পিকনিক-দলের আকর্ষণ ফাগু। ফাইল ছবি
আমাদের রাজ্যে সাধারণত নভেম্বর মাস থেকেই ত্বকের শুষ্কতা জানান দেয় যে, শীত আসছে। শারদোৎসবের মেজাজ শেষ হওয়ার পরে হেমন্তের হিমেল হাওয়ার হাত ধরেই শীতের আগমন। ঠিক সেই সময় থেকেই উৎসবের মেজাজ ধরে রাখতে সকলেই প্রায় শীতের পিকনিকের নানান পরিকল্পনা করতে শুরু করে দেন। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে বিশেষ কিছু ছুটির দিনের পাশাপাশি মাসের রবিবারগুলিতে অসংখ্য মানুষ পিকনিকের জন্য বেরিয়ে পড়েন তাঁদের নির্ধারিত স্থানগুলিতে।
দক্ষিণবঙ্গে বেশ কিছু প্রাকৃতিক পিকনিক স্পটের পাশাপাশি সরকারি, বেসরকারি পিকনিক স্পট তৈরি করা হলেও উত্তরবঙ্গের পিকনিক স্পটগুলির অধিকাংশই প্রকৃতিসৃষ্ট। পাহাড়, জঙ্গল, নদীতে ঘেরা উত্তরবঙ্গের চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য এ রকম পিকনিক স্পট। তাই অনেকে একেক বছর এক একটি জায়গাকে বেছে নেন দলবদ্ধ ভাবে আনন্দ উপভোগের জন্য। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর উত্তরবঙ্গের দু’টি এমন পিকনিক স্পটের নাম হল ঝান্ডি ইকো হাট ও লাল ঝামেলা বস্তি।
জলপাইগুড়ি জেলার ঝান্ডি ইকো পার্ক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এমন একটি জায়গা। মালবাজার থেকে ৩২ কিলোমিটার দুরে লোয়ার ফাগু চা-বাগানের ভিতর দিয়ে যাওয়ার পথে গাড়ি থেকে নেমে সবুজ বাগান দেখার লোভ জাগে নিজের অজান্তেই। তবে, গন্তব্য ঝান্ডি ইকো পার্কে পৌঁছলেই মন কেড়ে নেয় সেখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যই। চা-বাগানের দৃশ্য এক রকম। নদীর ধারের চার পাশের দৃশ্য অন্য রকম। কোনওটার চেয়ে কোনওটাই কম নয়। একদিনের পিকনিক ছেড়ে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে মনকে আকুল করে। এখানকার এই নদীর ধারেই বড় বড় ছাতা ও খড়ের ঘর তৈরি করে পিকনিক স্পটটিকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে। রোজকার সাধারণ কাজে এই নদীর জলই ব্যবহার করা হয়। তবে, রান্না ও খাওয়ার জল বয়ে নিয়ে আসতে হয় একটু দূর থেকে। কারণ, প্রবহমান নদীর জল ব্যবহারের উপযোগী হলেও খাওয়ার জন্য কতটা উপযোগী, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
পাহাড়ি এই ঢালে স্থানীয় বাসিন্দারা গাড়ি প্রতি ৫০ টাকা করে নেন জায়গাগুলো পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য। এখানে এই পিকনিক স্পটকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু দোকানপাট। হয়েছে কিছু কর্মসংস্থানও। শহর থেকে দূরে গ্রাম্য এই মানুষগুলোর রুজিরুটির ভাবনা কিছুটা স্বস্তি পায় শীতকালের পিকনিক-পিপাসু মানুষের কাছ থেকে। জায়গা সাফ করে দেওয়া কিংবা জিনিস আনা-নেওয়া করায় কিছুটা পারিশ্রমিক পেয়ে কয়েকটা দিনের খাদ্যসংস্থান হওয়ায় এ সময় তাঁদের মুখে হাসি ফোটে। এত সুন্দর একটি পিকনিক স্পটটিকে সুন্দর করে রাখার দায়িত্ব সকলেরই। কিন্তু পিকনিক করতে এসে জায়গা নোংরা করে রাখার প্রবণতা ইদানীং উত্তরোত্তর বাড়ছে।
চিরসবুজ ঝান্ডি গ্রাম। ফাইল ছবি
পিকনিক স্পটে পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর, এমন জিনিসপত্র না আনাই শ্রেয়। পরিবেশের সবচেয়ে বড় শত্রু থার্মোকল আর প্লাস্টিক। তার বদলে পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার করলে তা সকলের পক্ষেই হিতকর। সবাই যদি নিজেরাই জায়গাটিকে ব্যবহার করে দায়িত্ব নিয়ে সাফ করে দেন, তাহলে এমন সুন্দর স্থান তার আকর্ষণীয়তা হারায় না। পাশাপাশি, পানীয় জলের কোনও ব্যবস্থা থাকলে অত দূর থেকে কাউকে জল বয়ে অানতে হয় না। সরকার থেকে প্লাস্টিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে যদি কড়াকড়ি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হত, তাহলে জায়গাগুলির পরিবেশ রক্ষা পেত। নিয়ম রয়েছে, কিন্তু সে নিয়ম মান্যতা পাচ্ছে কি না। তা দেখা হচ্ছে কোথায়! এবং এই উদাসীনতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উত্তরের এই সুন্দর জায়গাগুলি।
উত্তরবঙ্গের আরও একটি পিকনিক স্পটের নাম হল লাল ঝামেলা বস্তি। না, নামের সঙ্গে স্থানের কোনও মিল নিই। এখানে রাঢ়বঙ্গের মতো রাঙা মাটি নেই। বসতিও নেই তেমন। ঘিঞ্ঝি পরিবেশ বা ঝুট ঝামেলার প্রশ্নই ওঠে না এখনও এখানে। সম্পুর্ণ নিরিবিলি, অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর একটি জায়গা। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের অপরূপ শোভার সঙ্গে চারদিকে রয়েছে ভুটান পাহাড়ের বাহারি দৃশ্য।
নাগরাকাটা থেকে ধরণিপুর ও চ্যাংমারি চা-বাগানের ভিতর দিয়ে গিয়ে ভুটান বর্ডারের কাছে এই লাল ঝামেলা বস্তি। এখানে রয়েছে ভুটান থেকে বয়ে আসা ডায়ানা নদী। ডায়ানা নদীর ওপারেই ভুটান বর্ডার। আর দূরে দেখতে পাওয়া যায় দু’টি পাহাড়কে যোগ করেছে একটি ঝুলন্ত সেতু। একেবারে শান্ত নিরিবিলি সবুজে ঘেরা জায়গাটির পিকনিক স্পটে যেতে একটু কষ্ট করতে হয়।
পাহাড়ের টিলার নীচে রয়েছে ডায়ানা নদী। আর এই নদীর তীরই মূলত পিকনিক স্পট। তাই খাড়া পথ বেয়ে অনেকটা নীচে নামতে-উঠতে সমতলের মানুষকে বেশ কসরত করতে হয়। তবে, এত সুন্দর একটি জায়গার সৌন্দর্য উপভোগ করতে সে কষ্ট গায়ে লাগে না। আরও একটি বিষয় রয়েছে। স্থানীয় মানুষজন এই অসুবিধা দূর করতে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন। সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মালপত্র বয়ে দেন। সারাদিন চা-বাগান আর ভুটান পাহাড় দেখে, নদীর জলে পা ডুবিয়ে শীতল জলের স্পর্শ নিয়ে চমক লাগে শরীর- মনে। রান্না-খাওয়া শেষ হতে হতে লাল হয়ে আসে পশ্চিমাকাশ। সব মিলিয়ে যেন স্বর্গীয় অনুভূতি!
কিন্তু এখানেও সেই একই সমস্যা পিকনিক-জনিত দূষণের! এখানেও পরিবেশকে বিধ্বস্ত করে তোলে প্লাস্টিক, থার্মোকল, আবর্জনা! প্রকৃতি উজাড় করে দিয়েছে নানা দিক থেকে! কিন্তু সে প্রকৃতিকেই ধ্বংস করা হচ্ছে! যতদিন না মানুষ সচেতন হয়ে উঠবেন পরিবেশ বিষয়ে, ততদিন এই সমস্যার হাত থেকে মুক্তিও নেই!
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)