নরেন্দ্র মোদী কি সুদিন আনিলেন? প্রশ্নটি করিতে হইবে ভারতের পঁচিশ লক্ষ দরিদ্র নারীকে, যাঁহারা সরকারি স্কুলে মধ্যাহ্নভোজন প্রস্তুত করেন। মিড-ডে মিল কর্মীদের বেতন এ বৎসরও বাড়িল না। মিড-ডে মিল প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াইবার প্রস্তাব কেন্দ্রের মন্ত্রিসভার বিবেচনাধীন। সংবাদে প্রকাশ, তাহাতে কর্মীদের বেতন এক হাজার হইতে দুই হাজার টাকা করিবার সুপারিশটি স্থানই পায় নাই। ২০১৩ সালে ইউপিএ সরকার যে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল, ২০১৮ সালে তাহা মুছিয়া গিয়াছে। অতএব ২০১৯ সালে নির্ধারিত পারিশ্রমিকেই কাজ করিতে হইবে মহিলাদের। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মীদের বেতন দ্বিগুণেরও অধিক বাড়িয়াছে। রাজ্য সরকারগুলি সাধ্যমতো মহার্ঘ ভাতা বাড়াইয়াছে। অপ্রশিক্ষিত শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরির সরকার-নির্দিষ্ট হারও বাড়িয়াছে। কেবল এই দরিদ্র মহিলাদের পারিশ্রমিক একটি টাকাও বাড়ে নাই। তাঁহাদের প্রায় অর্ধেক তফসিলি জাতি ও জনজাতির মানুষ, এক বৃহৎ অংশের পরিবারে পুরুষ অভিভাবক নাই, তাঁহাদের রোজগারেই সংসার প্রতিপালিত হয়। এই সকল তথ্য সরকারি নথিতে আছে। কিন্তু সরকারের যুক্তি, ওই মেয়েরা ‘কর্মী’ হিসাবে ‘বেতন’ দাবি করিতে পারেন না। শ্রমদান করিয়া ‘সাম্মানিক’ পাইয়া থাকেন। তাহা বাড়াইতে দায়বদ্ধ নহে সরকার।
বক্তব্য নির্ভুল। কেবল একটি অনুরোধ। তফসিলি জাতি, জনজাতির মানুষদের কুটিরে নেতাদের ভোজন করিতে দেখিয়াছে দেশবাসী। সরকারি স্কুলের ভোজনপঙ্ক্তিতেও তাঁহাদের দেখা গিয়াছে। কিন্তু দলিত-আদিবাসী মহিলাকর্মীর পাশে দাঁড়াইয়া রাঁধিতে দেখা যায় নাই। এক দিন সেই কাজটিই করুন না নেতানেত্রীরা। কাঠ ও কয়লা দিয়া উনান ধরাইয়া, পুকুর বা টিউবওয়েল হইতে জল বহিয়া, খাদ্যসামগ্রী কাটিয়া-ধুইয়া-বাছিয়া, রাঁধিয়া-বা়ড়িয়া শিশুদের খাওয়াইবার কাজটি স্বহস্তে করিয়াই দেখুন। তাহাতে মালুম হইবে, কাহাকে বলে ‘কাজ’ আর কাহাকে বলে ‘শ্রমদান’। দেড়-দুই শত শিশুর ভাত-তরকারি যথাসময়ে প্রস্তুত যাঁহারা করেন, তাঁহাদের ‘সাম্মানিক’ দিবার নাম করিয়া যৎসামান্য, কার্যত ক্রমহ্রাসমাণ পারিশ্রমিক দিবার অর্থ, তাঁহাদের অসম্মান করা। জ্যৈষ্ঠের দিনে টিন বা অ্যাসবেস্টসে আচ্ছাদিত তপ্ত রন্ধনশালায় দাঁড়াইলে হয়তো নেতা-মন্ত্রীদের মনে পড়িতে পারে, পর পর চারটি জাতীয় শ্রম সম্মেলনে সকল শ্রমিক ইউনিয়ন একত্রে সুপারিশ করিয়াছে, মিড-ডে মিল-সহ সকল সরকারি প্রকল্পে কর্মরত মহিলা কর্মীদের ন্যূনতম বেতন, এবং বিবিধ সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের সুবিধা দিতে হইবে। তাহার মধ্যে শাসক দলের ঘনিষ্ঠ ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘও রহিয়াছে। সকল সংগঠনই বলিয়াছে, মিড-ডে মিল কর্মীদের ন্যূনতম মজুরি প্রাপ্য। বঞ্চনা করিবার অর্থ প্রতারণা।
‘সকলের সহায়তা, সকলের উন্নতি’, এমনই আশ্বাস দিয়াছিল মোদী-সরকার। চার বৎসরে দেশ বুঝিয়াছে, উন্নয়নের কল্পিত বলয়ে স্থান নাই দরিদ্র নারীর। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, আশা কর্মী, মিড-ডে মিল কর্মী, কাহারও উন্নতি হয় নাই। বস্তুত দরিদ্র মহিলা ও শিশুদের সহায়তার এই প্রকল্পগুলি পাঁচ বৎসরে ক্রমে দুর্বল হইয়াছে। মোদী-সরকার সেগুলির জন্য অতি অনিচ্ছায়, অতি সামান্য বরাদ্দ করিয়াছে, পর পর পাঁচটি বাজেটে তাহা স্পষ্ট। জাতীয় গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্পের অর্ধেক কর্মী এখন মহিলা। ওই প্রকল্পেও মজুরি বাড়ে নাই বলিলেই চলে। বরং কাজের দিন কমিয়াছে, মজুরি পাইতে বিলম্ব বাড়িয়াছে। এই সবের ফল ফলিয়াছে। স্বল্পশিক্ষিত গ্রামীণ মহিলা শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে যোগদানের হার ক্রমশ কমিতেছে। রাষ্ট্রের পুরুষতান্ত্রিক রূপটি স্পষ্ট। প্রশ্ন একটিই। দরিদ্র মেয়েদের বেতনের টাকা নামঞ্জুর করিয়া নরেন্দ্র মোদী তাহা কোন কাজে লাগাইবেন?