সম্পাদকীয় ১

কৃষকের কণ্ঠ

ক্ষেত্র প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও যে আন্দোলন তেমন ছড়াইতে পারিল না, তাহা প্রধানত আন্দোলনের পদ্ধতি লইয়া সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের ভিন্ন মতের জন্য।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৮ ০০:৫৬
Share:

পয়লা জুন হইতে দেশের কৃষকেরা দশ দিনের ‘গাঁও বন্‌ধ’ ডাকিয়াছিলেন। সেই কার্যক্রম তেমন দাগ কাটিতে পারে নাই। দক্ষিণ ভারত এবং পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি এই আন্দোলনে সে ভাবে সামিল হয় নাই। পঞ্জাব, হরিয়ানায় চাষিরা চার-পাঁচ দিনেই ইতি টানিয়া দিয়াছেন। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও মহারাষ্ট্রে আন্দোলনের সূচনায় সব্জির দাম কিছু বাড়িলেও, দ্রুত বাজার সুস্থির হইয়া যায়। চাষিরা শহরের বাজারগুলিতে সব্জি, দুধ প্রভৃতি সরবরাহ বন্ধ করিয়া, দাম বাড়াইয়া, নিজেদের সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু দিল্লি বা মুম্বইয়ের বাজারে কোনও প্রভাব পড়ে নাই। অথচ দেড় শতেরও অধিক কৃষক সংগঠন একত্রে এই আন্দোলনের পরিকল্পনা করিয়াছিল। গত বৎসর মধ্যপ্রদেশের মন্দসৌরে পুলিশের গুলিচালনায় ছয় কৃষকের হত্যার বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এই কার্যক্রম গ্রহণ করিয়াছিলেন তাঁহারা। পর পর কয়েকটি বিধানসভা নির্বাচনে স্পষ্ট, কৃষকরা রাজনীতিতে একটি নির্ণায়ক শক্তি হইয়া উঠিতেছেন। অতএব ২০১৯ নির্বাচনের পূর্বে এই কৃষক আন্দোলনকে লইয়া যথেষ্ট কৌতূহল জাগিয়াছিল। প্রথম দুই দিন পথের উপর সব্জি ফেলিয়া, দুধ ঢালিয়া কৃষকদের দাবি জানাইবার দৃশ্য প্রচার হইয়াছে। কৃষকদের দাবিগুলিও নূতন নহে। কৃষিঋণ মকুব, ফসলের ন্যূনতম দাম পাইবার নিশ্চয়তা, স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ মানিয়া ফসলের দাম নির্ধারণ, এই দাবিগুলি গত দুই বৎসরে কৃষক আন্দোলনের কেন্দ্রে আসিয়াছে, জনসমর্থনও পাইয়াছে। প্রধানত সেই কারণেই মোদী সরকারের শেষ বাজেট চাষিদের প্রাধান্য দিয়াছে, যদিও প্রস্তাবের অস্পষ্টতা বিভ্রান্তি বাড়াইয়াছে। কৃষকের ক্ষোভ কমে নাই।

Advertisement

ক্ষেত্র প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও যে আন্দোলন তেমন ছড়াইতে পারিল না, তাহা প্রধানত আন্দোলনের পদ্ধতি লইয়া সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের ভিন্ন মতের জন্য। পণ্য সরবরাহ বন্ধ করিতে সকলে রাজি হন নাই। বামপন্থীরা কৃষকদের সমস্যা লইয়া সংসদে সপ্তাহকালের বিতর্ক দাবি করিয়াছেন, সাধারণ ক্রেতার হয়রানিকে সমর্থন করেন নাই। অন্য নেতারা যুক্তি দিয়াছেন, শহরের সহিত বিবাদ করিয়া কৃষক তাহার দাবি আদায় করিতে পারিবে না। বিশেষত মহারাষ্ট্রে সম্প্রতি দরিদ্র কৃষকদের দীর্ঘ মিছিলে অকুণ্ঠ সহযোগিতা করিয়াছিলেন মুম্বইবাসী। শহরে সব্জি-দুধ সরবরাহ বন্ধ করিলে সেই সমর্থন হারাইতে হইবে। আরও সমস্যা, ‘গাঁও বন্‌ধ’ আন্দোলন শুরু হইয়াও দ্বিধাবিভক্ত হইল। হরিয়ানার গোপালকেরা একাদিক্রমে দশ দিন তাঁহাদের সমস্ত উৎপাদন নষ্ট করিতে রাজি হইলেন না। দুগ্ধবিক্রেতাদের সহিত কৃষকদের সংঘাত বাধিল। মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রে পুলিশের হস্তে নিগৃহীত হইলেন কৃষকেরা। ট্রাক রুখিবার কার্যসূচি ব্যর্থ হইল।

এই ব্যর্থতা কি কেবল কৃষকদের? ইহা বস্তুত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির ব্যর্থতা। দেশব্যাপী আন্দোলনের সংগঠন ছেলেখেলা নহে, প্রয়োজন দীর্ঘ সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা। কৃষকদের বঞ্চনার ক্ষোভের সুযোগ বিরোধীরা কাজে লাগাইতেছে দলীয় রাজনীতির জন্য। কিন্তু কৃষকদের সংগঠিত করিয়া রাষ্ট্রশক্তির মোকাবিলায় এবং প্রাপ্য আদায়ে বিরোধীরা পাশে নাই। রাহুল গাঁধী মন্দসৌরে গিয়া ছবি তুলিলেন, কিন্তু কৃষিঋণ মকুবের মতো বিপজ্জনক নীতির সমর্থনও করিলেন। তাহাতে চাষির সঙ্কট কমিবে কি না, সেই প্রশ্ন তুলিলেন না। বামেরা সংসদে কৃষির আলোচনা দাবি করিয়াছেন, কিন্তু বার বার সংসদ অচল করিতেছেন। সর্বোপরি, ‘গ্রাম বনাম শহর’ ধাঁচের যে আন্দোলন-পদ্ধতি এই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অনুসৃত হইয়াছে, তাহা যে বিপথগামী, সেই অপ্রিয় সত্যটি রাজনৈতিক দলগুলি এড়াইয়া গিয়াছে। এই অসার রাজনীতিই কৃষকদের বিপন্ন করিতেছে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন