পরিবেশ সচেতন হয়ে উঠুক উত্তরের নবীন প্রজন্ম

প্রকৃতি অকৃপণ ভাবে গড়ে তুলেছে উত্তরবঙ্গকে। কিন্তু গোটা বিশ্বের মতো উত্তরও নানা দূষণে জর্জরিত। পরিবেশ নিয়ে নাগরিক সচেতনতা গড়ে তোলা খুব জরুরি। লিখছেন রুদ্র সান্যালএত বিধিনিষেধ সত্ত্বেও প্লাস্টিকের বহুল পরিমাণে ব্যবহার সামুদ্রিক প্রাণী থেকে শুরু করে স্থলের নিরীহ প্রাণীদের জীবনকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। বিশেষ করে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়েছে মারাত্মক।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৯ ০১:১১
Share:

ছবি: সংগৃহীত

এখন বিশ্ব জুড়ে হুলুস্থুল কাণ্ড। পরিবেশ নিয়ে বিজ্ঞানীদের যে রকম আশঙ্কা ছিল, তার চেয়েও খুব দ্রুত পরিবেশের অধঃপতন ঘটছে। ব্রাজিলের আমাজনের বৃষ্টি-অরণ্য যে রকম আগুনের গ্রাসে অনেকটা ধ্বংস হল, তা চিন্তার জন্ম দেয় বইকি। সমুদ্রের জলস্তর বেড়ে চলেছে হু-হু করে। উত্তরমেরুর বরফ গলে যাচ্ছে খুব দ্রুত হারে। কয়েকদিন আগেই আন্টার্টিকার একটা সুবিশাল বরফে ঢাকা স্তর বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে মূল ভুখণ্ড থেকে। যা এক কথায় শেষের সেদিনের ভয়ঙ্করের রূপের অশনিসঙ্কেত দিচ্ছে খুব দ্রুততার সঙ্গে।

Advertisement

এত বিধিনিষেধ সত্ত্বেও প্লাস্টিকের বহুল পরিমাণে ব্যবহার সামুদ্রিক প্রাণী থেকে শুরু করে স্থলের নিরীহ প্রাণীদের জীবনকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। বিশেষ করে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়েছে মারাত্মক। কিছুদিন আগেই চেন্নাইয়ের জলসঙ্কট দেখিয়ে দিয়েছে, ভূগর্ভস্থ জলের অপব্যবহার কোন পর্যায়ে গেলে মানবসভ্যতা তথা জীবজগত এই ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। আসলে, পরিবেশ দূষণের পুরোটাই মানবসৃষ্ট। কিন্তু তার ফল ভুগতে হচ্ছে অন্যান্য জীব ও উদ্ভিদ জগতকেও। ধূলিধূসর হয়ে গিয়েছে বাতাস। ভারতের রাজধানী দিল্লিও তার ব্যতিক্রম নয়। মানবসৃষ্ট দূষণ মানুষকেও কষ্ট দিচ্ছে বার বার।

আসা যাক আমাদের এই উত্তরবঙ্গে। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই অঞ্চল। একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে পাহাড়ি খরস্রোতা নদী। জঙ্গলে ঘেরা ডুয়ার্স আর তার সঙ্গে সারি সারি চা-বাগান। এক অনাবিল সৌন্দর্য হাতছানি দিয়ে ডাকে সারা ভারত তথা বিশ্বের পর্যটকদের। জঙ্গলে রয়েছে নানান প্রাণীজ সম্পদ। হাতি, গন্ডার, চিতা, হরিণ, ময়ূর, নানা ধরনের পাখি। জলাশয়গুলিতে শীতকালে আসে পরিযায়ী পাখির দল। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। এখানকার গ্রামীণ সাধাসিধে মানুষ এই জগৎ নিয়েই খুব আনন্দে বেঁচে ছিলেন এতকাল। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সাম্প্রতিক কালে ঘটে চলা ব্যাপক পরিবেশ দূষণ মানুষ, অন্য প্রাণী েবং উদ্ভিদজগতকে ত্রস্ত করে তুলেছে।

Advertisement

যে ভাবে আমাদের এই উত্তরবঙ্গের প্রাকৃতিক পরিবেশ বদলে যাচ্ছে, তা আমরা যারা এখানে বসবাস করি, তারা সবাই বুঝতে পারছি। মানুষের সর্বগ্রাসী লোভ এখানকার বাস্তুচক্রকে ক্রমশ ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একদিকে চোরাশিকারির দল, অন্যদিকে কাঠ-মাফিয়ারা জঙ্গল ধ্বংস করছে খুব দ্রুত হারে। বাইরে থেকে পর্যটকেরা তাঁদের আনা বর্জ্য পদার্থকে যে ভাবে যত্রতত্র নদীতে বা জঙ্গলে ফেলে দিচ্ছেন কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে, তাতে এই অঞ্চল ক্রমশ প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারাচ্ছে। জঙ্গলের মধ্যে রেললাইন থাকায় বহু হাতির মৃত্যু হচ্ছে রেলের ধাক্কায়, যা কাম্য নয়। আসলে, হাতির যাওয়া-আসার পথেই তৈরি হয়েছে রেলপথ। তাই স্বাভাবিক ভাবেই বিপর্যয় ঘটে চলেছে বছরের পর বছর। জলাশয়গুলিতে আশঙ্কাজনক ভাবে আসা কমে গিয়েছে পরিযায়ী পাখিদের। বিশ্ব উষ্ণায়নের ধাক্কায় সিকিম সংলগ্ন হিমবাহগুলির বরফ দ্রুত গলে যাচ্ছে। বিভিন্ন জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বাঁধ নির্মাণের ফলে পাহাড়ি নদীগুলির জলস্তর আশঙ্কাজনক ভাবে কমে গিয়েছে। পুরোটাই মানবসৃষ্ট বিপর্যয়। ভুগর্ভস্থ জলস্তরও এখানে কমে যাচ্ছে। প্রতি গ্রীষ্মে তা বোঝা যায় প্রকট ভাবে।

সরকারি প্রচেষ্টায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি নেওয়া হয়ে থাকে প্রতি বছরই। উত্তরবঙ্গের জেলায় জেলায় বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং ছাত্রছাত্রীরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বহু বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি নিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা হল, তারপর তা রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে কতটা সচেতন আমরা? উন্নয়নের নামে যে ভাবে জাতীয় সড়কের দু’পাশে বহু প্রাচীন বড় বড় বৃক্ষ কেটে ফেলা হল, তা এই অঞ্চলের পরিবেশের উপর এক দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেটা থার্নবার্গের কথা বার বার উঠে আসছে। মাত্র ১৬ বছরের সুইডেনের এই কিশোরী যে ভাবে বিশ্বের তাবড় তাবড় রাষ্ট্রকে ভাবতে বাধ্য করেছে পরিবেশ নিয়ে, তা এক কথায় অভূতপূর্ব। এই একরত্তি মেয়ে সারা বিশ্বের সাধারণ মানুষের নয়নের মণি হয়ে গিয়েছে তার পরিবেশ বাঁচানোর লড়াইয়ে। তার ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ আন্দোলনে বিশ্ব জুড়ে শামিল হয়েছে প্রচুর কিশোর-কিশোরী। এই বাংলাতেও তার ব্যতিক্রম নেই। তবুও এই উত্তরবঙ্গে এখনও সে রকম ভাবে গ্রেটা থার্নবার্গের ব্যক্তিগত আন্দোলনের মতো কোনও মুখ দেখা যায়নি।

তাই আমাদের উত্তরবঙ্গের ভূপ্রাকৃতিক সম্পদ তথা বৈচিত্রকে বাঁচানোর জন্য তরুণ প্রজন্মকে আরও অনেক বেশি করে এগিয়ে আসতে হবে গ্রেটার মতোই। তবেই হয়তো রাজনৈতিক নেতৃত্ব আরও গভীর ভাবে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ তথা জীববৈচিত্রের সংরক্ষণের কথা ভাবতে বাধ্য হবেন। তাই দলমত নির্বিশেষে গ্রেটা থার্নবার্গের আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে উত্তরবঙ্গের প্রতিটি জেলায় পরিবেশ সচেতন ছাত্রছাত্রীদের উঠে আসতে হবে দ্রুত। তা না হলে আরও বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে আমাদের আগামিদিনে।

(লেখক শিলিগুড়ির বিধাননগর সন্তোষিণী বিদ্যাচক্র হাইস্কুলের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন