ভারতের সকল গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছাইল আটাশে এপ্রিল। এমন দাবি করিয়া ওই দিনটিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘ঐতিহাসিক’ বলিয়াছেন। ইতিহাসের পাঠক প্রশ্ন করিতে পারেন, এই অত্যাবশ্যক কর্তব্যটি করিতে স্বাধীনতার পর সাত দশক পার হইল কেন? বিদ্যুৎ সংযোগের সহিত মানব উন্নয়ন, বিশেষত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নতির যেমন নিবিড় যোগ রহিয়াছে, তেমনই গ্রামীণ শিল্পের উন্নতি ও গ্রামবাসীর রোজগার বৃদ্ধিরও ইহা প্রধান উপায়। বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্নতা বস্তুত অর্থনীতি ও জনজীবনের মূলস্রোত হইতে বিচ্ছিন্নতা। তৎসত্ত্বেও স্বাধীনতার পর গ্রামীণ ভারতের একটি বড় অংশে দুই-তিন প্রজন্ম কেন অন্ধকারে থাকিতে বাধ্য হইল? ইউপিএ সরকারের দুইটি কার্যকালেই অধিকাংশ গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছাইয়াছিল। বাকি ছিল আঠারো হাজারের কিছু অধিক গ্রাম। মোদী সরকার তাহা সম্পূর্ণ করিল। ইহার অনেকগুলিই প্রত্যন্ত এলাকায়, অতএব সংযোগের কাজটি সহজ ছিল না, সত্য। কিন্তু বিদ্যুদয়নের কৃতিত্ব লইয়া কংগ্রেস ও বিজেপির কাজিয়া বিরক্তির উদ্রেক করিবে।
কিন্তু মোদীর ঐতিহাসিকতার দাবি কম বিরক্তিকর নহে। প্রকৃত লক্ষ্য: প্রতিটি গৃহস্থালিতে বিদ্যুৎ সংযোগ। তাহার পূরণ এখনও বহু দূরে। গ্রাম ও শহর মিলাইয়া আজও চার কোটি গৃহস্থালিতে বিদ্যুৎ নাই। যে সাফল্য ‘ইতিহাস’ রচনা করিয়াছে, তাহা বস্তুত একটি সরকারি পরিমাপ। গ্রামে বিদ্যুতের খুঁটি বসাইলে এবং স্কুল দফতর-সহ দশ শতাংশ গৃহস্থালিতে বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিত করিলেই তাহাকে সরকারি নথিতে ‘বিদ্যুৎ সংযুক্ত গ্রাম’ বলিয়া ধরা হইয়া থাকে। অর্থাৎ দশটি গৃহের নয়টি অন্ধকারে থাকিলেও গ্রামে বিদ্যুৎ আসিয়াছে বলিয়া ধরা হয়। ইহাই কি ইতিহাসে নাম তুলিবার উপায়? মোদী সরকারের একশো শতাংশ গ্রামীণ বিদ্যুদয়নের দাবির নীচে অন্ধকার সত্যটি ইহাই যে, অনেকগুলি বিজেপি-শাসিত রাজ্যে প্রায় অর্ধেক গৃহস্থালিতে আজও বিদ্যুৎ নাই। মোদী জমানায় যে সব গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছাইয়াছে, সেইগুলির দশ শতাংশ গৃহেও বিদ্যুৎ সংযোগ এখনও বাকি। সরকারি পরিসংখ্যান এমনই জানাইয়াছে। কেবল সংযোগ দেখিলেও প্রকৃত অবস্থা বোঝা সম্ভব নহে। বিদ্যুৎ সরবরাহ কতটা নিয়মিত, বিদ্যুতের মান কেমন, তাহাও দেখিতে হইবে।
গ্রামাঞ্চলে অনিয়মিত সরবরাহ, অল্প ভোল্টেজের সমস্যার ফলে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকিলেও তাহার সুবিধা অধরাই রহিয়াছে মানুষের কাছে। কুপি জ্বালাইয়া পড়িতেছে যে শিশু, বালতি করিয়া জল বহিতেছেন যে বধূ, ডিজেলে সেচের পাম্প চালাইতে বাধ্য যে কৃষক, গ্রাম বিদ্যুৎ সংযুক্ত হইলেও তাঁহাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসে নাই। অতএব প্রকৃত উন্নয়নের প্রতিফলন ঘটে নাই সরকারি নথিতে। ‘সূচক’ উন্নয়নের ইঙ্গিতমাত্র। যথা, শিশুমৃত্যুর হার কমিলে বুঝিতে হইবে, সম্ভবত শিশুস্বাস্থ্যে উন্নতি হইয়াছে। কিন্তু শাসকরা প্রায়শই বাস্তবের সহিত সঙ্গতিহীন কোনও সুবিধাজনক সংখ্যার উপর বিশেষ তাৎপর্য চাপাইয়া আস্ফালন করেন। মোদীর ‘ইতিহাস’ সৃষ্টির আস্ফালন সেই গোত্রেই পড়িবে। বিদ্যুৎ গ্রামের মানুষের সক্ষমতা বাড়াইল কি না, তাহাই বিচার্য। কতগুলি গ্রামে খুঁটি পোঁতা হইয়াছে, সেই হিসাব শেষ বিচারে অর্থহীন।