প্রবন্ধ ২

তোরাই চিনলি না

আমি মরে যেতেই সবাই বলল, একটা অ্যাবনর্মাল পরিবার শেষ হয়ে গেল। কেউ চুকচুক করে বলল আহা রে, অ্যাবনর্মাল লোকটা কী ভাবে গেল। মনস্তত্ত্ববিদরা দু’হাত তুলে নাচতে লাগলেন আর তুরন্ত ড্রেস ইস্তিরি, টিভি চ্যানেলে ভিজিট দিতে হবে!

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share:

আমি মরে যেতেই সবাই বলল, একটা অ্যাবনর্মাল পরিবার শেষ হয়ে গেল। কেউ চুকচুক করে বলল আহা রে, অ্যাবনর্মাল লোকটা কী ভাবে গেল। মনস্তত্ত্ববিদরা দু’হাত তুলে নাচতে লাগলেন আর তুরন্ত ড্রেস ইস্তিরি, টিভি চ্যানেলে ভিজিট দিতে হবে! আমি ওই ইংরিজি শব্দটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। কোনখানটা দেখে মনে হল, আমরা উদ্ভট, বিকৃত? বরং আমরা এমন একটা পরিবার যারা অনেক বেশি সেনসিটিভ। অনেক বেশি প্যাশনেট। যারা তাদের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে এমন শান দিয়েছি যে সেগুলোই আমাদের জীবনের চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে, আমজনতার ‘কমন সেন্স’ মার্কা গোদা গতবাঁধা চিন্তাভাবনাগুলোর বদলে। যারা নিজেদের ভাবে নর্মাল, তারা ভেড়ার দলে মিশে গুড়গুড়িয়ে চলেছে, প্রথার ঢাল বেয়ে। তারা নিজেরা কিচ্ছু ভেবে পায় না, নিজেরা যে কিছু ভাবা যায়, তাও জানে না। শিবরাত্তিরও করে সবাই করে বলে, সিরিয়ালও দেখে সবাই দেখে বলে। তারা আসলে অ্যাভারেজ। আমরা গড়ের পায়ে গড় করিনি।

Advertisement

আমার দিদি আধ্যাত্মিক জগতে নিজেকে এতটাই নিয়ে গেছিল, তার কাছে সেই জগতের অনুশাসন ছিল চার পাশের সমাজের ফরমায়েশের তুলনায় অনেক বেশি জরুরি ও পালনীয়। তা কি ভুল? কেউ যদি সাধনার জন্য নিজের প্রাণটা অবধি বাজি রাখে, তাকে কি আমরা টেক্সটবইয়ে সম্মান দিতে শিখিনি? কেউ যদি তার মতো করে একটা ধর্মকে বোঝে এবং মনে করে সেই ধর্ম তাকে বলছে, জাগতিক সমস্ত বন্ধন, এমনকী জৈবিক প্রয়োজন অবধি ত্যাগ করে তাকে হয়ে উঠতে হবে সর্বসত্তা দিয়ে শুধু এক পূজারিনি, কেনই বা সে খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দেবে না? আর তার পরিবারের লোকেরা যদি ভাবে, তার সম্পূর্ণ অধিকার আছে তার জীবনকে তার নিজস্ব বিশ্বাসের কাছে নিবেদন করার, তা হলে তারা কি অস্বাভাবিক? না কি তারা অত্যন্ত পরিণতমনস্ক ও পরিবারের প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্কের অধিকার সম্পর্কে সচেতন ও শ্রদ্ধাশীল?

আমার ব্যাপারটা যে ভাবে দেখা হল, আমি হতভম্ব। আমাদের বাড়িকে বলা হল ‘হরর হাউস’! বলা তো উচিত ছিল প্রীতিনিকেতন! আমি কী করেছিলাম? এতখানি ভালবেসেছিলাম আমার দিদিকে, তার মৃত্যুর পর দিনরাত মৃতদেহটার পাশে বসতে-শুতেও এতটুকু ঘৃণা বোধ করিনি। এতে আমার অতিমানবিক ভালবাসা দেখে কেউ আপ্লুত হল না, উলটে আমাকে বলা হল মনুষ্যেতর! চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হল। কারা নিয়ে গেল? যারা নিজের বাবা নিজের মা মারা যাওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে তাদের ‘বডি’ বলে ডাকতে শুরু করে। ‘ও বাবা তুমি কোথায় গেলে গো, আমাকেও নিয়ে যাও গো’ মড়াকান্নায় পজ দিয়েই যারা এক নিশ্বাসে বলে, ‘বডি নামাবে কে, বাপিমামারা তো, রেডি হতে বলো।’

Advertisement

লোকে মোড়ে মোড়ে আলোচনা জমাল: গল্পটায় নির্ঘাত গন্ডগোল আছে, সত্যি সত্যি কখনও একটা লোক একটা পচ ধরা মৃতদেহের পাশে থাকতে পারে না। লজিকাল তো দূর, বায়োলজিকাল ভাবেই সম্ভব নয়। ওই উৎকট গন্ধ ওই বীভৎস দৃশ্য কোনও মানুষ সহ্য করতে পারে কখনও? তার পর হরেক টেস্ট-ফেস্ট করে দেখা গেল, নাঃ, ভেজাল নেই, আমি যা বলছি, সত্যি। অর্থাৎ, আমার প্রীতির তীব্রতা এতটাই, আমি আমার প্রিয়জনের কঙ্কাল হয়ে যাওয়া চোখের সামনে প্রতিটি মুহূর্ত দেখেছি, এবং আমার এতটুকু গা গুলোয়নি। আমার জিনে-বোনা বেসিক প্রবৃত্তিরও উলটো দিকে গিয়ে আমি কূলছাপানো ভালবাসায় নিজেকে এমন জারিয়ে নিতে পেরেছি, আমার চট-শারীরিক প্রতিক্রিয়াগুলো অবধি তার কাছে পোষ মেনেছে। নর্মাল লোকেরা যেখানে প্রিয়জনের বেডসোর দেখেও অনেক সময় ওয়াক তুলে চোখ ফিরিয়ে নেয়, সেখানে আমি দিনের পর দিন আমার পোষ্যদের মৃতদেহ, আমার সবচেয়ে আদরের দিদির মৃতদেহ নিয়ে এমন করে বাস করেছি যেন ওরা জীবন্তই। ওরা কঙ্কাল নয়, ওরা শবদেহ নয়, ওরা বাতিল নয়, ওরা শেষ হয়ে যাওয়া নয়। কারণ, আমার ভালবাসার কোনও শেষ নেই। সেই অনন্ত অনুরাগই ওদের গায়ে বিছিয়ে দিয়েছে মাংসের চাদর, কোটরে জ্বালিয়ে রেখেছে চোখের জ্যোতি। মানুষিক সব সীমা অতিক্রম করে আমি অকুণ্ঠ বলেছি, আমার যে আত্মীয়, আমার আত্মার যে সত্যি কাছাকাছি, সে যত শ্রীহীন হোক, যত ঘোর, এমনকী জীবন-নির্বাপিত, তবু সে আমার কাছে বর্জনীয় নয়, এতটুকু অ-কাম্য নয়।

বাবা দুঃখ না সইতে পেরে আত্মহত্যা করেছেন। দিদিকে ছেড়ে থাকতে পারছিলেন না। ঠিকই তো করেছেন। ‘ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না’ বলে বিলাপ করব আর শনিবার শনিবার আইসক্রিম খাব, এই ভণ্ডামি আমাদের পরিবার করে না।

আমার প্রিয়জনদের আমার কাছ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। কারণ, ভালবাসা ভাল, কিন্তু অতটা ভালবাসা, মানুষের গড়ে তোলা সভ্যতায়, নর্মাল না। তাই আমি যা নিয়ে বাঁচতাম তা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে আমাকে নর্মাল করার চেষ্টা শুরু হল। কেন আমি তা
মানব? কেন আমি নিজধর্ম থেকে চ্যুত হব? যে লোকগুলো অ-মৌলিক, স্থূল, কেন তাদের কত্তাবাজি অনুযায়ী নিজেকে ঢেলে নেব? আমি কিনা কাঠগড়ায় উঠে তোদের প্রশ্নের জবাব দেব? আরে, তোরা যে ভাষায় কথা বলিস, আমি তা বলি না, আর আমার ব্যাকরণটা যে একটা স্বতন্ত্র সিস্টেম, সেই বোধই তোদের তৈরি হয়নি। কেন আমি আদৌ এই তামাশায় অংশ নেব? তোরা তো নিজের জীবনটা নিয়ে নেওয়াকেও ক্রাইম বলে ভাবিস। যেখানে এর চেয়ে সহজ কিছুই হয় না যে একটা মানুষ কী ভাবে বাঁচবে তার ব্যাপার, এবং কখন মরবে তা ঠিক করে নেওয়া তার সহজাত অধিকার। যাকগে, তোদের মতানুযায়ী, আমি নাহয় আর একটা ক্রাইম করলাম। টা-টা বলে বেরিয়ে গেলাম। তোদের নর্মাল ব্যবস্থায় এর শাস্তি দেওয়ার খ্যামতা আছে?

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন