প্রবন্ধ ১

তাঁর ম্যাজিক না থাকলেও উগ্র হিন্দুত্বের টানটা আছে

ইলাহাবাদে সিভিল লাইনসে প্রাচীন ইন্ডিয়ান কফি হাউস। নেহরু যুগে প্রবীণ কংগ্রেস নেতাদের জমাটি আড্ডাস্থল। আজকের উত্তরপ্রদেশের ভোট নিয়েও এই কফিহাউস এখন উত্তাল।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share:

রায়দাতা: উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে ভোটদাতাদের সধৈর্য প্রতীক্ষায় কি পরিবর্তনের ইঙ্গিত? দেওবন্দ, ১৫ ফেব্রুয়ারি। রয়টার্স

ইলাহাবাদে সিভিল লাইনসে প্রাচীন ইন্ডিয়ান কফি হাউস। নেহরু যুগে প্রবীণ কংগ্রেস নেতাদের জমাটি আড্ডাস্থল।

Advertisement

আজকের উত্তরপ্রদেশের ভোট নিয়েও এই কফিহাউস এখন উত্তাল। সেই আড্ডায় খোঁচাখোঁচা নানা ধরনের দাড়ি-সমৃদ্ধ অবয়ব। আধময়লা আলিগড়ি-পাজামা-পাঞ্জাবি। আবার হাইকোর্টের কালো কোট আইনজীবী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। বিচিত্র সেই ভিড়ের চরিত্রে পুরনো লোহিয়াপন্থী সমাজতন্ত্রীদের দাপট আছে। হিন্দুত্ববাদীরা এখানে আসেন কম।

ঘণ্টা দুয়েক ছিলাম। এ টেবিল থেকে সে টেবিল। কফির সঙ্গে চিকেন দোসা, এগ-উত্তাপম— এ ধরণের বিচিত্র খাবার। তবে কড়া টোস্ট আর গরম কফির কোনও বিকল্প নেই। এরই মধ্যে পপুলার মুড টের পেলাম— নরেন্দ্র মোদীর হিন্দুত্ববাদী মেরুকরণের রাজনীতির সাফল্য নিয়ে শঙ্কা। আগেই বলেছি, কফিহাউস সংস্কৃতিতে নেহরু-লোহিয়ার মিশ্র দাপট আজও। তবু ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্যামাচরণ তিওয়ারির মতো অনেকেই মনে করছেন, মোদীর জাদু এখনও কাজ করছে। বললাম, তিন বছর আগে লোকসভা নির্বাচনের সময় এ রাজ্যে এসে দেখেছি মোদী ঝড়। এখন সে ঝড় কোথায়? জবাবে উচ্চবর্ণের এই বিদ্বৎসমাজ বলছেন, হয়তো সেই আঁধি নেই। কিন্তু এখনও মানুষ মোদীর উপর আস্থা রাখছেন।

Advertisement

এ বার উত্তরপ্রদেশে রাজনৈতিক নেতাদের ভোটপ্রচার দেখতে এসেছিলাম কয়েক দিনের জন্য। রাহুল গাঁধী এবং অখিলেশ যাদবের জুটির রোড শো দেখলাম। দেখলাম এই শহরের মানুষের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। যাদব-মুসলমান ভোটব্যাঙ্কের রাজনৈতিক দল পিতা মুলায়ম সিংহ যাদবের সমাজবাদী পার্টি। পুত্র কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনও জনসভায় এমন কোনও বক্তৃতা দেননি যাতে বলা যায় তিনি নিজের ভোটব্যাঙ্কে সুড়সুড়ি দিচ্ছেন। বরং এ রাজ্যেও যে এক বিপুল জনসংখ্যা নতুন ভবিষ্যৎ রচনার স্বপ্ন দেখছে, তাদের দিকেই অখিলেশের নজর বেশি।

রাহুল গাঁধী সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে জোট বেঁধেও সঠিক কাজ করেছেন বলে আমি মনে করি। বরং বিহারে ভাল ফল পেয়ে তিনি যে তার পুরনো ‘একলা চলো রে’ নীতি থেকে সরে এসে জোট রাজনীতির পথে হাঁটছেন, সেটা তাঁর রাজনৈতিক পরিণতমনস্কতা। উত্তরপ্রদেশে লোকসভা ভোটের সময় কংগ্রেসের শতকরা ভোট ছিল মাত্র সাড়ে সাত। সাংসদের সংখ্যা দুই। এমনিতে কংগ্রেসের প্রতি মানুষের যে অনাস্থা রাও-জমানায় ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙার পর দেখা যায়, তার পুনরুজ্জীবন যে এখনও হয়নি তা তো রাহুল গাঁধী নিজেই জানেন।

উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের ঝোলা থেকে দলিত ভোট চুরি করেছে কাঁসিরাম-মায়াবতীর হাতি। সমাজবাদী পার্টি যাদব ও মুসলমান সমাজের দলে পরিণত হয়েছে রামমন্দির আন্দোলনের মেরুকরণের রাজনীতির ফলস্বরূপ। অন্য দিকে বিজেপি ওই আন্দোলনের মাধ্যমেই দুই থেকে প্রায় দুশোর দলে পরিণত। মনে আছে, লালকৃষ্ণ আডবাণীর রথযাত্রার সময় লালু আর মুলায়মের মধ্যে রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল যে কে আগে তাঁকে গ্রেফতার করবে। দুই চরমপন্থী শিবিরের সংঘাতে কংগ্রেসের বহুত্ববাদী ধর্মনিরপেক্ষ অস্তিত্ব রক্ষা করাই কঠিন হয়ে পড়ে।

এর ফলে অসহায় রাজীব গাঁধী কখনও শাহবানু মামলা, কখনও অযোধ্যার শিলান্যাস করেন। তার ফলে কংগ্রেসের আমও যায়, ছালাও যায়। দক্ষিণী প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের জমানায় বাবরি মসজিদ ভাঙার পর তো কংগ্রেসের অবক্ষয়ের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকা হয়। রাহুল গাঁধীর রাজনৈতিক অভিমুখ ঠিক। কৌশলও অতি উত্তম। অখিলেশ রাহুল জুটির রসায়নও দ্রুত গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। আর সেটা দেখেই নরেন্দ্র মোদী আর অমিত শাহ আরও আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে হিন্দুত্ব ভিত্তিক মেরুকরণের রাজনীতিকে প্রতিদিন তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলছেন।

লোকসভা নির্বাচনের সময় দেখেছি, দশ বছরের মনমোহন সরকারের নীতিপঙ্গুতায় ক্ষুব্ধ জনতা মোদী নামক সুপারম্যানের উপর ভরসা করতে শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর লন্ডনবাসীর হতাশা দূর করতে যেমন এক জন জেমস বন্ডের দরকার ছিল, ঠিক সে ভাবে তিন বছর আগে বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে বিজেপিকে একক ভাবে ২৮২ টি আসনে জেতান তিনি। অটলবিহারী বাজপেয়ীর ভাবমূর্তি ছিল উদার, লালকৃষ্ণ আডবাণী ছিলেন কট্টরপন্থী। মোদী হলেন টু-ইন-ওয়ান। এক দিকে বিকাশ পুরুষ, অন্য দিকে গোধরা-সিদ্ধ হিন্দু হৃদয়সম্রাট। হিন্দুত্বের মাধ্যমে ভোটব্যাঙ্কে মেরুকরণ, আর্থিক বিকাশ এবং শক্তিশালী জাতিরাষ্ট্রের ইস্পাত-পুরুষ। এই প্যাকেজকে জনপ্রিয় করতে বিজ্ঞাপন ও জনসংযোগ সংস্থা সোশ্যাল মিডিয়া গোষ্ঠীর পেশাদারি নৈপুণ্য ব্যবহৃত হয় কোটি কোটি টাকায়।

তিন বছর অতিক্রান্ত। সেই মোদী ঝড়, সেই মোদী ম্যাজিক আজ নেই। বরং শুরু হয়ে গিয়েছে শেষের শুরু। কারণ, সেটাই প্রকৃতির সূত্র। ’৮৪ সালের মিস্টার ক্লিনকেও ’৮৭ সালে বফর্স গাঁধী হতে হয়েছিল। তার আগে ’৭১ সালের মা দুর্গা ’৭৫ সালে কী ভাবে জরুরি অবস্থার জন্য জনপ্রিয়তা হারান তারও সাক্ষী ভারতের মানুষ। নরেন্দ্র মোদী এই রাজনীতির অমোঘ নিয়মের ব্যতিক্রম হতে পারেন না। কিন্তু তিন বছর আগের জনপ্রিয়তা না থাকলেও আর্থিক ক্ষেত্রে সমস্যা তীব্র, এ কথাও অনস্বীকার্য হলেও উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক ভোট হবে না, এ কথা বলা যায় না।

মোদীবাদী এই উগ্র রাজনীতিতে উত্তরপ্রদেশের ভোটাররা এতে আন্দোলিত হবে না, তা তাল ঠুকে বলতে পারছি না। ১৯২৫ সালে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি ও আরএসএস, দুটি সংগঠনেরই জন্ম। আজ গোটা দেশে আরএসএস কতটা জায়গা জুড়ে আছে। আর কমিউনিস্টরা কোথায়? যুক্তি বহু ক্ষেত্রে ভক্তির ক্ষেত্রে হেরে যায়। বিজেপির কোনও কোনও মোদী-অবিশ্বাসী নেতা অবশ্য বলছেন, উত্তরপ্রদেশে এর আগের বার মুজফ্ফরনগরের ঘটনা আগে হয়, যাতে বিজেপি প্রতিক্রিয়ার রাজনীতি করে। এ বার কিন্তু বিজেপি নিজে থেকেই উগ্র হিন্দুত্বের রাজনৈতিক কৌশল নিয়েছে। তাতে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ এককাট্টা হবে তো?

দ্বিতীয় প্রশ্ন, এই মেরুকরণের ফলে মুসলমান ভোট নিরাপত্তার অভাবে অখিলেশ-রাহুল জোটের দিকে এককাট্টা হবে না তো?

শেষ কথা জানার জন্য ভোটের ফলাফল পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। কিন্তু প্রতাপগড়ের মিশ্রজির কথাটা ভুলতে পারছি না। তিনি বলেছেন, জানেন তো আমাদের কেন্দ্রে প্রার্থী কুর্মি জাতের। আমরা ব্রাহ্মণ। কুর্মিকে ভোট দিই না নিচু জাত বলে। কিন্তু ভোট দিচ্ছি শুধু মোদীর জন্য। হিন্দুদের নিরাপত্তা আজ বড় বিঘ্নিত। একমাত্র মোদীজিই পারেন আমাদের রক্ষা করতে। সুতরাং বেঁচে থাক মেরুকরণ। বিপন্ন হোক গে গণতন্ত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন