ভুল হইয়াছে, এ কথাটি বলিবার অনেক রকম পদ্ধতি হয়। তন্মধ্যে একটি পদ্ধতি কিন্তু ভবিষ্যৎ ভুলসমূহের অজুহাত হিসাবে কাজ করে। অর্থাৎ ভুল তো হইতেই পারে বলিয়া ভাবী ভুলগুলির পথ আগে হইতে প্রশস্ত রাখা যায়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামের বক্তৃতায় ‘পুলিশেরও ভুল হয়’ বলিয়া সাধারণ বা নিত্য বর্তমান কালের তারে ভুলস্বীকৃতিটিকে বাঁধিলেন, তাহার মধ্যে যেন ভবিষ্যতের অজুহাতের একটি ছায়া উঁকি দিয়া গেল। কেন এই আশঙ্কা, খুলিয়া বলা দরকার। প্রথমত, যে মুখ্যমন্ত্রী নিজে পুলিশমন্ত্রী, তিনি কেনই বা নিজমুখে বলিবেন, পুলিশের ভুল হইতেই পারে। অতীত ভুলগুলিকে প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে না দেখিয়া আত্মসমালোচনা (অন্তত প্রকাশ্যে) করাই ভাল ছিল। বিশেষত পুলিশের অনুষ্ঠানে গিয়া আত্ম-প্রশংসায় মাতিয়া ওঠা— উদ্বেগজনক তো বটেই। দ্বিতীয়ত, গত কয়েক বৎসরে ক্ষেত্রবিশেষে পুলিশের নিষ্ক্রিয় থাকিবার ও ক্ষেত্রবিশেষে পুলিশের অতিসক্রিয় হইয়া উঠিবার খেসারত যে ভাবে রাজ্যের নাগরিককে দিতে হইয়াছে, এমনকি বিচারবিভাগও যে বিষয়ে প্রশ্ন তুলিয়াছে— সেই পরিস্থিতিতে নিজেদের পিঠ চাপড়ানো রীতিমতো অনুচিত। প্রশাসনিক ব্যবস্থার সর্বোচ্চ মুখ, এবং পুলিশ বিভাগের সর্বোচ্চ কর্তা মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই ভোলেন নাই এই ‘ক্ষেত্র’গুলির কথা, বিশেষত যখন রাজনৈতিক রঙের ভিত্তিতেই ‘ক্ষেত্র’গুলি বিশেষ হইয়া উঠিয়াছিল বলিয়া অভিযোগ।
পুলিশের ‘ভুল’-এর কথায় নাগরিক স্মরণপথে প্রথমেই ধাক্কা দিবে এই বৎসরেরই প্রথম ভাগে অনুষ্ঠিত পঞ্চায়েত ভোটের কথা। সাধারণ মানুষ তখন সর্বত্র নাকাল হইতেছিলেন। পোলিং বুথে কর্মরত মানুষ শাসক দলের গুন্ডাবাহিনীর হাতে নিহত ও আহত হইতেছিলেন। গোটা সমাজ দেখিয়া শুনিয়া শিহরিত হইয়া উঠিয়াছিল। শিহরনের সর্বপ্রধান উৎস, পুলিশের ভূমিকা। এই রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা কোনও কালে দলরং-নিরপেক্ষ নহে। কিন্তু শাসকের মুখাপেক্ষিতার এতখানি বাড়াবাড়িও পশ্চিমবঙ্গ আগে দেখে নাই। তৃণমূল সরকারের প্রথম পাঁচ বৎসরেও ‘বাড়াবাড়ি’ দৃষ্ট হইয়াছে। সাংবাদিক কিংবা চিত্রগ্রাহককে পিটাইয়া মারায় পুলিশের সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়তা, কিংবা নেহাত মোবাইল বার্তা বিনিময়ের দায়ে নাগরিককে রাতারাতি হাজতে পুরিবার সক্রিয়তা এ রাজ্য ভোলে নাই। মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ, তাঁহার সে দিনের বক্তব্যে নূতন করিয়া দুঃসহ স্মৃতিগুলি জাগিয়া উঠিল।
নেত্রী তাঁহার নিজস্ব বাহিনীর ভুলকে ক্ষমাসুন্দর চোখে না দেখিলে নানা প্রশাসনিক কুকার্যের দায়িত্ব হইতে নিজেকে অন্তত খানিকটা দূরে রাখা সম্ভব। ভুল-উল্লেখের সূত্রে সংশোধনের কথাও ভাবা সম্ভব। তেমন কোনও অভীপ্সা কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে ফুটিয়া উঠিল না। অতীতে যাহা ঘটুক না কেন, ভবিষ্যতে ভাল কাজ করিয়া দেখাইবার প্রতিশ্রুতিটিও ফুটিল না। অথচ অন্যান্য ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অননুকরণীয় ভাবে প্রশাসনিক দুর্বলতা কিংবা ব্যর্থতার সংশোধন করিবার বার্তা দিতে পারেন। কিছু দিন আগেই তিনি বিভিন্ন দফতরকে ফেলিয়া রাখা কাজের দ্রুত নিষ্পত্তি করিবার আদেশ দিয়াছেন। দুর্ভাগ্য পশ্চিমবঙ্গের, পুলিশ বিভাগের জন্য একটিও ভর্ৎসনাবাক্য, কিংবা নিদেনপক্ষে নির্দেশবাক্যও মেলে নাই।