শবরীমালা মন্দিরে যাওয়ার পথে বিক্ষোভ কর্মীদের।
অভূতপূর্ব সঙ্কট ঘনিয়ে উঠছে শবরীমালার মন্দিরকে ঘিরে। রাজনীতিকে এতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন পর্যায়ে পৌঁছতে সম্ভবত দেখেনি ভারত আগে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত একটা রায় দিয়েছে। আর দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলটি প্রকাশ্যে বলতে শুরু করেছে যে, ওই রায় মানা হবে না। এমন বিস্ময়কর পরিস্থিতির সম্মুখীন ভারত আগে কবে হয়েছে, বলা খুব শক্ত।
রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতার অভিযোগ ভারতের কোন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে ওঠেনি, তা বলা খুব শক্ত। সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা বা জাতীয় স্বার্থ ভুলে শুধু ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতিতে ডুব দেওয়ার অভিযোগ কম-বেশি প্রায় সব রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধেই কখনও না কখনও উঠেছে এ দেশে। কিন্তু এ বার যে দায়িত্বজ্ঞানহীনতা দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে অতীতে কোন ঘটনার তুলনা টানা চলে, সত্যিই বুঝে ওঠা যাচ্ছে না।
একটা অবান্তর নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘদিন ঘিরে রেখেছিল শবরীমালা পাহাড়ে আয়াপ্পা স্বামীর মন্দিরকে। ঋতুমতী নারীর প্রবেশাধিকার ছিল না মন্দিরে। সে নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতাও দীর্ঘ সময় ধরেই চলছিল। বিরোধ গড়িয়েছিল দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত। আদালত বিধিনিষেধ উড়িয়ে দিয়েছে, মন্দিরে সব বয়সের নারীর প্রবেশাধিকার সুনিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছে।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
আমাদের সামাজিক আবহটা এখনও যে রকম, আমাদের পারিপার্শ্বিকতায় এখনও যে সব বদ্ধতা রয়েছে, তাতে এই রায়ের বিরোধিতায় যে আমাদেরই একাংশ খড়্গহস্ত হবেন, তা জানাই ছিল হয়তো। কিন্তু রাষ্ট্রেরও তো একটা নির্দিষ্ট কাঠামো রয়েছে, গোটা বন্দোবস্তটা তো কিছু বুনিয়াদি নীতির উপরে ভিত্তি করেই চলে। তাই ওই বুনিয়াদি নীতিগুলোকে যে কোনও মূল্যে মেনে চলাই দস্তুর। সেই প্রাথমিক শিক্ষাটুকুও যদি আমরা ভুলে যাই, তা হলে বড়সড় বিপদ ঘনিয়ে ওঠার উপক্রম হয়। শবরীমালাকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি এখন সে পথেই যেন।
আরও পড়ুন
মেয়েরা কি শবরীমালায় ঢুকতে পারবেন? বিরোধ-বিক্ষোভে উত্তেজনা কেরলে
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রকাশ্য বিরোধিতা শুরু করেছে বিজেপি। দলের পতাকা হাতে নিয়ে বিজেপি কর্মী-সমর্থকরা রাস্তায় নেমে পড়েছেন। আয়াপ্পা স্বামীর গর্ভগৃহে ঋতুমতী নারীর প্রবেশ আটকাতে যে তথাকথিত ভক্তকুল এখন ভারতের দক্ষিণ প্রান্তে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, সেই ‘ভক্তকুল’কে ঘোষিত ভাবেই সমর্থন করছে বিজেপি। বাম শাসিত রাজ্যটির প্রশাসনকে সময় বেঁধে দিয়েছে বিজেপি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ‘প্রতিকার’ না করতে পারলে রাজ্যের নাগরিকদের দরজায় দরজায় পৌঁছে গিয়ে বিপুল আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিতে শুরু করেছে বিজেপি।
বিস্ময়কর! আশ্চর্যজনক! স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধির পরিসরের অনেক বাইরের এক আচরণ!
বিজেপি এই মুহূর্তে ভারতের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। বিজেপি দেশের শাসক দল। বিজেপি সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অঙ্গরাজ্যের শাসক দল। অর্থাৎ ভারতে এই মুহূর্তে যতগুলি রাজনৈতিক দল রয়েছে, তাদের মধ্যে বিজেপির সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা সবচেয়ে বেশি। সেই দলের নেতৃবর্গ কি জানেন না,সুপ্রিম কোর্টের বা যে কোনও আদালতের কোনও রায় অপছন্দ হলে, তার বিরোধিতা কী ভাবে করতে হয়? রায় পছন্দ না হলে ফের সর্বোচ্চ আদালতেরই দ্বারস্থ হওয়া যেতে পারে। রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন জানানো যেতে পারে। কিন্তু বিজেপি সে পথে হাঁটল না। রাস্তায় নেমে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরোধিতা শুরু করল। সর্বোচ্চ আদালতের রায় রূপায়ণের চেষ্টা হলে বৃহত্তর আন্দোলন শুরু হবে বলে প্রশাসনকে বিজেপি হুমকি দিল।
আইনের শাসন বলে তো একটা কথা রয়েছে। ভারত ভূখণ্ডের একটা সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামো তো রয়েছে। সেই কাঠামোকে মেনে রাজনীতি করার দায়বদ্ধতা তো রয়েছে। সব কিছু এক সঙ্গে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলে চলবে কী ভাবে? এ তো সরাসরি আইনের শাসনকেই অস্বীকার করা! অস্বীকার করছেন কারা? দেশের শাসক দলের নেতা-কর্মীরা!
যে জটিলতার জন্ম দেওয়া হল, তা কত দূর গড়াতে পারে, ধারণা করতে পারছেন কি কেরলের বিজেপি নেতারা? কেরলের সরকারের উপরে বিজেপি চাপ সৃষ্টি করছে এখন। কেরলের সরকার যদি এ বার কোনও ভাবে বলটা ঠেলে দেয় কেন্দ্রীয় সরকারের কোর্টে, তা হলে কী হবে? বিজেপি এক অবস্থানে, বিজেপি পরিচালিত সরকার আর এক অবস্থানে— এই রকম কোনও দৃশ্যই কি তৈরি হবে? নাকি সাংবিধানিক দায়বদ্ধতার আরও বড় কোনও উল্লঙ্ঘন ঘটবে? গোটা দেশকে এত বড় একটা প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করানোটা কি কোনও অর্থেই শুভ? উত্তরটা খোঁজার চেষ্টা করুক বিজেপি।