আর্জেন্টিনা ময়দানে, দিনু আলেক্স গ্যালারি ছেড়ে চলে গেলেন

মরিবার হল তাঁর সাধ

প্রিয় খেলোয়াড় বা টিম হেরে গেলে, প্রিয় তারকার ছবি ফ্লপ করলে, প্রিয় রাজনৈতিক দল ভোটে হারলে, জীবন বিস্বাদ লাগে কমবেশি সকলেরই।

Advertisement

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৮ ০০:৩১
Share:

কেরলের দিনু আলেক্স বেঁচে নেই। একটু সবুর করলে দেখতে পেতেন, তাঁর প্রিয় দল আর্জেন্টিনা নাইজিরিয়া ম্যাচে জিতেছে, মেসি গোলও করেছেন। দিনু নিজে খুব একটা খেলাধুলো করতেন না। স্বভাবটাও চুপচাপ গোছের। বন্ধুদের একটা ছোট্ট গোষ্ঠী ছিল, তাদের সঙ্গে খেলা দেখতেন। আইসল্যান্ডের কাছে হারের পরে ক্রোয়েশিয়া ম্যাচেও যখন মেসি আটকে গেলেন, দিনু মাঝরাতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। দু’দিন পরে নদী থেকে পুলিশ দেহ উদ্ধার করে। সুইসাইড নোটে লেখা ছিল: এ জীবনে আর কিছু দেখার বাকি নেই। মৃত্যুর গভীরে তলিয়ে যাওয়াই শ্রেয়।

Advertisement

প্রিয় খেলোয়াড় বা টিম হেরে গেলে, প্রিয় তারকার ছবি ফ্লপ করলে, প্রিয় রাজনৈতিক দল ভোটে হারলে, জীবন বিস্বাদ লাগে কমবেশি সকলেরই। কিন্তু এ জীবনে আর কিছু দেখার, আশা করার, চাওয়ার বা পাওয়ার নেই, এমনটা মনে হয় কি চট করে? হাজার হোক, মেসির জয়পরাজয় তো মেসির, তাঁর টিমের আর আর্জেন্টিনার! কেরলের দিনুর জীবন তার সঙ্গে এতটা জড়িয়ে গেল কী করে? ঠিকই, এই বিশ্বকাপ মরসুমে দিনু, দিনুর মতো আরও অসংখ্য ভক্তেরই সব চেয়ে বড় স্বপ্ন, মেসির হাতে কাপ উঠতে দেখা। কিন্তু মেসির জয়ই কেরল-নিবাসী দিনুর একমাত্র স্বপ্ন-অবলম্বন ছিল? যা ভেঙে গেলে জীবনের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা-পিছুটান উবে যায়? না কি চুপচাপ স্বভাবের ছেলেটি ধরে নিয়েছিলেন, নিজের জীবনে খুব কিছু জয় করা তার হবে না! মেসির মধ্যেই যাবতীয় বলভরসা সঁপে দিয়ে তিনি বুঝি বুক বেঁধেছিলেন বকলমা জয়ের আস্বাদ পাওয়ার বাসনায়! মেসির পরাজয় হয়তো সে জন্যই তাঁর নিজের পরাজয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল!

খেলা নিয়ে উন্মাদনার বহু ভয়ঙ্কর পরিণাম আমরা দেখেছি। ফুটবল মাঠে মারামারি ও তজ্জনিত পদপিষ্টতায় ১৬টি প্রাণ গিয়েছিল এই শহরেই। আত্মঘাতী গোল করার অপরাধে আন্দ্রে এস্কোবার খুন হয়েছিলেন কলম্বিয়ায়, স্টেফি গ্রাফের ভক্ত ছুরি বসিয়েছিল মনিকা সেলেসের কাঁধে। বিশ্বকাপ ক্রিকেট সেমিফাইনালে ইডেন উদ্যানে বোতল বৃষ্টি করে ভারত-শ্রীলঙ্কা ম্যাচ ভেস্তে দিয়েছিল জনতা। দিনু কিন্তু কাউকে আক্রমণ করতে ছোটেননি। শুধু জীবনের গ্যালারি ছেড়ে নিজেই বেরিয়ে গিয়েছেন।

Advertisement

তিরিশ বছরের এক যুবকের জীবন এতটা নায়ক-মুখাপেক্ষী হয়ে গেলে বুঝতে হবে তিনি এক গভীর শূন্যতায় ভুগছেন। এবং এ অসুখ তাঁর একার তৈরি নয়, অসুখ বাসা বেঁধেছে সমাজেরই বুকে। রোগের লক্ষণগুলো খুব বেশি করে দিনুর মধ্যে ফুটে উঠেছে, এই মাত্র। এমনিতেই দক্ষিণী সমাজে ভক্তের আত্মাহুতির একটা ট্র্যাডিশন আছে। প্রিয় তারকা, প্রিয় নেতা সেখানে প্রায় ঈশ্বরের সামিল। তাঁদের মৃত্যুতে ভক্তেরাও অনেকে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন, এমন খবর আগে অনেক বারই শোনা গিয়েছে। কিন্তু সেই সব ঘটনায় দ্রাবিড় অস্মিতার প্রশ্নটি জড়িত ছিল। মেসির ক্ষেত্রে তা-ও নেই।

সত্যি বলতে কী, ‘মেসির পরাজয়ে ভারতীয় ভক্তের আত্মহত্যা’ জাতীয় শিরোনাম শুনলে সাধারণ ভাবে আত্মহত্যার কারণটি তুচ্ছ বলেই মনে হবে। কিন্তু যদি মনে রাখি, পছন্দের মোবাইল না পেয়ে বা মোবাইল নিয়ে বকুনি খেয়ে আত্মহত্যার ঘটনা আজকাল প্রায়শই শোনা যাচ্ছে, তা হলে আপাততুচ্ছ কারণটাও আর তুচ্ছ বলে জ্ঞান করা চলে না। কারণ ‘তুচ্ছ’ কারণই ‘বৃহৎ’ হয়ে ওঠাটা একটা সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাধিটাকে তুচ্ছ করলে উপশমের রাস্তা পাওয়া মুশকিল হবে।

ঘটনা হল, জীবনের অনেক উত্তেজনাই যে আদতে তুচ্ছ, সেই বোধটাই তামাদি হতে বসেছে ইদানীং। জনমাধ্যমের গণতন্ত্রে এখন সকলেই বিশিষ্ট। দেওয়াল জুড়ে শুধু আমি, আমার ছবি, আমার মতামত, আমার আনন্দ, আমার সাফল্য, আমার দুঃখ, আমার লাইক, আমার ট্রোল, আমার পছন্দ-অপছন্দের ঘোষণা। আমিত্ব আর তাৎক্ষণিকতার এই ধারাবিবরণীর মধ্যে তুচ্ছতার জায়গা কোথায়? সেখানে সবই মহার্ঘ, নিজের হাতে রাঁধা উচ্ছে চচ্চড়ি থেকে চাকরির পদোন্নতি, ইস্কুলের কুইজ় থেকে জয়েন্টের রেজ়াল্ট, সমান বাগাড়ম্বরের বিষয়। প্রিয় খেলোয়াড়ের হারে জীবন অন্ধকার হয়ে যাওয়া কি এই আবহে নিতান্তই অস্বাভাবিক?

আর, একটা আপাততুচ্ছ জিনিসই কখন কার মনে বৃহৎ হয়ে উঠছে, তার কোনও ফর্মুলা হয় না। তবে খেয়াল করলে কিছু প্রবণতা চোখে পড়ে, হয়তো তাতে আগল টানার সুযোগও থাকে। কিন্তু যদি বা কোনও অতিরেক নজরে আসে, তা থেকে মুক্তির উপায় খোঁজার পদ্ধতি পরিবার বা পরিচিতদের অনেকেরই জানা থাকে না। বকাবকি, বিদ্রুপ করে তাকে আরও বেসামাল করে তোলা হয়। তাতে কেউ আরও গুটিয়ে যায়, কেউ ততোধিক জেদি আর আগ্রাসী হয়ে ওঠে। যে মানুষটা সংক্ষুব্ধ হয়েই রয়েছে, তা সে যত ‘ক্ষুদ্র’ কারণেই হোক, তাকে যদি বলা হয়, বাপু হে তোমার দুঃখটা দুঃখপদবাচ্যই নয়, তাতে হিতে বিপরীতের সম্ভাবনাই প্রবল।

ধরা যাক, দিনুকে যদি বলা হত, ‘‘মেসি হেরে গিয়েছে বলে তুমি ভেঙে পড়েছ? জানো, ইরানের মেয়েরা স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখারই সুযোগ পায় না। এ বার নেহাত ও দেশে অর্থনীতি নিয়ে খুব বিক্ষোভ চলছে, তাই জনমনকে খুশি করতে মেয়েদের স্টেডিয়ামে ঢুকতে দেওয়া হল! তুমি বরং জাফর পানাহি-র ‘অফসাইড’ ছবিটা দেখো!’’ দিনুর জন্য এই ভোকাল টনিক কি কাজ করত? না-এর সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবার না দিয়ে দারিদ্রের পরিসংখ্যান শোনানো যেমন নিষ্ঠুরতা, এটাও কতকটা তাই।

কতকটা, সবটা নয়। ব্যক্তিগত মনঃকষ্ট উপশমের একটা বড় উপায় মনের চারণভূমিকে সম্প্রসারিত করা। একটি বা দু’টি বিষয়ের উপরে যাবতীয় দাঁও লাগিয়ে না ফেলা। জয়ের সাধনার পাশাপাশি পরাজয়কে গ্রহণ করতে শেখা। কিন্তু সমাজের চলতি হাওয়া বিপরীতে বইছে। তারকারা বলছেন, তাঁদের অভিধানে পরাজয় শব্দটাই নেই! যখনই হেরেছেন, সেটা জয়ের প্রেরণা হয়ে গিয়েছে! খুবই ভাল কথা। কিন্তু জীবনের নিয়মেই যে সব ইচ্ছা পূর্ণ হয় না আর তাতে জীবন ব্যর্থও হয়ে যায় না, এই কথাটি অহরহ এই জয়োপাখ্যানে বাদ পড়ে যাচ্ছে। শিশুর জন্ম ইস্তক সবাই বলছে, জিততে শেখো! কেউ বলছে না, হারাটাও শেখো। ওটাও অনুশীলনের জিনিস। জীবনে হারজিত আছেই, এই কথাটা তুলে রাখা থাকে, যে ইতিমধ্যেই হেরে গিয়েছে তার জন্য। যার হাতে ট্রফি উঠল, তাকে কেউ বলে না, যে জেতেনি, তোমার জয়োল্লাস যেন তার কষ্টের কারণ না হয়!

দিনুর বাবা জানিয়েছেন, দিনু বন্ধুদের বলেছিলেন, আর্জেন্টিনা হারলে তিনি আর মুখ দেখাতে পারবেন না। আইসল্যান্ড ম্যাচের পর থেকেই জনমাধ্যমে যে পরিমাণ ট্রোল শুরু হয়, ক্রোয়েশিয়া ম্যাচের পরে সেটা কী আকার নেবে, দিনু নিশ্চয় তা আন্দাজ করেছিলেন। যদি ধরেও নিই, কাছের বন্ধুরা দিনুকে দুয়ো দেননি, তাতেও কিছু এসে যায় না। কারণ, তাঁদের কারও কারও উল্লাস হয়তো দিনুকে বিঁধেছে। দিনুকে নিয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণ না হলেও সামগ্রিক ট্রোলের পাহাড় থেকে নিক্ষিপ্ত প্রত্যেকটি শর শান্ত নরম মনের ছেলেটির গায়ে এসে লেগেছে। চিৎকৃত এই পৃথিবীতে একটু মিয়োনো, একটু হেরো আর নড়বড়ে মানুষগুলো চিরকালই হ্যাটার পাত্র। ছুতোয়নাতায় তাদের আঁচড়ে দিয়ে নিজেদের নখে শান দেয় বাকিরা। ‘ডেথ ইন দ্য গঞ্জ’-এর সুটুর কথা মনে পড়তে পারে। তখন জনমাধ্যম ছিল না, কিন্তু দলবাঁধা বিদ্রুপ ছিল। আর আজ বিদ্রুপ নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান, সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী। সেখানে চেনাজানারও দরকার নেই, অবিরত গর্জন। কাকে ছোড়া বোমা কার গায়ে পড়ছে, তা-ও জানার উপায় নেই। স্বয়ং বিদেশমন্ত্রী যে অস্ত্রে ঘায়েল, সেখানে দিনু আলেক্স কোন ছার!

দিনুর মনে ঠিক কী চলছিল, তা আর জানা যাবে না। কিন্তু তাঁর সুইসাইড নোট এবং তাঁর পরিচিত জনেরা যা বলেছেন, তার ভিত্তিতেই ছেঁড়া ছেঁড়া কোলাজ তৈরি হচ্ছে কেবল। বোঝা যাচ্ছে, এক জন দিনু আলেক্স মারা গিয়েছেন। আরও অনেক দিনু আলেক্স গুমরে মরছেন। তাঁরা সকলে আত্মহত্যা করবেন না। সেই কারণে তাঁদের গুমরে মরাটা চোখে দেখাও যাবে না। কিন্তু আত্মহননের প্রেক্ষাপটটি সম্ভবত তৈরি হয়েই থাকবে, তৈরি হতেই থাকবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন