মাওবাদীরা কী চান?

নকশালবাড়ির অনুপ্রেরণায় যে অসংখ্য দল রয়েছে সারা দেশে, তারা প্রায় প্রত্যেকেই বহু দিন আগেই চারু মজুমদারের ‘ব্যক্তি খুন’-এর তত্ত্বকে খারিজ করেছে, অনেকেই নিয়মিত নির্বাচনেও অংশ নেয়। ব্যতিক্রম শুধু সিপিআই (মাওবাদী)।

Advertisement

দেবত্র দে

শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৮ ০১:০০
Share:

ফাইল চিত্র।

ছত্তীসগঢ়ে আগামী বিধানসভা নির্বাচনের জন্য খবর করতে যাওয়া এক চিত্রসাংবাদিকের মাওবাদীদের হাতে নিহত হওয়ার ঘটনা আবারও কিছু পুরনো প্রশ্নকেই খুঁচিয়ে তুলছে যার অধিকাংশ উত্তরও সম্ভবত জানা। নকশালবাড়ির অভ্যুত্থানের পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করে একান্ন বছরে পা দিয়েছি আমরা। নকশালবাড়িতে বন্দুকের নল দেখিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের যে ডাক দেওয়া হয়েছিল, তার কোনও প্রাসঙ্গিকতা কি আছে আজকের দিনে? ভারতীয় রাষ্ট্রের এই বিপুল প্রতিরক্ষার আয়োজনের মধ্যে মাওবাদীদের সশস্ত্র সংগ্রামের কৌশল যে ধোপে টেকে না, তা বোঝার জন্য মার্ক্স বা লেনিনের বই পড়ার দরকার হয় না। আর তাই কাজের তাগিদে খবর করতে যাওয়া সাংবাদিকের হত্যা জীবনের অপচয় ছাড়া কী-ই বা বলা যায়?

Advertisement

এই মুহূর্তে এ দেশে মাওবাদীরা মূলত ছত্তীসগঢ়, অন্ধ্রপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের সীমান্তবর্তী জেলায় জঙ্গলঘেরা আদিবাসী গ্রামেই সীমাবদ্ধ। কিষেনজি, আজাদ-সহ একাধিক শীর্ষ নেতৃত্বের মৃত্যু ও বহু নেতার দীর্ঘ দিন জেলবন্দি থাকার কারণে সাংগঠনিক ভাবে মাওবাদীরা এমনিতেই দুর্বল। তাই কি নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতেই এই রুটিন হত্যালীলা, যার শিকার কখনও গ্রাম থেকে চাকরি করতে যাওয়া আধাসেনা কনস্টেবল, কখনও বা গরিব চালক, আর শেষতম সংযোজন সাংবাদিক? নকশালবাড়ির অনুপ্রেরণায় যে অসংখ্য দল রয়েছে সারা দেশে, তারা প্রায় প্রত্যেকেই বহু দিন আগেই চারু মজুমদারের ‘ব্যক্তি খুন’-এর তত্ত্বকে খারিজ করেছে, অনেকেই নিয়মিত নির্বাচনেও অংশ নেয়। ব্যতিক্রম শুধু সিপিআই (মাওবাদী)। এই মাওবাদীরা আজও জঙ্গলের মধ্যে থেকে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের চেষ্টাকে একমাত্র পথ বলে মনে করেন। তাঁদের এবং আধাসেনা ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গত ১০ বছরে মারা গিয়েছেন অন্তত ১২,০০০ মানুষ, যাঁদের অধিকাংশই গরিব আদিবাসী। প্রশ্ন হল, ভারতের নিম্নতম বর্গের এই অংশের মানুষ কেন একটি দলের কার্যকলাপের জন্য বলি হবেন ধারাবাহিক ভাবে?

এই অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে গত ২ অক্টোবর অন্ধ্রপ্রদেশের চাত্তি থেকে ছত্তীসগঢ়ের জগদলপুর অবধি দণ্ডকারণ্য এলাকায় ১১ দিন ধরে ১৮৬ কিলোমিটার শান্তি পদযাত্রায় অংশ নেন আড়াইশোরও বেশি আদিবাসী মানুষ। মাওবাদীরা যথারীতি এই উদ্যোগের বিরোধিতা করে বিবৃতি দিয়েছেন। অর্থাৎ এটা পরিষ্কার যে, আদিবাসীদের ঢাল করে নিজেদের অস্তিত্ব রাখতে চান এই বিপ্লবীরা। কিন্তু এ ভাবে বেশি দিন চলতে পারে না। দণ্ডকারণ্যতেও আজ তাঁরা অনেকটাই জনবিচ্ছিন্ন।

Advertisement

এ রাজ্যেও বছর দশেক আগে জঙ্গলমহলে আদিবাসী ও মূলবাসীদের মধ্যে মাওবাদীরা প্রভাব ফেলেছিলেন। নন্দীগ্রাম বা সিঙ্গুর নিয়ে শুরু করলেও কিছু দিনের মধ্যেই তা রাস্তাকাটা, কিছু গরিব গ্রামবাসী ও পুলিশ কর্মীকে হত্যার চিরাচরিত গোলকধাঁধায় পথ হারায়। যে সময়ে তাঁরা জঙ্গল মহলে সক্রিয় ছিলেন সেই সময়েও তাঁদের কর্মসূচিতে ওই এলাকার দারিদ্র, বঞ্চনা, ক্ষুধা, অপুষ্টি, বেকারত্ব-সহ রোজকার সমস্যাগুলি স্থান পায়নি। হয়তো সে কারণেই বাম জমানার অবসানের সঙ্গে তাঁরাও জনজীবন থেকে হারিয়ে যান, কিষেনজির মৃত্যু সেই বৃত্তকেই পূর্ণতা দেয়।

ভারতের রাজনীতি এই মুহূর্তে এক সন্ধিক্ষণে—এক দিকে গৈরিক বাহিনী সরকারে থাকার সব সুবিধা কাজে লাগিয়ে সমাজ অর্থনীতিতে তাদের মতাদর্শ চাপাতে চায়, আর এর বিপ্রতীপে দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। আগামী নির্বাচনে জবরদস্ত লড়াই যে অপেক্ষা করছে তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু বহমান রাজনীতি নিয়ে মাওবাদীদের অনীহা তাদের রাজনীতির মূল স্রোত থেকে ক্রমশই বিচ্ছিন্ন করছে।

সমস্যা রয়েছে এ দেশের বাস্তবতা নিয়ে তাঁদের অবস্থানেও। কর্পোরেট পুঁজির বাড়বাড়ন্তের মধ্যেও তাঁরা এ দেশকে তত্ত্বগত ভাবে আজও আধা-পুঁজিবাদী ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক দেশ হিসেবেই দেখেন। অন্য দিকে আদিবাসী এলাকায় নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখলেও জাতপাতের সমস্যাকে তাঁরা আজও দেখেন শ্রেণি দৃষ্টিকোণ থেকেই, অথচ গত তিন দশকে দলিত/ ওবিসি/ মূলবাসীদের দাবি ও অধিকার চর্চা দেশের রাজনীতির মানচিত্রে আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। এ সব বিষয় মাওবাদীদের রাজনীতিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ? অতি সম্প্রতি মাওবাদীদের পঞ্চাশ বছরের সহযাত্রী গদর এই সব প্রশ্নেই তাঁদের সংস্রব ত্যাগ করেছেন এবং গৈরিক আক্রমণকে প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রসঙ্গত, প্রচণ্ড’র নেতৃত্বাধীন নেপালের মাওবাদীরাও হিংসার পথ পরিত্যাগ করে অন্য রাজনৈতিক দলের মতোই নির্বাচনে অংশ নিয়ে সে দেশের বামজোট সরকারে শামিল হয়েছেন।

মাওবাদীরা যতই খোলসের আড়ালে থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের খোয়াব দেখুন না কেন, তাঁদের রাজনীতিই ক্রমশ তাঁদের অপ্রাসঙ্গিক করে তুলছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন