প্রবন্ধ ২

অসহিষ্ণুতা চাপিয়ে দিলেও সমাজ মানবে না

সমাজবিদ্যা ও ধর্ম-দর্শনের মতো বিষয়ে পঠনপাঠন বাড়ানো দরকার, কিন্তু সেই চর্চা যেন বিচারবুদ্ধির প্রয়োগে সমৃদ্ধ হয়। শ্রাবণী বসু-র সঙ্গে কথোপকথনে জানালেন দিবাকর নাথ আচার্য। সদ্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্য ধর্ম ও নীতিশাস্ত্র বিষয়ে স্পলডিং অধ্যাপক পদে যোগ দিয়েছেন তিনি। সমাজবিদ্যা ও ধর্ম-দর্শনের মতো বিষয়ে পঠনপাঠন বাড়ানো দরকার, কিন্তু সেই চর্চা যেন বিচারবুদ্ধির প্রয়োগে সমৃদ্ধ হয়। শ্রাবণী বসু-র সঙ্গে কথোপকথনে জানালেন দিবাকর নাথ আচার্য। সদ্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্য ধর্ম ও নীতিশাস্ত্র বিষয়ে স্পলডিং অধ্যাপক পদে যোগ দিয়েছেন তিনি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৬ ০০:১৭
Share:

আপনার জন্ম নেপালে, পশুপতিনাথ মন্দিরের দেশে। প্রাচ্য ধর্ম কি আপনাকে বরাবরই আকর্ষণ করেছে? প্রাচ্য ধর্ম ও দর্শনের চর্চা কি সেই সূত্র ধরেই?

Advertisement

হ্যাঁ, শৈশব থেকেই প্রাচ্য ধর্মের প্রতি একটা আকর্ষণ ছিল, তবে সেটা শিশুর আকর্ষণ, তার বেশি কিছু নয়। আমার সতেরো বছর বয়স অবধি সে বাড়িতে আমরা থাকতাম, সেটি পশুপতিনাথ মন্দিরের প্রধান দ্বারের সংলগ্ন। আমার বাবা পুরনো ধারায় লেখাপড়া শিখেছেন, আমাকেও তিনি সেই ধারাতেই পড়িয়েছিলেন। সাত বছর বয়সেই আমার কিছু সংস্কৃত পাঠ্য কণ্ঠস্থ হয়ে গিয়েছিল। কিছু পৌরাণিক কথাও তত দিনে জানা হয়ে যায়, পশুপতিনাথ মন্দিরের সৃষ্টির কাহিনিও তার মধ্যে ছিল। মন্দিরের পুরোহিতদের অনেকে আমার মুখে সে সব শুনতে চাইতেন। আর শোনার পরে তাঁরা আমাকে মিষ্টি, ফল, এই সব দিতেন। ধর্মের সঙ্গে এ ভাবেই আমার প্রথম সংযোগ। বাবার ইচ্ছেয় আমি কাঠমান্ডুর একমাত্র সংস্কৃত উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সেখানে আধুনিক নানা বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃত ব্যাকরণ, তর্কবিদ্যা এবং সাহিত্য পড়ানো হত। বিশ্ববিদ্যালয়েও আমি সংস্কৃত এবং ভারতবিদ্যা বেছে নিই, এ বার অবশ্য নিজের সচেতন সিদ্ধান্তেই।

Advertisement

আপনি নেপালে প্রাচীন পুথি নিয়ে গবেষণা করেছেন। কী ধরনের গবেষণা? ভারতে ও নেপালে পুথির সংরক্ষণে যথেষ্ট যত্ন নেওয়া হয় কি?

ভারতীয় তথা বৌদ্ধ সংস্কৃতির কেন্দ্রগুলিতে বিপুলসংখ্যক প্রাচীন পুথি সংরক্ষিত আছে। ভারত এবং নেপাল ছাড়াও বাংলাদেশে (যেমন ঢাকায়), পাকিস্তানে (যেমন লাহৌরে), কিংবা তিব্বতে (যথা লাসায়) অনেক পুথি আছে। চিন ও জাপানের বৌদ্ধ মঠগুলিতেও আছে। প্রতিলিপি বাদ দিয়ে গুনলেও সব মিলিয়ে হাজার হাজার পুথি। নেপালে এনজিএমপিপি নামে জার্মান প্রকল্পে একত্রিশ বছর ধরে আঠারো হাজারের বেশি পুথি মাইক্রোফিল্ম করা হয়েছে, কিন্তু এখনও অনেক পুথি আছে যার মাইক্রোফিল্ম হয়নি। ভারতে ন্যাশনাল ম্যানুস্ক্রিপ্টস মিশন (এনওএমএএমআই বা নমামি) দেশের সমস্ত বড় লাইব্রেরি থেকে পুথির স্ক্যান করে বা ছবি তুলে রাখছে। আরও কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিরা পুথি সংরক্ষণে ব্রতী।

দক্ষিণ এশিয়ায় অনেকে মনে করেন, প্রাচীন পুথিতে রকেট, এরোপ্লেন বা অন্য রকমারি আধুনিক জিনিস তৈরির বিদ্যা নিহিত আছে, সে সব ‘গুপ্তধন’ দেশের বাইরে পাঠাতে তাঁদের ঘোর আপত্তি। আনন্দ-এর জেলাশাসক ধবল পটেল নিজে এক জন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত, অথচ নমামি প্রকল্পে যে সব পুথির ছবি তোলা হয়েছে তার তালিকাটুকু পাওয়ার জন্য তাঁকে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। এই মানসিকতা বদলানো দরকার। যোগ্য পণ্ডিত ও ছাত্ররা যাতে এ সব পুথি সহজেই দেখতে পারেন তার ব্যবস্থা জরুরি, অপ্রকাশিত পুথিপত্র প্রকাশের আয়োজনও জরুরি।

অন্য দিকে, হাজার হাজার পুথি দেখে সেগুলির তালিকা তৈরি এবং সম্পাদনা করার যোগ্যতা ও উৎসাহ মোটেই সুলভ নয়। পুরনো ধারার সংস্কৃত স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে ছাত্রছাত্রীরা বেরোন তাঁদের অধিকাংশই ধর্ম ও সংস্কৃতির চর্চা করে বা সেই চর্চায় অন্যদের সাহায্য করেই সন্তুষ্ট। এই কাজগুলির জন্য যেটুকু যা পড়ার দরকার হয়, তাঁরা কেবল সেটুকুই পড়েন। ব্যতিক্রম আছে, কিন্তু সেটা ব্যতিক্রমই। পুথিপত্রের গভীর এবং সম্যক অধ্যয়নের আগ্রহ বিরল।

আপনি জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, জাপানে পড়িয়েছেন। এ বার অক্সফোর্ড। প্রাচ্যের দর্শন এবং ধর্ম বিষয়ে বহির্বিশ্বে আগ্রহ কি বাড়ছে?

এ ব্যাপারটা একটু জটিল। সারা পৃথিবীতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ধ্রুপদী ভারতবিদ্যার চর্চায় ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা সীমিত। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনের ছাত্রসংখ্যাও কম। কিন্তু মানুষ এখন বুঝতে পারছেন যে, প্রাচ্য দর্শন ও ধর্মে একটা বিশ্বচেতনা রয়েছে, তারা জীবন বিষয়ে একটা সামগ্রিক নীতিবোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহাবস্থানের শিক্ষা দেয়। এই কারণেই প্রাচ্যের ধর্ম ও দর্শন বিষয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। জাপান এবং চিনের কথা এ প্রসঙ্গে বিশেষ করে বলতে হবে। এই দুই দেশের মানুষ বৌদ্ধ ধর্মের কোনও না কোনও ধারা অনুশীলন করে। এবং এই কারণেই ভারতীয় দর্শন ও ধর্মের প্রতি তাদের বিশেষ আগ্রহ।

সংস্কৃত ও প্রাচ্য দর্শনের সৃষ্টিসম্ভারকে সারা পৃথিবীর কাছে পরিচিত করে তোলার ক্ষেত্রে জার্মানি ও ব্রিটেনের প্রাচ্যবাদীদের কাছে আমরা কতটা ঋণী?

অনেকটাই! তাঁরা বহু পুথিকে পরিচিতির আলোয় এনেছেন, খুব যত্ন করে সেগুলির সম্পাদনা এবং অনুবাদ করেছেন। আর, ব্রিটিশরা যদি সংস্কৃত কলেজ এবং ওই ধরনের নানা প্রতিষ্ঠান তৈরি না করত (কেন করেছিল, সেটা অন্য বিষয়), হয়তো প্রথাগত গুরুকুলগুলি অল্প কিছু সহজলভ্য পুথির মধ্যেই আটকে থাকতেন, নতুন পুথি বা বিদ্যাচর্চার নতুন পদ্ধতি অনুসন্ধানের চেষ্টা হত না।

আপনার কি মনে হয়, প্রাচ্যের দর্শন ও ধর্ম নিয়ে চর্চার আগ্রহ দক্ষিণ এশিয়ার তুলনায় পাশ্চাত্যে অনেক বেশি?

প্রাচ্য হোক বা পাশ্চাত্য, পৃথিবীর সর্বত্রই দর্শন ও ধর্ম নিয়ে যথার্থ পাণ্ডিত্য অর্জনের উৎসাহ কম লোকেরই থাকে। বহু মানুষ গভীর ভাবে না ভেবেই রকমারি পুরাকথায় মজে যান, অথবা নানা বাঁধা গতের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সেগুলিকে দেখেন, যেমন জাতীয়তাবাদী, মার্ক্সবাদী, হিন্দু, মুসলমান, অধ্যাত্মবাদী, ইত্যাদি। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় অনেকেই বিদ্যাচর্চার সঙ্গে অন্য নানা ব্যক্তিগত প্রবণতা বা নিজেদের বিশ্বাসও মিশিয়ে ফেলেন। পাশ্চাত্যেও অনেক মানুষ আছেন যাঁরা পরোক্ষ উৎসের ওপর ভিত্তি করেই তাঁদের তত্ত্ব খাড়া করেন, প্রাথমিক উৎস পড়া বা বিচারবিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করেন না।

আপনার কি মনে হয় ধর্মের অন্তর্নিহিত দর্শনের চর্চা না হয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্মচর্চা কিছু রীতিনীতি, আচারবিচারে সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে?

খুবই। ইদানীং আবার আধুনিক যুগের রকমারি আচারে আটকা পড়েছে ধর্ম। নানান গুরু ও জ্যোতিষীর কাছে কিংবা ‘কথা’ শুনতে যাওয়া এবং সমাজে নিজের ধর্মীয় পরিচয় জাহির করার বহর বেড়েছে। তবে চিরাচরিত আচারগুলি অনেকটা জীবাশ্মের মতো— মন দিয়ে লক্ষ করলে তাদের মধ্যে সভ্যতার অনেক স্তরের হদিশ মিলবে। সুতরাং, সেগুলির সংরক্ষণ আবশ্যক, একই সঙ্গে সেগুলি বিচার করাও জরুরি। গবেষকের দৃষ্টিতে দেখলে বোঝা যাবে, এই সব আচার মানুষের মনের ফসল এবং তার সংস্কৃতির প্রকাশ। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অনেক মানুষ তা মনে করেন না, কারণ তাঁরা ওই সব আচারের অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করেন। যদি তাঁরা বুঝতে পারতেন যে এগুলির ক্ষমতা আসলে এদের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের ফল, অলৌকিক বা আধিভৌতিক কিছু নয়, তা হলে তাঁদের বিশ্বাস গবেষণাকের পথে বাধা সৃষ্টি করত না। বেদান্তও কিন্তু এই শিক্ষাই দেয় যে আচারগুলি চিত্তশুদ্ধির উপায়, আর কিছু নয়। তন্ত্রও বলে যে, এগুলি আত্মস্থ হওয়া এবং নিজেকে অতিক্রম করে যাওয়ার পথ।

আপনি তো তন্ত্রবিদ্যার ওপর অনেক গবেষণা ও লেখালিখি করেছেন। এই বিষয়ে আপনার আগ্রহ কী ভাবে তৈরি হয়েছিল?

আমার শিকড় কাঠমান্ডুতে। কাঠমান্ডুতে তন্ত্রের ঐতিহ্য প্রাচীন। তন্ত্রের প্রচুর প্রাচীন ও দুর্লভ পুথিও এখানে পাওয়া গিয়েছে। পরবর্তী কালে তন্ত্রের ঐহিক দর্শন আমাকে খুবই আকর্ষণ করেছে। তন্ত্র বন্ধন-মুক্তির শিক্ষা দেয়, আবার এ-ও বলে যে, বন্ধন আর মুক্তি, দুটোই আসলে মানসিক।

প্রাচীন শাস্ত্রের মধ্যে আপনার সবচেয়ে পছন্দের কোনটি?

এই মুহূর্তে শতপথব্রাহ্মণ, যার একটা অংশ হচ্ছে বৃহদারণ্যক উপনিষদ।

অক্সফোর্ডে আপনার সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা কী?

বুদ্ধিমান ছাত্র ও সহকর্মী। ভাল ছাত্ররাই এক জন ভাল শিক্ষক তৈরি করতে পারে। আমার বিভাগের এবং বিভাগের বাইরের সহকর্মীদের কাছ থেকেও অনেক নতুন কিছু শেখার আশা রাখি।

ধ্রুপদী বিদ্যার চর্চা কতটা জরুরি বলে আপনি মনে করেন? ভারতে স্কুলগুলিতে কি সংস্কৃত পড়ানো উচিত?

নিজের ও অন্যদের সমাজের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়া খুবই আবশ্যক। যুগে যুগে পৃথিবী জুড়ে কী ভাবে নানা সভ্যতার উন্মেষ ও বিবর্তন ঘটেছে, বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ জ্ঞানে ও প্রযুক্তিতে কী ভাবে উন্নত হয়েছে, সেই বিষয়ে ধারণা মানুষকে ঋদ্ধ করে। সেই কারণেই ধ্রুপদী গ্রন্থগুলির চর্চা দরকার, খুব মন দিয়ে ইতিহাস পড়া এবং তা থেকে শিক্ষা নেওয়া দরকার।

স্কুলে সংস্কৃত পড়ানো উপকারী হতে পারে। কিন্তু সেই পড়ানোর পিছনে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকলে হিতে বিপরীত হতে পারে। সম্প্রতি কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভারতে এবং প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে সংস্কৃতে কথা বলার অভ্যাস তৈরির জন্য উদ্যোগী হয়েছে। তার ফলে সংস্কৃতের পক্ষে একটা ভাল রকম সমর্থনও গড়ে উঠেছে। কিন্তু এ বিষয়ে একটু বাড়াবাড়ির আশঙ্কা আছে, এই সমর্থনকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের সম্ভাবনাও আছে। সে বিষয়ে সচেতন থেকে কথা বলায় সংস্কৃতের প্রচলন বাড়ালে একটা সহজ কথ্য সংস্কৃত ভাষা তৈরি হতেই পারে, যেমনটা হিব্রুর ক্ষেত্রে হয়েছে। তবে সে জন্য অন্তত কয়েক দশক নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করা দরকার। এই বিষয়ে যাঁরা উদ্যোগী হবেন, তাঁদের সংস্কৃত ভাষায় জ্ঞানতত্ত্বের গভীর বিচারেও মন দিতে হবে। কেবল স্কুলে বা আইআইটি’তে সংস্কৃত পড়ালেই চলবে না, যদিও এটা ঠিকই যে, তাতে সংস্কৃতের ছাত্রছাত্রীদের চাকরির সুযোগ বাড়বে, সেটা খুবই ভাল কথা।

ব্রিটেনে দেখি, ধ্রুপদী গ্রিক নাটকের নিয়মিত অভিনয় হয়। ভারতে ধ্রুপদী সংস্কৃত নাটকের অভিনয় খুবই কম। এ বিষয়ে কি অনুরূপ ভাবে উৎসাহ দেওয়া উচিত?

জাপানেও বিভিন্ন শৈলীর প্রাচীন নাটক নিয়মিত অভিনীত হয়। সে দেশে সরকার এই ধরনের শিল্প ও তার সংশ্লিষ্ট পারঙ্গমতাকে চলমান জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই সব শিল্প ও তার শাস্ত্র শেখানোর জন্য প্রতিষ্ঠান আছে। শিল্পীদের বৃত্তি বা অনুদান দেওয়া হয়, যাতে তাঁরা শিল্প ও জ্ঞানের চর্চা চালিয়ে যেতে পারেন। ভারতেও এমন উদ্যোগ সম্ভব।

ভারতে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, হিন্দু ‘মৌলবাদ’ উত্তরোত্তর মাথা চাড়া দিচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার কী অভিমত?

সাধারণ ভারতবাসী অসহিষ্ণু নন, কিন্তু সচরাচর সরলমনা। কখনও কখনও রাজনীতিকরা তাঁদের সারল্যের সুযোগ নিয়ে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে তাঁদের উত্তেজিত করেন। তবে সমাজে অসহিষ্ণুতার ভিত নেই, তাই ওই উত্তেজনা অচিরেই মিলিয়ে যায়।

আবার, কিছু অর্ধশিক্ষিত ‘পণ্ডিত’ আছেন— মার্ক্সবাদী বা জাতীয়তাবাদী, রক্ষণশীল বা উদারপন্থী, বা অন্য নানা মতবাদের ধ্বজাধারী— যাঁরা ভারতীয় সংস্কৃতির একটা বিকৃত রূপ মানুষের সামনে তুলে ধরেন। তাঁরা একটা গোঁড়া মতবাদের কাঠামোয় সমাজকে বুঝতে শিখেছেন, তাকে ভাল করে চেনার চেষ্টা করেননি। নিজেদের খণ্ডিত এবং ভ্রান্ত ধারণাই তাঁরা সমাজের ওপর আরোপ করতে চান। এটা আর একটু বড় সমস্যা। চাই একটা সচল চিন্তার ধারা। ভারতীয় সমাজে সব কিছু ঠিকঠাক, এমন কথা আমি বলছি না, কিন্তু গোঁড়া মতবাদের ভিত্তিতে সমাধান খুঁজলে কাজ হবে না, ক্ষতিও হতে পারে। আমার মনে হয়, সমাজবিদ্যা ও ধর্ম-দর্শনের মতো বিষয়ে পঠনপাঠন বাড়ানো দরকার, যে চর্চা বিচারবুদ্ধির প্রয়োগে সমৃদ্ধ। তা হলে ক্রমশই আরও বেশি মানুষ ভারতে আধুনিকতার জটিল চরিত্র বিশ্লেষণ এবং অনুধাবন করতে পারবেন। এর ফলে সমস্ত ধর্মের সম্পর্কে বিচার-বিশ্লেষণভিত্তিক বোধ গভীর হবে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাও বাড়বে।

শুরু হয়েছিল রাধাকৃষ্ণনকে দিয়ে

পঞ্চাশ বছর বয়স হতে এখনও চার বছর বাকি, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্য ধর্ম ও নীতিশাস্ত্র বিষয়ে স্পলডিং অধ্যাপক হলেন দিবাকর নাথ আচার্য। এই পদের সূত্রে অল সোলস কলেজ-এর ফেলোও নিযুক্ত হলেন তিনি। স্পলডিং অধ্যাপক পদটি তৈরি হয় ১৯৩৬ সালে প্রথম এই পদে আসীন হন সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন (১৯৩৬-৫২)। অকালপ্রয়াত ভারতীয় দার্শনিক বিমলকৃষ্ণ মতিলালও এই পদে ছিলেন (১৯৭৬-১৯৯১)। তার পরে আসেন অ্যালেক্সিস স্যান্ডারসন(১৯৯২-২০১৬)। তিনি অবসর গ্রহণ করেছেন, তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন দিবাকর নাথ আচার্য। গত দশ বছর তিনি জাপানে কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। ইউরোপের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ এই সুপণ্ডিত মানুষটির প্রধান চর্চার বিষয় প্রাচ্যের ধর্ম, দর্শন ও নীতিশাস্ত্র। সংস্কৃত ব্যাকরণে তাঁর বিশেষ ব্যুৎপত্তি। সংস্কৃত ভাষার গভীরে ঢুকতে চেয়েছেন ছোট থেকেই। ভাষানুরাগ থেকে ক্রমে গভীর অধ্যয়ন এবং অনুশীলন। নেপালে মহেন্দ্র সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরের পড়াশোনার পরে বারাণসীর সম্পূর্ণানন্দ সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পিএইচ ডি করেছেন জার্মানির হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সংস্কৃত চর্চার প্রসারে তাঁর বিশেষ উৎসাহ। ক্লে স্যান্‌স্কৃট লাইব্রেরি থেকে ইংরেজিতে তাঁর অনূদিত ‘মৃচ্ছকটিকম্’ প্রকাশিত হয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement