সুনির্দিষ্ট দিশা খুঁজছিল দেশ, দেখাতে পারলেন না মোদী-জেটলি

প্রত্যাশা ছিল অনেক। প্রধানমন্ত্রী বললেন, প্রত্যেকের প্রত্যাশা পূরণ করেছে এই বাজেট। কিন্তু বাস্তবটা ঠিক বিপ্রতীপ, কোনও প্রত্যাশাই পূরণ হল না। ভারসাম্যের নিখুঁত পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়ার কথা ছিল নরেন্দ্র মোদী-অরুণ জেটলিদের।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:৩৯
Share:

প্রত্যাশা ছিল অনেক। প্রধানমন্ত্রী বললেন, প্রত্যেকের প্রত্যাশা পূরণ করেছে এই বাজেট। কিন্তু বাস্তবটা ঠিক বিপ্রতীপ, কোনও প্রত্যাশাই পূরণ হল না। ভারসাম্যের নিখুঁত পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়ার কথা ছিল নরেন্দ্র মোদী-অরুণ জেটলিদের। নিখুঁত কৌশলে সরু সুতোর উপর দিয়ে হেঁটে এক মেরু থেকে অন্য মেরুতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরীক্ষাটার সম্মুখীনই হতে চাইল না সরকার। এমন এক পথে হাঁটলেন মোদী-জেটলিরা, যে পথে পাশ-ফেলের প্রশ্নই নেই, উচ্চাকাঙ্খার কোনও ছাপ নেই, অতএব ঝুঁকিও নেই বিন্দুমাত্র।

Advertisement

হয় সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে অর্থনৈতিক সংস্কারের পথে হাঁটতে হবে সরকারকে। না হলে ঠিক বিপ্রতীপে গিয়ে আদ্যন্ত জনমোহিনী হয়ে উঠতে হবে। বাজেট ভাষণটাকে উজ্জ্বল করে তোলার জন্য পথ ছিল এই দু’টিই। কোনও পথই নিলেন না অরুণ জেটলি। নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেওয়া গণ্ডির কারণেই হোক বা অন্য কোনও হিসেবের কথা মাথায় রেখে, আদ্যন্ত জনমোহিনী মোটেই নয় এই বাজেট। আর অর্থনৈতিক সংস্কার? তার চিহ্ন এই বাজেটে আতস কাচের সাহায্য নিয়ে খুঁজতে হয়। বাজেট জনমুখী হোক বা না হোক, জনদরদের একটা মোড়ক যে খুব জরুরি, তা মোদী-জেটলিরা জানেন। তাই সংস্কারের পথ মাড়ালেনই না। বরং একটু কৃষি ঋণ, একটু পরিকাঠামো উন্নয়ন, একটু কর্মসংস্থান, একটু গ্রামীণ বিকাশের কথা বলে জনদরদের প্রলেপে মুড়ে রাখার চেষ্টা করলেন বাজেট ভাষণকে।

রেল বাজেটকে সাধারণ বাজেটে মিশিয়ে দেওয়া অবশ্যই বড় এবং বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত। সে কথা আগেই বলেছি। কিন্তু সিদ্ধান্তের বলিষ্ঠতা যতটা, প্রয়োগ মোটেই ততটা নয়। রেলওয়েকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা এ বাজেটে সে ভাবে দৃশ্যমান নয় ঠিকই। কিন্তু রেলের কাঙ্খিত বিকাশ নিয়ে সরকারের কোনও মৌলিক চিন্তার ছাপ বাজেটে দেখা গেল না।

Advertisement

শুধু রেল নয়, গোটা বাজেটেই একই অভাব দৃশ্যমান। মৌলিকত্ব কোথাও নেই। সরকার জানাল, কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করা হবে। সরকার জানাল, ১০ লক্ষ কোটি টাকা কৃষি ঋণ হিসেবে দেওয়া হবে। সরকার আরও জানাল, সেচের উন্নতি হবে, শিক্ষার সুযোগ বাড়বে, ১০০ শতাংশ গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছবে, কর্মসংস্থান হবে, গ্রামীণ পরিকাঠামো বাড়বে, কম দামে আবাসন হবে, মধ্যবিত্তকে আগের চেয়ে কিছুটা কম কর দিতে হবে।

এই ঘোষণাগুলির একটিতেও স্বকীয় ভাবনার ছাপ নেই। ভোটব্যাঙ্কের নিরাপত্তায় দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে পূর্ববর্তী একাধিক মন্ত্রিসভা তাদের পেশ করা ততোধিক বাজেটে বার বার এই পথে হেঁটেছে। আরও এক বার মোদী-জেটলি সেই ঝুঁকিহীন তথা দিশাহীন পথটাই বেছে নিলেন।

কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে, কিন্তু সুনির্দিষ্ট রূপরেখা নেই। কর্মসংস্থান বাড়ানোর অঙ্গীকার রয়েছে, কিন্তু উপায়ের উল্লেখ নেই। গ্রামীণ পরিকাঠামো এবং গ্রামীণ জনজীবনের সার্বিক উন্নতির কথকতা রয়েছে, কিন্তু সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নেই। এ দেশের রাজনীতিতে একটু গ্রামের কথা বলে, একটু বেকারের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে, একটু কৃষকের প্রতি দরদ দেখিয়ে স্বল্পকালীন মেয়াদের জন্য ভোটব্যাঙ্কের স্থিতাবস্থা হয়তো বহাল রাখা যায়। কিন্তু দীর্ঘকালীন লাভ কিছু হয় না— দলেরও হয় না, দেশেরও হয় না।

মুদ্রা প্রত্যাহার উত্তর পরিস্থিতিতে ভারতের অর্থনীতি সঙ্কটের মধ্যে, এ কথা সরকারও প্রকারান্তরে মেনে নিয়েছে। সে ধাক্কা সামলে নিয়ে নতুন করে পথ চলার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল ভারতীয় অর্থব্যবস্থার শিরায়-উপশিরায়। জমা-খরচের হিসেব-নিকেশ সেরে দেশের অর্থনীতি একটা নতুন বাঁক নেওয়ার প্রতীক্ষায় প্রহর গুণতে শুরু করেছিল। অরুণ জেটলির বাজেট ভাষণই সেই কাঙ্খিত বাঁকটা এনে দিতে পারত। কিন্তু কোনও দিশাই অর্থমন্ত্রী দেখাতে পারলেন না। এক অদ্ভুত স্থিতাবস্থাপন্থী অবস্থান নিয়ে যাবতীয় সম্ভাবনায় জল ঢেলে দিলেন। দেশের অর্থনীতি যদি স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে থাকত, তা হলে হয়তো এই বাজেটকে খুব হতাশাজনক বলা যেত না। কিন্তু সঙ্কট বা বিপর্যয়কালীন পরিস্থিতি থেকে দেশের অর্থব্যবস্থাকে টেনে তুলতে এই বাজেট যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবে, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন