সম্পাদকীয় ২

নিজের জন্য কেক

প্রশস্তির মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রীর মন জিতিবার চেষ্টাটিকে হাসিয়া উড়াইয়া দেওয়া যাইত। বলা যাইত, তৃণমূলে এমনটা তো হইয়াই থাকে। কিন্তু, কথাটি রসিকতার নহে, গুরুতর।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৮ ০০:২৪
Share:

আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। কোনও এক অধ্যাপক নিয়মিত তাঁহার সন্দর্শনে যাইতেন— দুর্জনের মতে, স্যর আশুতোষের পদযুগলে যথোপযুক্ত তৈল প্রদান করিতে। তেমনই এক দিন, বাড়ি ফিরিবার সময় বাসের হাতল ফসকাইয়া সেই অধ্যাপক পড়িলেন, এবং তাঁহার ঠ্যাং ভাঙিল। এমন ঘটনায় বন্ধু-সহকর্মীরা সচরাচর দুঃখিত হইয়া প়ড়েন। এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটিল। কতিপয় সহকর্মী তির্যক হাসিয়া বলিলেন, হাতে অত তেল থাকিলে হাতল ফসকাইবেই। বারাসতের প্রশাসনিক সভার পর চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তীর সহকর্মীরাও মুচকি হাসিয়াছিলেন কি না, খবর পাওয়া যায় নাই। তবে, তাঁহার হাত ফসকাইবার কারণটি খুব ভিন্ন ছিল, তেমন দাবি কেহ করিবেন না। মারি আঁতোয়ানেতের প্রসঙ্গ টানিয়া মুখ্যমন্ত্রীর মাহাত্ম্যবর্ণনে তিনি বেশ জমাইয়া ফেলিয়াছিলেন। তবে, শেষরক্ষা হইল না। আবদারের আতিশয্যে তিনি আরও একটি প্রেক্ষাগৃহ চাহিয়া বসিলেন। মুখ্যমন্ত্রীরও ধৈর্যচ্যুতি হইল, বিধায়ক বকুনি খাইলেন। গল্প অবশ্য এখানেই ফুরায় নাই। বিধায়কের কেন্দ্রের বাসিন্দারা বিক্ষুব্ধ— তিনি স্থানীয় মানুষের হরেক অসুবিধার কথা ভুলিয়া মুখ্যমন্ত্রীর প্রশস্তিতেই সময় কাটাইয়া দিলেন কোন বিবেচনায়। অনুমান করা চলে, চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী বুঝিয়াছেন, যে জনতার পাতে রুটি অবধি নাই, তাঁহাদের সম্মুখে নিজের কেকের ব্যবস্থা করিতে চাহিলে কতখানি বিপদ হইতে পারে।

Advertisement

প্রশস্তির মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রীর মন জিতিবার চেষ্টাটিকে হাসিয়া উড়াইয়া দেওয়া যাইত। বলা যাইত, তৃণমূলে এমনটা তো হইয়াই থাকে। কিন্তু, কথাটি রসিকতার নহে, গুরুতর। গত সাত বৎসরে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক ব্যানার-ফেস্টুনের সংখ্যা দিনে দ্বিগুণ রাত্রে চতুর্গুণ বাড়িয়াছে। তাহারও অধিক বাড়িয়াছে একই ফেস্টুনে মুখ্যমন্ত্রীর সহিত মেজ-সেজ নেতাদের নিজের ছবি ছাপাইবার প্রবণতা। বাম আমলে নেতা-মন্ত্রীদের দফতরে মার্কস-লেনিনের ছবি শোভা পাইত, এখন সেইখানেও মুখ্যমন্ত্রীর মুখ। রাজনৈতিক বক্তৃতার আদিতে এবং অন্তে মুখ্যমন্ত্রীর নামে জয়ধ্বনি। কে কতখানি আনুগত্য প্রমাণ করিতে পারেন, কে মুখ্যমন্ত্রীকে কতখানি ‘গুড হিউমার’-এ রাখিতে পারেন, দুর্জনে বলিবে, এই রাজ্যে এখন সেই প্রতিযোগিতা চলিতেছে। অনুমান করা চলে, চিরঞ্জিৎবাবুও সেই খেলাতেই নামিয়াছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁহাকে যে ধমকটি দিয়াছেন, তাহাকে এই প্রতিযোগিতার প্রেক্ষিতে দেখিলে মন্দ হয় না। বিধায়কের কাজ তাঁহার কেন্দ্রের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করা। তাঁহাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা প্রশাসনের নিকট পৌঁছাইয়া দেওয়া, দাবিদাওয়া আদায় করা। কোনও বিধায়ক যদি সেই দায়িত্ব ভুলিয়া মুখ্যমন্ত্রীর মন জয়ে আত্মনিবেদন করেন, মুখ্যমন্ত্রী যে সেই প্রবণতা ভাল চোখে দেখিবেন না, এই কথাটি শাসক দলের আনাচেকানাচে ছড়াইয়া পড়িলে ভাল। তবে ভয় হয়, দলের নেতারা বার্তাটিকে খানিক অন্য ভাবে পড়িবেন। ধরিয়া লইবেন, কোনও কারণে মুখ্যমন্ত্রী চিরঞ্জিৎবাবুর উপর চটিয়াই ছিলেন। ধমকটি সেই কারণেই। এবং, এই ধরিয়া লওয়া হইতে আরও এক দফা ভজনার উপক্রম হইবে। মুখ্যমন্ত্রী যাহাতে চটিয়া না থাকেন, গোড়ায় তাহা নিশ্চিত করিয়া লওয়া আর কী। জনগণের বিশেষ সুবিধা হইবে না। রুটি পাওয়ার সম্ভাবনাও দূর অস্ত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন