অফিসটাইমে বেরোন কেন? ‘মিটু-র বাজারে’ প্রশ্নটা রয়েই গেল

পুরুষ যেখানে ক্ষমতার ভয় দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট মেয়েটিকে অত্যাচার করেছে। লিখছেন ঈশানী দত্ত রায়হোয়াটসঅ্যাপে এই মেসেজটা কমবেশি সকলেই দেখেছেন— ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’ সংক্ষেপ করে যাঁরা ‘hbw’  লেখেন, তাঁরা সাবধান।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৮ ০৩:৫৫
Share:

মেয়েদের উপরে যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদে মিছিল। ফাইল ছবি

শিয়ালদহ থেকে আলিপুরগামী একটি ভিড়ঠাসা বাসে পাদানিতে প্রায় ঝুলছেন এক অন্তঃসত্ত্বা, কাঁধে ব্যাগ। দেখে বোঝাই যাচ্ছে অফিসে যাচ্ছেন। মজা হল, বাসের ভিতর থেকে অধিকাংশ পুরুষযাত্রী চেঁচিয়ে যাচ্ছেন, ‘‘পরের স্টপে নেমে যান, ঝুলছেন কেন? পরের বাস ধরুন।’’ ‘‘কেন যে এই সময় আপনারা বাসে-ট্রেনে ওঠেন?’’ পরের স্টপ আসতে ভদ্রমহিলা ঠেলেঠুলে ভিতরে ঢুকলেন এবং খুব শান্ত স্বরে বললেন, ‘‘আমাকেও আপনাদের মতোই সময়ে অফিস যেতে হয়।’’ কুড়ি বছর আগে এ ঘটনা নিয়ম-ই ছিল। ট্রেনে বা বাসে মেয়েদের এ কথা শুনতেই হতো, অফিসটাইমে বেরোন কেন?

Advertisement

#মিটু ঘিরে একটি প্রবণতা দেখে উপরের ঘটনাটা মনে পড়ে গেল।

হোয়াটসঅ্যাপে এই মেসেজটা কমবেশি সকলেই দেখেছেন— ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’ সংক্ষেপ করে যাঁরা ‘hbw’ লেখেন, তাঁরা সাবধান। শুভ বিজয়া জানাতে গিয়ে শুধু আদ্যক্ষর লিখবেন না। মিটু-র বাজারে বিপদে পড়ে যাবেন।’ বার্তাটির মধ্যে চটজলদি বুদ্ধির ছাপ আছে। পড়ে হাসিও পেল। কিন্তু মুশকিল আছে এই শব্দ দুটিতে— ‘মিটু-র বাজারে’। বাজারে? শুধু হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা নয়, ঘরোয়া এবং বেশি পরিসরের আলোচনায় কেউ কাউকে অনায়াসে এবং হাল্কা চালেই বলে ফেলছেন, ‘‘সাবধানে কথা বলিস, মিটু-র বাজারে কিন্তু সাবধান।’’ বা ঘন ঘন সম্পর্কে জড়ানো পুরুষকে বলা হচ্ছে, ‘মিটু-র বাজারে তুই ফাঁসছিস না তো? সাবধানে থাকিস’ ইত্যাদি। আবার এ-ও কেউ কেউ বলছেন, ‘‘কয়েকদিন যেতে দিন, এ সব আপনিআপনি থেমে যাবে।’’

Advertisement

‘বাজারে’! বা ‘এ সব’! অর্থাৎ, এক অংশের জনমানসে এবং বড় অংশের জনমানসে এ ধারণাটাই সুপ্ত রয়েছে যে এটা নিতান্তই হুজুগ, সাময়িক তরঙ্গমাত্র। দ্বিতীয়ত, একটা ‘রব উঠেছে’ বলে এই ‘বাজারে’ পুরনো ঝাল মিটিয়ে নিচ্ছেন অনেকে। অর্থাৎ, অনেক অভিযোগই সত্যি নয়। বা মেয়েরা তো যৌন সুবিধা দিয়ে এবং বিনিময়ে অন্য সুবিধা পেয়েই থাকে, পায়নি বলে নালিশ করছে। সমস্যাটা এখানেই।

‘লেডিজ সিট’ বা লেডিজ কামরা বা মাতৃভূমি লোকাল নিয়ে যে রোষ মাঝে মাঝে প্রবল আকারে প্রকাশিত হয়, তার মূলে অন্যতম ধারণা এই যে মেয়েদের আবার চাকরি করার দরকার কি? ঘরেই তো থাকা ভাল। আর চাকরি যদি বা করেও, সরকার বা কর্তৃপক্ষ তো অনেক সুবিধা তাদের দিয়েই রেখেছে, ট্রেনে-বাসে আলাদা সিট, দেরিতে ঢুকলেও নাকি ছাড় দেওয়া হয়, তার উপরে বাচ্চা হবে বলে ছুটি!!!! ফলে, যে ভাবে পারা যায়, আঘাত করো। ‘আমাদের’ কাজের, বেতনের ক্ষেত্রে ভাগ বসাতে এসেছে, অতএব শারীরিক আক্রমণ করো, যাতে গুটিয়ে যায়। আর ধর্ষণ করলে তো কথাই নেই। সারা জীবন মেয়েটাকে সমাজে ব্রাত্য করে রাখা যাবে। কারণ, ধর্ষিত হওয়া মানে ‘আরে এই মেয়েটাই না? কী ভাবে হল ভাই, চেঁচাতে পারলে না’ জাতীয় সামাজিক সংলাপ।

কথা হল, যৌন নির্যাতন, নিগ্রহ ধর্ষণের পিছনে ব্যক্তিগত বিকৃতির পাশাপাশি, বা কখনও তার চেয়েও বেশি করে থাকে ক্ষমতা জাহির করার এই মনোভাব। ট্রেনে-বাসে ‘অফিসটাইমে কেন বেরোন’, ‘মিটু-র বাজার’ জাতীয় বাক্যবন্ধ প্রকাশেও সমান সত্যি তা। মেয়েরা কেন বেরোবে? কেন চাকরি করবে? কেন পদোন্নতি হবে? কারণ, দক্ষতা পুরুষের সহজাত এবং মেয়েদের উন্নতি মানেই কর্তৃপক্ষকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত।

সামাজিক ভাবে, বাস্তবে সুপ্রোথিত এই ক্ষমতা, স্বঘোষিত দক্ষতার এই দম্ভ #মিটুর ক্ষেত্রেও সত্যি। #মিটু-তে যে সব অভিযোগ উঠেছে, তা মূলত কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের যৌন নির্যাতনের অভিযোগ। পুরুষ এখানে তার ক্ষমতা ব্যবহার করে বা ক্ষমতার ভয় দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট মেয়েটিকে অত্যাচার করেছে— অভিযোগগুলো পড়লেই বোঝা যায়।

এ বার আসি আর একটি প্রশ্নে। অভিযোগ উঠলেই এক দল বলতে শুরু করেছে, প্রমাণ করতে পারবে? প্রমাণই তো নেই।

প্রমাণ হবে কি হবে না, সে আদালতের প্রশ্ন, আইনের ব্যাখ্যা। সে প্রক্রিয়ায় না ঢুকে সোজাসাপ্টা একটা কথা বলুন তো মশাই, কে, কবে অন্যকে সাক্ষী রেখে এ ধরনের কাজ করেছে, বিশেষত অফিসে? যে করেছে সে জানে। আর যিনি নির্যাতিত হয়েছেন, তিনি জানেন।

বহু বছর আগে একটি উপন্যাস পড়েছিলাম। সেখানে কাহিনির নায়ক যুবক একটি বেসরকারি অফিসের ‘বস’। তার বিরুদ্ধে এক মহিলা সহকর্মীকে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ ওঠে। যুবকের আইনজীবী তদন্তে বার করে ফেলেন যে অতীতে দুটি অফিসে মেয়েটি একই অভিযোগ এনেছিল এবং মিথ্যা অভিযোগ আনায় তার চাকরিও গিয়েছে। ফলে, মেয়েটির চরিত্রই এমন, তা প্রমাণ করে দেওয়া যায় এবং এক্ষেত্রেও যুবকটি অভিযোগমুক্ত হয়। উপন্যাসের শেষে ছিল, মেয়েটি একটি চিরকুট রেখে যায়, তাতে লেখা ছিল, ‘আপনি জানেন, আপনি কী করেছেন’। যুবকটি তার শিরদাঁড়ায় ঠান্ডা স্রোত অনুভব করে এবং সেই কাগজ ছিঁড়ে কমোডে ফেলে ‘ফ্লাশ’ টেনে দেয়। উপন্যাসটি বাস্তবও।

অভিযোগ প্রসঙ্গে একটি ফিল্মের কথাও মনে পড়ছে— ‘নর্থ কান্ট্রি’। ২০০৫ সালের এই ছবিটি তৈরি হয়েছিল ২০০২ সালের ‘ ক্লাস অ্যাকশন: দ্য স্টোরি অফ লোয়েস জনসন অ্যান্ড দ্য ল্যান্ডমার্ক কেস দ্যাট চেঞ্জড সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট ল’ বইটির ভিত্তিতে। ঘটনাটি সত্যি। মিনেসোটার এক খনিতে মহিলা কর্মীদের উপরে যৌন নির্যাতন এবং নিগ্রহের ঘটনা ঘটত নিয়মিত। কিন্তু প্রতিবাদ হয়নি। এক একক মা (যাঁর বাবাও কাজ করতেন ওই খনিতে এবং বিশ্বাস করতেন মেয়েদের অন্তত খনিতে কাজ করা উচিতই নয়) লড়াইটা শুরু করেন। একক মা, তার উপরে প্রথম সন্তানটির পিতৃপরিচয় নেই, ফলে, সমাজের চোখে তো বটেই, বাবার চোখেও তিনি চরিত্রহীন। এমন একটি মেয়ে যখন কর্মক্ষেত্রে সুবিচার না পেয়ে আদালতে যান, তখন তাঁর উপরে যে ধরনের কলঙ্ক ঠেলে দেওয়া হয়, তা সহজেই অনুমেয়। মেয়েটি অন্য মহিলা সহকর্মীদেরও এই আইনি লড়াইয়ে পাশে চেয়েছিলেন। প্রথমে পাননি। ভয়েই পাশে দাঁড়াতে চাননি কেউ। শেষ পর্যন্ত এক জন, দু’জন করে সাক্ষ্য দেন এবং আদালত রায় দেয়, অভিযোগটি ‘ক্লাস অ্যাকশন’ মামলা হিসাবে চালানো হবে। অর্থাৎ, এ ধরনের মামলায় অভিযোগকারী এক জন, একক মানুষ হতে পারেন, কিন্তু তাঁর অভিযোগ বিক্ষিপ্ত, একক অভিযোগ নয়, বরং তিনি আরও অনেকের, আরও অনেকের অভিযোগের প্রতিনিধিত্ব করছেন।

সাম্প্রতিক #মিটু অভিযোগের ক্ষেত্রেও অভিযোগটা এক জন তুলেছেন। তার পরে এগিয়ে এসেছেন আরও অনেকে। এমনকি, আদালতে চিঠি লিখে তাঁরা জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট মামলায় তাঁদের কথা শোনা হোক।

অতএব, #মিটুর ‘বাজার’টা বড়! অফিসটাইমে অনেক বেশি মেয়ে বেরোচ্ছে কি না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন