দর্শনা বণিকের কিকি চ্যালেঞ্জ। ইউটিউব ভিডিয়োর স্ক্রিন শট।
মুম্বইয়ের এক আদালত তিন জনকে সাজা দিয়াছে— আগামী তিন দিন প্রত্যহ এক বেলা একটি রেল স্টেশন সাফ করিতে হইবে, আর অন্য বেলায় সচেতনতা প্রসার করিতে হইবে। তাঁহারা যে অপরাধ করিয়াছেন, অন্যরা যেন তাহা না করেন, কারণ কাজটি বেআইনি এবং বিপজ্জনক, এই কথাটি জনসমক্ষে জানাইতে হইবে। এই তিন যুবকের ‘অপরাধ’টির কথা দুই বা তিন সপ্তাহ পূর্বে শুনিলেও বিচিত্র ঠেকিত। এখন গোটা দুনিয়া জুড়িয়া অজস্র তরুণ-তরুণী অপরাধটি করিতেছে, এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় তাহার ভিডিয়ো আপলোড করিতেছে। অবশ্য, দুনিয়াব্যাপী প্রসারে কাজটির বিচিত্রতা এবং অযৌক্তিকতা তিলমাত্র কমে নাই। অপরাধটির নাম ‘কিকি চ্যালেঞ্জ’। চলন্ত গাড়ি হইতে নামিয়া একটি অর্থহীন বালখিল্য গানের তালে তালে নাচিয়া তাহার ভিডিয়ো তোলার নামই কিকি চ্যালেঞ্জ। ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জ, আইস বাকেট চ্যালেঞ্জ, পোকেমন গো ইত্যাদি উদ্ভট অর্থহীনতাকে পার করিয়া ইহাই এখন অনলাইন দুনিয়ার চাঞ্চল্যের নবতম উৎস। কাজটিকে বাঁদরামি বলা যাইত, কিন্তু শাখামৃগকুলের সঙ্গত আপত্তির কথা মাথায় রাখিয়া তাহা না বলাই ভাল, কারণ আজ অবধি কোনও বাঁদর এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ করিয়াছে বলিয়া শোনা যায় নাই। নিজের এবং আরও পাঁচ জনের জীবনের ঝুঁকি তৈরি করিয়া চলন্ত গাড়ি হইতে নামিয়া রাস্তায় নৃত্য করিবার মধ্যে চ্যালেঞ্জটি কী, আর তাহার মাহাত্ম্যই বা কী, বাঁদরে বুঝিবে না। প্রাণিজগতের বিবর্তন যে সর্ব ক্ষেত্রেই ইতিবাচক হইয়াছে, কিকি চ্যালেঞ্জ আদি কীর্তির দৌলতে তেমন দাবি করিবার আর উপায় থাকিল না।
কয়েক মাস অন্তর এমন অবান্তর ও বুদ্ধিহীন কিছু চ্যালেঞ্জ এই পরিমাণ জনপ্রিয় হইয়া উঠে কেন? সোশ্যাল মিডিয়ার বিস্তারের সহিত এই গোত্রের অবিমৃশ্যকারিতার কালানুক্রমিক যোগ এমনই স্পষ্ট যে উত্তরটি এই পরিসরেই মিলিবে। সোশ্যাল মিডিয়ার বিস্তারের পূর্বে মানুষের মধ্যে দুইটি পরিষ্কার ভাগ ছিল— এক দিকে ছিলেন ‘সেলেব্রিটি’রা, যাঁহারা কোনও কারণে বিশিষ্ট, এবং সেই বিশিষ্টতার দৌলতেই জনপরিসরে পরিচিত; আর অন্য দিকে ছিলেন সাধারণ মানুষ। যাঁহাদের পরিচিতি সীমাবদ্ধ ছিল নিতান্ত স্বাভাবিক ছোট গোষ্ঠীর মধ্যে। এবং, কেন আরও বেশি লোক আমাকে চিনিল না, এই মর্মে সাধারণ মানুষের মধ্যে সাধারণত কোনও ক্ষোভ থাকিত না, উচ্চাকাঙ্ক্ষাও নহে। সোশ্যাল মিডিয়া আসিয়া এই স্থিতাবস্থাটিকে ঘাঁটিয়া দিয়াছে।
এখন পাড়ায় পাড়ায় যে কেহ যখন খুশি খ্যাতিমান হইয়া উঠিতে পারে। যথার্থ খ্যাতিমানদের ন্যায় খ্যাতি নহে, কিন্তু যে পরিচিতি পূর্বে সাধারণ মানুষের আয়ত্তাতীত ছিল, সেই খ্যাতি অর্জন করা এখন অতি সম্ভব। ফলে, পরিচিত হইয়া উঠিবার, খ্যাতি কুড়াইবার নেশা লাগিয়াছে অনেকের মনে। কেহ বৈকালের সহিত নৈপালের মিল দিয়া কবিতা লিখেন; কেহ রেস্তরাঁয় খাইতে গেলে ছবি তুলিয়াই সময় কাটাইয়া দেন; কেহ পাঁচ মিনিট মিছিলে হাঁটিয়া পাঁচশত বাহাত্তরটি হ্যাশট্যাগ জোড়েন; কেহ কচ্ছপে চড়িয়া টালা হইতে টালিগঞ্জ রওনা দেন। কিকি চ্যালেঞ্জের ন্যায় বোধহীনতায় ঝাঁপাইয়া পড়াও এই খ্যাতি কুড়াইবারই কৌশল। স্বল্পবুদ্ধির দৌড় এই অবধিই। তবে, স্টেশন ঝাঁট দেওয়ার খ্যাতি শুধু এই তিন জনের নহে, আরও বিবিধ কপালে জুটিলে মন্দ হয় না।