সম্পাদকীয় ১

গদি সত্য নীতি মিথ্যা

ক্ষমতাকে পাখির চোখ করিয়া দুর্নীতির এই সময়োপযোগী এবং ক্ষেত্রোপযোগী ব্যবহারে অবশ্য বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারকে কেহ হারাইতে পারিবে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
Share:

নীতীশ কুমার দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ অর্থাৎ পদত্যাগ করিয়াছেন। প্রশ্ন উঠিয়াছে, দুর্নীতির সঙ্গে হাতটি তিনি কেন মিলাইয়াছিলেন। প্রশ্নটি সংগত, তবে উত্তরটিও কি সর্বজ্ঞাত নহে? দুর্নীতিদুষ্ট সঙ্গীর সঙ্গ তিনি ধরিয়াছিলেন ক্ষমতার জন্য। সেই সঙ্গ তিনি পরিহার করিলেন, তাহাও ক্ষমতার জন্যই। পরিহারের পথ দিয়াই যে আবার তৎক্ষণাৎ তাঁহার দৃঢ়তর ক্ষমতাসনে বসিবার পালা। সেই দিক দিয়া, নীতীশ কুমারের নীতির কোনও পরিবর্তন নাই। তাঁহার অভ্যন্তরীণ সমঞ্জসতা লইয়া সন্দেহের অবকাশ নাই। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী অতি দক্ষ রাজনীতিক। এ কালে রাজনীতিকের যাহা সর্বাপেক্ষা বড় গুণ, ক্ষমতায় থাকিবার প্রকরণটি বুঝিয়া-শিখিয়া লওয়া, তাহা তাঁহার মধ্যে ১০০ শতাংশ আছে। এই দিক দিয়া তিনি একেবারে প্রথম সারির তারকা। সুশাসন ইত্যাদি তো আপেক্ষিক। ক্ষমতা নিশ্চিত করিলে তবে তো সুশাসন। সুতরাং নীতীশ কুমার সুশাসনের প্রথম দায়টি পালন করিতেছেন, যেন তেন প্রকারেণ ক্ষমতা নিশ্চিত করিতেছেন। দুর্নীতি যেখানে ভারতীয় রাজনৈতিক মহলের আগাগোড়া একটি আবশ্যিক শর্তে পরিণত হইবার জোগাড়, সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর হঠাৎ নীতিবাগীশ হইয়া উঠিবার এমন আকুলতা, রাজ্যপালের তড়িঘড়ি অকুস্থলে উপস্থিত হইয়া পদত্যাগপত্র গ্রহণ করিবার এত তাড়া, সুশৃঙ্খল ভাবে পর দিনই নূতন সমীকরণে নূতন সরকার গড়িবার নিটোল ব্যবস্থাপনা, সবই নীতীশের উদ্দেশ্য-বিধেয়ের পরিচায়ক।

Advertisement

বরং এই সুযোগে একটি ‘অসংগত’ প্রশ্ন উঠানো যাক। দুর্নীতির হুজুগ তুলিয়া ক্ষমতা নিশ্চিত করিবার এই যে প্রকরণ— ইহাও কি আর এক রকম, বেশ বড় রকমের, দুর্নীতি নহে? সাধারণ নাগরিককে নৈতিকতার ভুল বার্তা পাঠাইয়া বিভ্রান্ত করাটা কি সুনীতি? কিংবা এক সঙ্গীর হাত ছাড়িয়া অন্য সঙ্গীর হাত ধরিতে (এবং অবিলম্বে তাহার হাত ধরিয়া নূতন সরকার গড়িতে) চাহিয়া ‘অন্তরের ডাক’ শুনিবার মহাত্মা-সমান দাবি কি নৈতিকতাসিদ্ধ? ইহাও তো বলা চলে না যে, আহা, নেহাত নীতির ঘরে চুরি, টাকার চুরি তো নয়। ভারতীয় রাজনীতিতে ক্ষমতা আর অর্থের সম্পর্ক যে কত হার্দিক, চটজলদি সরকার পাল্টাইবার পদ্ধতির মধ্যে অর্থচলাচল যে কতখানি স্বাভাবিক ও সহজবোধ্য, আসমুদ্রহিমাচল জানে। জানে, কেননা নীতীশ কুমার একা নন, তাঁহার আগে পরে উত্তরে দক্ষিণে অসংখ্য নেতা ঠিক এই কাজই করিয়াছেন। তবে নীতীশ কুমার যেমন অসংকোচে নিজের নামে দুর্নীতিবিরোধিতার মহিমা আদায়ের ব্যবস্থা করিয়াছেন, সকলেই তেমনটা করেন নাই।

ক্ষমতাকে পাখির চোখ করিয়া দুর্নীতির এই সময়োপযোগী এবং ক্ষেত্রোপযোগী ব্যবহারে অবশ্য বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারকে কেহ হারাইতে পারিবে না। নীতীশ কুমারও যে ‘দুর্নীতি-সংগ্রাম’-এ সাফল্যের শিখরে চড়িতে পারিলেন, তাহাও তাহাদের দাক্ষিণ্যেই। নরেন্দ্র মোদী আপাতত সুযোগ্য সঙ্গী অমিত শাহকে লইয়া একটি অশ্বমেধ যজ্ঞ চালাইতেছেন। যেখানে যেখানে অশ্ব বাধা পাইতেছে, সেখানেই দুর্নীতি খুঁজিয়া তাহার চমৎকার সদ্ব্যবহার করিতেছেন। সমাজে যাহা-কিছু যথার্থ দুর্নীতি-বিরোধিতা, তাহা দ্রুত বুদ্বুদে পরিণত হইবার জোগাড়। পশ্চিমবঙ্গের দৃষ্টান্ত স্মরণীয়। রাজ্য সরকারের বিবিধ দুর্নীতির সংবাদে রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজে যেটুকু নাড়াচাড়া পড়িয়াছিল, কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্নীতিপূর্ণ দুর্নীতি অভিযানের বহর দেখিয়া সে সব উবিয়া শূন্য। পড়িয়া আছে কেবল এই দল বনাম ওই দল, এই ক্ষমতা বনাম ওই ক্ষমতা। নীতীশ কুমারের বিহারেও তাঁহার ত্যক্ত-সঙ্গী লালুপ্রসাদ সম্ভবত হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিয়াছেন, তাঁহার পরিবারের বিরুদ্ধে যাহা কিছু দুর্নীতি অভিযোগ, সবই এ বার অপর পক্ষের চক্রান্ত বলিয়া দেখাইবার মস্ত সুযোগ তাঁহাদের হাতের মুঠিতে আসিয়া গিয়াছে!

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement