাকেন। অথবা, এত বিলম্বে, এত কম কথা বলেন যে তাহা নীরবতারও বাড়া। নীরবতাই এই প্রশ্নগুলিতে তাঁহার অবস্থান স্পষ্ট করিয়া দেয়। তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধ হওয়ার প্রসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীরবতাও তীব্র হইয়া উঠিতেছে? সুপ্রিম কোর্টের রায় প্রকাশিত হওয়ামাত্র দেশের সব প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়া শোনা গেল। বিজেপি ও তাহার সহধর্মী দলগুলিকে বাদ রাখিলেও, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ পরিসরে যে দলগুলির অবস্থান, তাহারা প্রত্যেকেই এই রায়কে স্বাগত জানাইয়াছে। ব্যতিক্রম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁহার অথবা তৃণমূল কংগ্রেসের কোনও যথার্থ প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় নাই। মুখ্যমন্ত্রী ধর্মাচরণে হস্তক্ষেপ বিষয়ে যাহা বলিয়াছেন, তাহা যদি সমগ্র বিষয়টি এড়াইয়া যাইবার কৌশল হয় তবে তাহা দুর্ভাগ্যজনক, আর যদি তিন তালাককে সমর্থন করিবার সংকেত হয় তবে তাহা বিপজ্জনক। এবং, তাঁহারই মন্ত্রিসভার সদস্য, জামিয়তে উলেমায়ে হিন্দ-এর রাজ্য সভাপতি সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী সভা ডাকিয়া আদালতের রায়কে ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণা করিয়া দিলেন। ঘটনাক্রমে, জামিয়তের মঞ্চ হইতেই তৃণমূল কংগ্রেসের উঁচু দরের নেতারা তিন তালাকের পক্ষে সওয়াল করিয়াছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর ‘নীরবতা’ এবং সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীদের আস্ফালন যে বার্তাটি প্রেরণ করিতেছে, তাহা ইতিবাচক নহে।
তালাক-ই-বিদ্দতের ন্যায় একটি অন্যায় ব্যবস্থা নিষিদ্ধ হইলে সেই সিদ্ধান্তকে স্বাগত না জানাইবার মধ্যে একটি নৈতিক প্রশ্নচিহ্ন থাকিয়া যায়। কিন্তু, নৈতিকতার বাহিরে রাজনীতির নিজস্ব সমীকরণেও এই নীরবতা বিপজ্জনক। রাজনৈতিক স্বার্থের নিরিখে সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর সহিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনপনেয় ফারাক রহিয়াছে। ইদানীং রাজ্যে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত লইয়া তৃণমূল কংগ্রেস দৃশ্যত উদ্বিগ্ন। হিন্দু ভোট যাহাতে হাতছাড়া না হয়, তাহা নিশ্চিত করিতে দল সচেষ্ট। তাঁহারা বিলক্ষণ জানিবেন, তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিজেপির প্রধানতম অস্ত্রটি হইল সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ। তালাক-ই-বিদ্দতের পক্ষে অবস্থান লইলে, বা এই প্রথা নিষিদ্ধ হওয়ার পক্ষে না দাঁড়াইলে সেই অভিযোগকে এক প্রকার মান্যতা দেওয়া হয় না কি?
এবং, নিতান্ত মুসলমান সমাজে জনপ্রিয়তার হিসাবেও নীরবতার সিদ্ধান্তটি যুক্তিসংগত না হইতে পারে। তিন তালাকের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ তুলিবার পিছনে মুসলিম মহিলারাই ছিলেন অগ্রণী। সুপ্রিম কোর্টে যখন মামলা চলিতেছিল, তখন মুসলমান সমাজের অভ্যন্তর হইতেই বহু ভিন্ন স্বর শোনা গিয়াছিল। শুধু মহিলা কণ্ঠস্বর নহে, সমাজে বিভিন্ন অংশের মানুষ তিন তালাকের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান ঘোষণা করিয়াছিলেন। অর্থাৎ, মুসলমান সমাজ যে কোনও একশৈলিক অস্তিত্ব নহে, এই বাস্তবটি রাজনীতিকদের সম্মুখে প্রকাশিত হইয়াছিল। অতএব, যে নেতারা মুসলমান ভোটব্যাংককে গুরুত্ব দেন, তাঁহাদের পক্ষেও এই সমাজকে তাহার বহুত্বে না দেখিয়া উপায় নাই। পুরুষতন্ত্রের কণ্ঠস্বরই যে একমাত্র নহে, এই কথাটুকু মনে রাখিলেই সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীদের সহিত নিজের অবস্থানের ফারাক রাখা সহজ হইবে।