আদ্যন্ত নূতন একটি গোষ্ঠী তৈরির কথা শোনা গেল কংগ্রেস সাংসদ শশী তারুর-এর মুখে: অল ইন্ডিয়া প্রফেশনালস কংগ্রেস বা এআইপিসি। উদ্দেশ্য, সমাজের বিভিন্ন স্তরের পেশাদার মানুষদের এক জায়গায় লইয়া আসিয়া দেশের রাজনীতি সম্পর্কে তাঁহাদের ধ্যানধারণা, মতামতের একটি প্রশস্ত অবকাশ তৈরি করা, যাহাতে দেশের নীতি, আইন, সংস্কার এই সব বিষয়ের সহিত তাঁহাদের অন্তত পরোক্ষ ভাবে যুক্ত করা যায়। খুবই নূতন ভাবনা, সন্দেহ নাই। প্রকাশ্য উদ্দেশ্যের পিছনে যে প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্যটি অনুমেয়, তাহাও নূতন ধরনের: সমাজের যে শিক্ষিত ও পেশাগত জীবনে স্থিত নাগরিকরা কোনও ধরনের গোঁড়া আদর্শবাদের বাহিরে থাকিয়াই নিজেদের রাজনৈতিক মতটি নির্মাণ করেন, এই গোষ্ঠী দিয়া তাঁহাদের কাছে টানিবার চেষ্টা চলিবে। স্বাধীন ভারতেই এমন প্রয়াস আগে দেখা যায় নাই। রাজনৈতিক দল এবং অ-রাজনৈতিক সমাজ এ দেশে বরাবরই বিচ্ছিন্ন থাকিয়াছে। নাগরিক সমাজ বলিয়া যে বস্তুটির ঝিলিক মাঝে মধ্যে দেখা দিয়াছে, তাহাও এমন সংগঠিত রূপ পায় নাই। দিল্লির আপ পার্টিও আর-একটি গতানুগতিক রাজনৈতিক দলই বটে, তাহার বাহিরে কিছু নয়। রাজনীতির বহিরঙ্গনে কোনও গোষ্ঠী বা সম্মিলন আগে এ দেশে সংগঠিত আকার পায় নাই। ইউরোপেও দেখা যায়, ফ্রান্স-সহ নানা দেশে অরাজনৈতিক নেতারা রাজনীতির অঙ্গনে আসিয়া কৃতিত্ব দেখাইয়াছেন ঠিকই, কিন্তু প্রথমত তাহা ব্যক্তিগত উদ্যোগ, এবং দ্বিতীয়ত রাজনীতি-অরাজনীতির মেলবন্ধনটির বদলে সেখানে আপ-এর আদলে রাজনীতি-অরাজনীতির সীমা-অতিক্রমের নিদর্শনই দেখা সম্ভব।
সুতরাং, স্বাগত নূতন উদ্যোগ! দেশজোড়া অসহিষ্ণুতার দ্রুত প্রসারের প্রেক্ষিতেই এই ভাবনার উদয়। তাই স্পষ্ট ভাষায় বলা হইয়াছে, এই গোষ্ঠীর সদস্যদের জানাইতে হইবে যে তাঁহারা সামাজিক ভাবে ধর্ম বা জাতির ভিত্তিতে বৈষম্যে বিশ্বাস করেন না, প্রয়োজনে সামাজিক বৈষম্য প্রতিরোধে তাঁহারা সক্রিয় হইবেন, অতিরিক্ত ধনসম্পদ আহরণ কিংবা সংরক্ষণে তাঁহারা আগ্রহী নন, এবং ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মূল সাংবিধানিক নীতিগুলির প্রতি তাঁহাদের আস্থা রহিয়াছে। প্রসঙ্গত, কেবল বিজেপি বা আরএসএস-এর চরম রক্ষণশীল ও বৈষম্যবাদই তো নহে, সম্ভবত গণতন্ত্রের মধ্যে নিহিত আর একটি বৃহত্তর ভয়— পপুলিজম বা জনপ্রিয়তাবাদের সহিত পাল্লা দিতে হইলেও মাঝামাঝি শ্রেণিভুক্ত উদারপন্থী জনসাধারণকে এককাট্টা করা ভিন্ন গতি নাই। অনেক সময়ই স্বল্পশিক্ষিত ও রাজনীতির সহিত স্বল্প-পরিচিত সমাজ হইতে অত্যন্ত সংকীর্ণ স্বার্থভিত্তিক মতামত উঠিয়া আসে, ফলে শ্রেণি, ধর্ম, জাত, ভাষা, অঞ্চল, সমস্ত রকম বৈষম্য সমাজে দ্রুত ছড়াইতে থাকে। উদার ও জনকল্যাণভিত্তিক সংস্কারের সম্ভাবনাগুলি রাজনীতি হইতে হারাইতে বসে। সেগুলিকে ফিরাইয়া আনিতে হইলে রাজনৈতিক ভাবে সচেতন, ও সামাজিক ভাবে উদারমনস্ক একটি সমাজকে নেতৃস্থানে আসিতে হয়। এআইপিসি জন্মের গুরুত্ব সেখানেই।
এই ধরনের সংগঠনের গুরুত্ব আজ এ দেশে অপরিসীম। সাম্প্রদায়িক ও জাতভিত্তিক অসহিষ্ণুতা এমন মাত্রায় পৌঁছাইয়াছে যে দ্রুত একটি বিপরীত সচেতনতার প্রসার জরুরি। এই গোষ্ঠী সে কাজে সফল হইবে কি না, বলা যায় না। কংগ্রেস দলটির কাছ হইতে নূতন প্রত্যাশার অবকাশ অতি দ্রুত কমিয়া আসিতেছে। কংগ্রেসের নেতৃত্বহীনতার অসুখ না এই উদ্যোগেও তাহার থাবা বসায়। সংসদীয় কার্যক্রমে, রাজ্যভিত্তিক সংগঠনে সর্বত্র যে দিশাহীনতা কংগ্রেস নেতারা নিয়মিত ভাবে দেখাইয়া আসেন, এত নূতন প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও যদি এই গোষ্ঠীটি সেই একই অসুখের শিকার হয়, হতাশার শেষ থাকিবে না।