বিচ্যুতি কোথায়

তাঁহার ভাষণে কোনও মৌলিক পরিবর্তন সূচিত হয় নাই, গোড়ায় এই কথাটিকে প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। তিনি বলিয়াছেন, গোলওয়ালকরের বেশ কিছু মত এখন আর প্রাসঙ্গিক নহে

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

মোহন ভাগবতের ভাষণটিকে স্বাগত জানানো কর্তব্য। এই কারণে নহে যে তাঁহার ভাষণে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের দর্শনের কোনও মৌলিক পরিবর্তনের দিশা দেখা দিয়াছে। বরং এই কারণে যে তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদের অভ্যন্তরে একটি বিতর্কের পরিসর খুলিয়াছেন। তাঁহার ভাষণে কোনও মৌলিক পরিবর্তন সূচিত হয় নাই, গোড়ায় এই কথাটিকে প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। তিনি বলিয়াছেন, গোলওয়ালকরের বেশ কিছু মত এখন আর প্রাসঙ্গিক নহে। ভাগবত বলিতে পারিতেন, তিনি নিজেও আর ততখানি প্রাসঙ্গিক নহেন— এক পক্ষকাল পূর্বেই তিনি স্বামীজির শিকাগো বক্তৃতার স্মারক সমাবেশে হিন্দুদের সিংহের সহিত তুলনা করিবার টানে মুসলমানদের সম্বন্ধে যে কথাগুলি বলিয়াছিলেন, তিনি নিশ্চয় তাহা ভোলেন নাই। প্রকৃত সত্য হইল, গোলওয়ালকরও প্রাসঙ্গিক, শিকাগোর ভাগবতও প্রাসঙ্গিক— দিল্লির সম্মেলনে ভাগবত যে কথাগুলি বলিলেন, তাহা আরএসএস-এর মৌলিক অবস্থান হইতে বিচ্যুতি নহে, বরং আরও এক বার সেই কথাগুলিই স্মরণ করাইয়া দেওয়া। মুসলমানদের প্রতি হিন্দুত্ববাদী বিদ্বেষটি ধর্মীয় বিভেদের কারণে যতখানি, তাহার অধিক ভারত নামক ভৌগোলিক অবস্থানটির প্রতি মুসলমানদের তথাকথিত ‘বিশ্বস্ততার অভাব’-এর কারণে, অন্তত লিখিত ভাবে। হিন্দু এবং হিন্দুস্থান যে অবিচ্ছেদ্য, এবং বিশ্বস্ত থাকিতে হইলে দুইয়ের প্রতিই থাকিতে হইবে— এই প্রতিষ্ঠিত অবস্থান হইতে ভাগবত এক চুলও সরিলেন কি? বলিলেন কি, সঙ্ঘ-আধিপত্যের সমাজে মুসলমানদের বিশ্বস্ততার অতিরিক্ত প্রমাণ দিবার দরকার নাই?

Advertisement

দেড় দশক পূর্বে সঙ্ঘের ছত্রচ্ছায়ায় মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চ নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। তাহার ঘোষিত সিদ্ধান্ত ছিল, মুসলমানদের কয়েকটি দাবি মানিয়া লওয়া উচিত— গো-হত্যার উপর নিষেধাজ্ঞা; অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠা; সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ ইত্যাদি। অর্থাৎ, ভারতে ‘মুসলমান’ পরিচিতিটি যে কয়টি রাজনৈতিক বিশিষ্টতার উপর নির্ভরশীল— অথবা, হিন্দুত্ববাদী মুসলিম-বিরোধিতা যে প্রশ্নগুলিকে কেন্দ্র করিয়া নির্মিত— মুসলমানরা সেইগুলিকে ছাড়িতে রাজি হইলে তাঁহাদের মানিয়া লইতে সঙ্ঘের আপত্তি নাই। ভাগবতের তিন দিন ব্যাপী ভাষণে প্রতিটি প্রসঙ্গই আসিয়াছে, এবং তাঁহার অবস্থান অপরিবর্তিত। মুসলমানরা তাঁহাদের বিশিষ্টতার দাবি ছাড়িলে, হিন্দুদের আধিপত্য মানিয়া লইলে, তাঁহাদের মানিতে ‘গুরুজি’রও আপত্তি নাই। ইহার মধ্যে ‘বিচ্যুতি’টি কোথায়?

ভাগবত জানাইয়াছেন, ‘সংখ্যালঘু’ তকমাটিতে তাঁহার আপত্তি। আপত্তিটি গুরুতর ও তাৎপর্যপূর্ণ। নেহরুবাদী ভারত ‘সংখ্যালঘু’ পরিচিতিটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিত, এবং সেই পরিচিতির কারণেই তাঁহাদের প্রতি বিশেষ রাষ্ট্রীয় মনোযোগের পক্ষে সওয়াল করিত। বৃহত্তর হিন্দুত্বের ডাক দিয়া সঙ্ঘ পরিবার জাতপাতের প্রশ্নগুলিকে অস্বীকার করিতে চাহে। তেমনই ভারতীয়ত্বের পরিসরে মুসলমানদের ‘সংখ্যালঘু’ পরিচিতিটিকে অস্বীকার করিতে চাহিলে তাহাতেও সংখ্যাগরিষ্ঠেরই লাভ দাঁড়ায়। বস্তুত, ভাগবত জানাইয়াছেন, জাতির সংজ্ঞা নির্ধারণ করিতে হইলে তিনি ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটিকেই রাখিবেন— তবে কেহ একান্ত চাহিলে ‘ভারতীয়’ শব্দটি ব্যবহার করিতে পারেন। অর্থাৎ, ‘হিন্দু ভারত’-এ তিনি মুসলমানদের সংখ্যালঘু পরিচয়ে আপত্তি তুলিতেছেন। তবুও বলিতেই হয়, তাঁহার বক্তৃতাটি স্বাগত। এত দিন অবধি এই প্রশ্নগুলিতে বিরোধীরা যখন তর্ক তুলিতেন, কার্যত একটি বন্ধ দরজার সম্মুখে দাঁড়াইয়া তাঁহাদের কথা বলিতে হইত। ভাগবত সেই দরজা খুলিয়া দিলেন। বিরোধীদের তর্কে এ বার কিছু সুবিধা হইবে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন