অর্থনীতির আলোচনার কেন্দ্রে নারী-বৈষম্যের প্রসঙ্গ সচরাচর আসে না। কিন্তু এ-বৎসর আর্থিক সমীক্ষার মলাট গোলাপি। রিপোর্ট বলিতেছে, ভারতে দুই কোটিরও অধিক অনভিপ্রেত কন্যাসন্তান জন্মাইয়াছে। এবং ‘অনুপস্থিত’ তাহার তিনগুণ— গর্ভাবস্থায় বা শৈশবে ছয় কোটি কন্যাকে নিকেশ করিয়াছে পরিবার। কিন্তু যাহারা বাঁচিয়া আছে, তাহাদের কী হইবে? কন্যাসন্তানের জন্য পরিবার যথেষ্ট ব্যয় করিবে কি না, তাহাদের প্রতি যত্নশীল হইবে কি না, সেই সংশয় প্রকাশ করিয়াছেন আর্থিক সমীক্ষার রচয়িতারা। ভারতীয় পরিবারে পুত্র-পক্ষপাত এবং কন্যাদের প্রতি দেশের সরকারের দায়বদ্ধতার কথা মনে করাইতে যদি আর্থিক সমীক্ষার মলাট রং বদলাইয়া থাকে, ভালই। কিন্তু কেবল মলাটই কি বদলাইবে? না কি রাষ্ট্রের আইন, সরকারি নীতি, রাজনৈতিক দলের কাজেও পরিবর্তন আসিবে? এখনও অবধি নরেন্দ্র মোদী সরকারের দিকে তাকাইলে ভরসা হয় না। সরকারের পাঁচ বৎসর মেয়াদের অধিকাংশ ব্যয় হইয়াছে, সংসদে এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণের নিমিত্ত মহিলা বিল মোদী সরকার আনে নাই। তাৎক্ষণিক তালাক নিষিদ্ধ করিবার আইন মধ্যপথে স্থগিত। বিরোধীদের অভিযোগ, আইনের খসড়ায় মুসলিম পুরুষদের কারাবাসের প্রস্তাব জুড়িয়া অকারণ বিতর্ক তুলিয়াছে সরকার। মহিলা সংগঠনের বক্তব্য, বিজেপি তালাকের প্রসঙ্গটিকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির তাস করিয়াছে।
মহিলাদের সমানাধিকার ও সক্ষমতার জন্য সর্বত্র আইনের প্রয়োজন নাই, সদিচ্ছাই যথেষ্ট। তাহারও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মিলে নাই। গত বৎসর যে রাজ্যগুলিতে বিধানসভা নির্বাচন হইয়াছে, তাহাতে সকল দলের মহিলা প্রার্থীর সংখ্যা ২০১২ সালের তুলনায় কমিয়াছে। নারী ক্ষমতায়নের বাদ্য যত উচ্চরবে বাজিতেছে, ততই নীরবে কিন্তু পরিকল্পিত ভাবে কাজ করিতেছে মেয়েদের প্রতি বঞ্চনা। পরিবার এবং রাজনৈতিক দল, উভয়ই মহিলাদের প্রতি প্রকাশ্যে সমাদর দেখাইয়া অলক্ষ্যে সরাইয়া দেয়। কেহ বিশ্ব হইতে, কেহ ক্ষমতার আসন হইতে। ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ প্রচারের অন্ত নাই, কিন্তু রাজনীতির জগতে শিক্ষিত কন্যাদের স্থান নাই, কাজের জগতেও নাই। নরেন্দ্র মোদীর ‘স্কিল ইন্ডিয়া’ প্রকল্প মেয়েদের দক্ষতা তৈরি করিয়া রোজগার বাড়াইয়াছে, এমন সাক্ষ্য মিলে নাই। আর্থিক সমীক্ষা বরং বলিতেছে, ২০০৫-০৬ সালে ৩৬ শতাংশ মহিলা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নিযুক্ত ছিলেন, ২০১৫-১৬ সালে তাহা ২৪ শতাংশ।
অর্থনীতিতে মহিলাদের যোগদানের এই অতি-সামান্য হার নারী-পুরুষ বৈষম্যের সূচকে বিশ্বে এক লজ্জাজনক স্থানে রাখিয়াছে ভারতকে। তাহার স্থান পূর্বের তুলনায় আরও নামিয়াছে। ইহা আশ্চর্য নহে। যে-দেশে রাজনৈতিক দলাশ্রিত কর্মীরা ‘অ্যান্টি-রোমিয়ো’ বাহিনী তৈরি করিয়া তাণ্ডব করে, মহিষের মাংস বিক্রির অপরাধে মহিলাদের প্রহার করে, ‘লাভ জিহাদ’-এর কল্পিত অপরাধের নামে মেয়েদের জীবনসঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে, সে দেশে মেয়েদের সক্ষমতা বাড়িবে? বাহিরে সক্ষমতার বাণী, ভিতরে বঞ্চনা ও বিদ্বেষের প্রহার, এই দ্বিচারিতা মেয়েদের বিপন্নতা বাড়াইতেছে। গোলাপি মলাট আশা জাগাইয়াছে, আশঙ্কা প্রশমিত করিতে পারে নাই।