‘হাসপাতালে ভর্তি কোরো না’

যাঁরা আপন মনে বিড়বিড় করেন, নিজের যত্ন নিজে করতে পারেন না, অসংলগ্ন কথা বলেন, অবিবেচকের মতো আচরণ করেন, এত দিন আমরা তাঁদের তফাতে রাখার চেষ্টা করে এসেছি।

Advertisement

রত্নাবলী রায়

শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৬:১০
Share:

আমার বড় পিসি তাঁর মামার বাড়ির তিন তলায় একটি ছাদের ঘরে থাকতেন। অবিবাহিত ছিলেন, কিন্তু কল্পনার জগতে তাঁর স্বামীসহ পাঁচ সন্তান ছিল। বাড়ির আড্ডায় তাঁকে দেখা যেত না বিশেষ। কোনও দিন থাকলেও অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকতেন, আর সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করতেন। প্রশ্ন করলে উত্তর দিতেন, “ছোট ছেলের দুধ খাওয়ার সময় হয়েছে।” এর পর ঝিনুক-বাটি খুঁজতে চলে যেতেন। পরের দিকে বাড়ির লোকজন মশকরা করে বলত, “কি গো, তোমার ছোট ছেলের দুধ খাওয়া হল?”

Advertisement

যাঁরা আপন মনে বিড়বিড় করেন, নিজের যত্ন নিজে করতে পারেন না, অসংলগ্ন কথা বলেন, অবিবেচকের মতো আচরণ করেন, এত দিন আমরা তাঁদের তফাতে রাখার চেষ্টা করে এসেছি। মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যে আইন এত দিন ছিল, তাতে মানসিক রোগীর শুশ্রূষার চেয়েও বড় বিষয় ছিল, কী ভাবে তাঁকে সংসার-সমাজের বাইরে রাখা যায়, তার পরিকল্পনা। তাতে রোগীর সম্মতি আছে কি না, তা জানার কোনও দরকার হত না।

বছর দশেক আগে এক বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বলেছিলেন, “রত্না, আমি যদি কখনও পাগল হয়ে যাই, আমাকে হাসপাতালে ভর্তি কোরো না! হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার চেয়ে আমি হাওড়া ব্রিজে বসে পা দোলানো প্রেফার করব।” সে দিন তাঁকে কোনও উত্তর দিতে পারিনি।

Advertisement

কিন্তু এ বার উত্তর মিলেছে। এ বছর জুলাই মাসে কার্যকর হবে মানসিক স্বাস্থ্য আইন (২০১৭)। আমি যদি মনোরোগে আক্রান্ত হই, কিংবা আক্রান্ত হতে পারি বলে মনে করি, বা কেউ যদি আমাকে মনোরোগী সাজিয়ে নিজের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চায়, তা হলে কী ভাবে আমি নিজেকে সুরক্ষিত করতে পারি, তা বলা হয়েছে বিলে।

নতুন আইন বলছে, এখন থেকে কাউকেই তাঁর অনুমতি ব্যতিরেকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা যাবে না। পরিবারের সদস্যরা প্রথম বার আইনের এই নির্দেশ অমান্য করলে ছ’মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং দশ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। ফের আইন ভাঙলে দু’বছরের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।

কিন্তু কী করে পরিবারকে রোখা যাবে? নতুন আইন বলছে, কেউ যদি মনে করেন যে ভবিষ্যতে তাঁর মানসিক সমস্যা হতে পারে, সে-ক্ষেত্রে তিনি কী ভাবে চিকিৎসা করাতে চান, তার নির্দেশ দিয়ে রাখতে পারেন। তাঁর আস্থাভাজন কোনও ব্যক্তি বা সংস্থাকে তিনি মনোনীত করতে পারেন তা নিশ্চিত করার জন্য। রক্তের সম্পর্কের কাউকে মনোনীত করা আবশ্যক নয়। ফলে মানসিক সমস্যাকে সামনে রেখে যে ধরনের পারিবারিক হিংসা ঘটে, তা এ বার প্রতিহত হতে পারে।

মানসিক হাসপাতাল ছাড়া রোগীর সুষ্ঠু চিকিৎসা হওয়া কি সম্ভব? বহু জেলাতেই সাধারণ হাসপাতালে মানসিক চিকিৎসা মেলে না। নতুন আইন অনুযায়ী, চিকিৎসা পাওয়া মনোরোগীর অধিকার। যাঁরা মানসিক রোগে আক্রান্ত, তাঁরা বাসস্থানের কাছাকাছি কেন্দ্র থেকে চিকিৎসা পাবেন। লিঙ্গ, যৌনতা, ধর্ম, সামাজিক বা রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে সব রোগীকে পরিষেবা দিতে বাধ্য থাকবেন ডাক্তার ও চিকিৎসা কর্মীরা। যদি চিকিৎসা না মেলে, তা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কোর্টে আবেদন করতে পারেন। দরিদ্র মনোরোগীদের বিনামূল্যে পরিষেবা দিতে বাধ্য সরকার।

মনোরোগীদের হাসপাতালে ঢুকিয়ে দেওয়া, এবং মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই ফেলে রাখা, এই অমানবিক প্রথাও দূর করতে চায় নতুন আইন। বলা হচ্ছে, যাঁদের পরিবার নেই কিংবা বাড়ি ফেরত যাওয়ার সম্ভাবনা নেই তাঁদের রাখতে হবে ‘হাফ-ওয়ে হোম’ কিংবা ‘অ্যাসিস্টেড লিভিং’ ব্যবস্থায়, যেখানে বাড়ির মতো পরিবেশে, যথাযথ সহায়তা ও শুশ্রূষা পেয়ে তাঁরা বাঁচবেন আর পাঁচ জনের সঙ্গে।

মনোরোগীদের প্রতি আর এক অমানবিক আচরণ, সন্তানের থেকে মনোরোগী মাকে বিচ্ছিন্ন করা। গর্ভবতী অবস্থায় মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হলে, প্রসবের পর মা ফিরে আসেন সেখানেই, সন্তান মেটারনিটি ওয়ার্ড থেকে চলে যায় হোমে। একটি বেসরকারি হোম এমন ছ’টি শিশুকে বড় করছে, মায়েরা তাদের খবর পান না। চার বছর আইনি লড়াইয়ের পর এমন এক মহিলা মেয়েকে ফিরে পেয়েছেন। মেয়ের বয়স এখন পাঁচ। নতুন আইনে বলা হয়েছে, তিন বছরের কমবয়সি শিশুকে মায়ের সঙ্গে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

এই আইনের দিকে তাকালে বোঝা যায়, মনোরোগী সম্পর্কে রাষ্ট্রের মনোভাবটা পালটেছে। আগে তাকে রাখা হত ‘মেডিকো-লিগ্যাল’ অবস্থান থেকে। তার সম্পর্কে বিধিনিষেধ রাষ্ট্র স্থির করত চিকিৎসক আর আইনজীবীর নির্দেশে। মনোরোগীর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই, এটাই ধরে নেওয়া হত। রাষ্ট্র এখন মনোরোগীকে দেখছে মানবাধিকার, নাগরিক অধিকারের অবস্থান থেকে। মনোরোগীরও কখনও কখনও স্বচ্ছ চিন্তার জানালা খুলে যায়। ফলে তাঁর মতামতকে বরাবরের মতো বাতিল করা চলে না। আর যে কোনও সময়েই নিজের ভালমন্দ, সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে মনোরোগীর মতকে মান্যতা দিতে হবে। অন্য রোগীদের মতো সেই অধিকার আছে মনোরোগীরও।

অনেক লড়াই করে এটুকু মর্যাদা পেয়েছেন মনোরোগীরা। পরমাত্মীয়দের থেকেও যাঁদের সুরক্ষাকবচের প্রয়োজন হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন