অতএব সে দিনের কালাহান্ডি থেকে এক পা-ও এগোইনি আমরা

একেই কি বলা হয় ‘সদগতি’? এ ভাবেই কি ‘সদগতি’ হয়? তাই যদি হয়, তা হলে দানা মাঝির স্ত্রীয়ের একটা সদগতি শেষ পর্যন্ত হয়েই গেল। মৃতদেহ কাঁধে ফেলে ৬০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার লক্ষ্যে দানা মাঝি হাঁটা শুরু করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু ১০ কিলোমিটারের মাথায় এক সহৃদয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৬ ০২:৫২
Share:

স্ত্রীর মৃতদেহ নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দানা মাঝির। ছবি: ফেসবুক।

একেই কি বলা হয় ‘সদগতি’? এ ভাবেই কি ‘সদগতি’ হয়?

Advertisement

তাই যদি হয়, তা হলে দানা মাঝির স্ত্রীয়ের একটা সদগতি শেষ পর্যন্ত হয়েই গেল। মৃতদেহ কাঁধে ফেলে ৬০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার লক্ষ্যে দানা মাঝি হাঁটা শুরু করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু ১০ কিলোমিটারের মাথায় এক সহৃদয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। অতএব স্ত্রীয়ের শব আর কাঁধে করে বইতে হল না।

প্রায় তিন দশক পরে আবার শিরোনামে কালাহান্ডি। সৌজন্যে দানা মাঝি, তাঁর মৃতা স্ত্রী এবং অসহায় শবযাত্রায় দানা মাঝির এক মাত্র সঙ্গী তাঁর কিশোরী কন্যা।

Advertisement

স্বাধীনতার সাত দশক পরে আবার এই ভাবে শিরোনামে আসতে হল কালাহান্ডিকে! মারণ অনাহার এর আগের বার শিরোনামে এনেছিল সে সময়ের বুভুক্ষু কালাহান্ডিকে। সে-ও প্রায় স্বাধীনতার চার দশক কেটে যাওয়ার পর। দেশ জুড়ে ধিক্কার উঠেছিল। কেমন সে স্বাধীনতা, কী লাভ সেই স্বাধীনতায়, যে স্বাধীনতা নাগরিকের অন্নসংস্থানটুকু করতে পারে না চারটে দশক কাটিয়ে দিয়েও? খুব বড় হয়ে উঠেছিল এই প্রশ্নটা। দারিদ্র্য, অভাব, অপুষ্টি, নিঃস্বতা, রিক্ততা, অবহেলা, অসহায়তা— এই সব ক’টা শব্দের সমার্থক হয়ে উঠেছিল যেন কালাহান্ডি নামটা সে সময়।

ভারতীয় গণতন্ত্রের গা থেকে সেই দাগটা কিন্তু তার পর ক্রমে ফিকে হতে শুরু করেছিল। কালাহান্ডির প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া, দেশের অন্যান্য ক্লিষ্ট প্রান্তের খোঁজখবর রাখা, দুঃস্থ নাগরিককে খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানটুকু অন্তত জুটিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে আর একটু যত্নশীল হওয়া— শুরু হয়েছিল দেরিতে হলেও। তার পরও কি আমরা আমলাশোল দেখিনি? তার পরও কি খাদ্যের অভাবে নাগরিককে আমের আঁটি সিদ্ধ করে খেতে দেখিনি? দেখেছি। তাতেও নিজেদের ধিক্কার দিয়েছি। আর কোনও সহ-নাগরিককে এমন ক্লিন্ন জীবনে দেখতে চাই না বলে সোচ্চার হয়েছি। ফলে ভর্তুকি মূল্যে খাদ্যশস্য সরবরাহ শুরু হতে দেখেছি, কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প দেখেছি, খাদ্য সুরক্ষার আইনও দেখেছি।

এত কিছু দেখার পর কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিলাম হয়তো অনেকেই। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, এক পা-ও এগোতে পারিনি। বহিরঙ্গে ঔজ্জ্বল্য বেড়েছে। কিন্তু অন্তরের নানা বাঁকে এখনও অন্ধকার জমাট। বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী ১০ দেশের তালিকায় ভারত আজ সপ্তম স্থানে। এমনই প্রকাশ এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায়। সেই একই সময়-বিন্দুর উল্টো পিঠে দানা মাঝির বাস। সাত দশক ধরে ‘স্বাধীনতা’ ভোগ করতে থাকা এক দেশে যক্ষ্মায় আক্রান্ত স্ত্রীয়ের চিকিৎসা করাতে দানা মাঝিকে এখনও বাড়ি থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে যেতে হয়। এখনও যক্ষ্মার নিরাময় হয় না। এখনও যক্ষ্মার চিকিৎসার খরচটুকু জোগাতে নাগরিক কপর্দকহীন হয়ে পড়েন। আর তার পর স্তম্ভিত করে দেওয়া একটা ছবি উঠে আসে। মৃতা স্ত্রীকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে যেতে শব কাঁধে নিয়ে ৬০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য দানা মাঝিকে দৌড় শুরু করতে হয়।

এ দেশে সূর্যোদয়টা হয়েছে। কিন্তু সর্বোদয়টা হয়নি। মহাত্মা গাঁধীকে জাতির জনক বলে ডেকেছি। কিন্তু জনকের নীতির অনুসারী হতে পারিনি। সম্পদ আহরণের দৌড়ে শতাধিক রাষ্ট্রকে পিছনে ফেলে দিয়েছি। কিন্তু দেশের আসল সম্পদ যে মানুষগুলো, তাঁদের এক বিরাট অংশকে কোন অন্ধকার গহ্বরে ফেলে রেখেছি, সে খবর নিজেরাই ঠিক মতো রাখি না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন