সম্পাদকীয় ২

কোঁচার কেত্তন

সম্প্রতি রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলিলেন, রাজ্যের সকল স্কুল ও কলেজ আগামী তিন মাসের মধ্যে রং করিয়া ফেলিতে হইবে। এই খরচ রাজ্য সরকারই দিবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৭ ০০:১২
Share:

ইদানীং অনেকে অকস্মাৎ প্রতিজ্ঞা করেন, জীবন বদলাইয়া ফেলিব, এবং ছুটিয়া গিয়া জিম-এ ভর্তি হইয়া মেদ ঝরাইবার কসরত শুরু করেন। জীবন বদলাইতে গেলে যে মনোভঙ্গি বদলাইতে হইবে, চুলের টেরি ফিরাইয়া স্বভাবের পরিবর্তন ঘটানো যাইবে না, সে কথাটি আপন মনকে চক্ষু ঠারিয়া তাঁহারা ভুলিয়া থাকেন। কিন্তু বাহ্যিক আবরণের ভোল বদলাইয়া সন্তুষ্ট হইবার অভ্যাস বহু দূর বিস্তৃত। কলিকাতা পূর্বের তুলনায় অধিক শ্রীমণ্ডিত হইয়াছে নিঃসন্দেহে, কিন্তু সেই পরিবর্তনও মূলত রঙের পোঁচ বুলাইবার প্রয়াসে সীমাবদ্ধ। এই শহর সেতুগুলি রং করিবার জন্য আকুল কিন্তু তাহাদের যথেষ্ট পাকাপোক্ত করিবার বেলায় নিশ্চেষ্ট। সম্প্রতি রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলিলেন, রাজ্যের সকল স্কুল ও কলেজ আগামী তিন মাসের মধ্যে রং করিয়া ফেলিতে হইবে। এই খরচ রাজ্য সরকারই দিবে। হতশ্রী শিক্ষায়তনগুলিকে রং করিলেই ভালই হইবে, এমনকী নীল-সাদা করিলেও, কিন্তু তাহাতে এই রাজ্যে শিক্ষার বিবর্ণ অবস্থায় জৌলুস যোগ হইবে কি? এখানে বহু ছাত্রছাত্রী শিক্ষকদের ঘেরাও করেন, ফেল করা সত্ত্বেও তাঁহাদের পাশ করাইয়া দিতে হইবে, এমন উদ্ভট দাবিতে। বহু শিক্ষক ছাত্রছাত্রীর আন্দোলন ঢিট করিতে দ্রুত পুলিশ ডাকিয়া আনেন। শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে বহু ক্ষেত্রেই বৈরিতা, সন্দেহ, অসম্মানের আবহ। সরকারের তরফ হইতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে মাদকাসক্তির অভিযোগও ধাইয়া যায়। সেই পরিস্থিতিকে চুনকাম করিবার পরিকল্পনা মহৎ, কিন্তু দেওয়ালের কলি ফিরাইলে ঘোর কলিতে অন্তঃসত্তা বদলাইবে, এমন দুরাশা বুদ্ধির সূচক নহে।

Advertisement

রং করিলে দগদগে গ্লানি ঘুচিবে না, মন্ত্রীও জানেন। তিনি বলিয়াছেন, রং করিবার পরেও যদি কলেজের দেওয়ালে পোস্টার চোখে পড়ে, তাহা ঠিক হইবে না। আড্ডা মারিবার স্থানে গাছ লাগাইয়া আড্ডা নিরস্ত করিবার কথাও বলিয়াছেন। বেচারা ছাত্রছাত্রীদের আড্ডার উপর তাঁহার রোষদৃষ্টি পড়িল কেন, কে জানে। হয়তো ভাবিয়াছেন, আড্ডা হইতে দল পাকায় ও দল হইতে রাজনীতি জন্মে। কলেজে রাজনীতি ঘুচাইবার পরিকল্পনার কথা কিছু দিন ধরিয়াই রাজ্য সরকার উচ্চারণ করিতেছে, কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের রাজনীতি বিষয়ে সচেতন হইবার অধিকার বিলক্ষণ রহিয়াছে, এবং তাহা প্রয়োগ করিবার স্থান হিসাবে কলেজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই রাজনীতি কলুষিত হয়, যখন রাজনৈতিক দলগুলি ছাত্র সংগঠনগুলিকে কবজা করিয়া কলেজে অধিকার কায়েম করিতে চাহে। সেই দোষ হইতে নিজ দলকে মুক্ত করিবার প্রয়াস শিক্ষামন্ত্রীর মধ্যে দেখা যায় নাই। বহু ঘটনায় দেখা গিয়াছে, তৃণমূলের ছাত্র সংসদগুলি কলেজে অবাঞ্ছিত, হিংসাত্মক কার্যের সহিত জড়িত। ছাত্র ভর্তি হইবার সময় এই সংগঠনগুলির দৌরাত্ম্য প্রবল বর্ধিত হয়। কেন্দ্রীয় একটি অনলাইন বন্দোবস্ত করিলে, ছাত্র-ভর্তির প্রক্রিয়াটিকে দুর্নীতিমুক্ত করা যায়। পার্থবাবু বিকাশ ভবনে অধিষ্ঠিত হইয়াছেন অনেক দিন হইয়া গেল, কিন্তু সেই ব্যবস্থা হয় নাই। কেবল কয়েকটি কলেজে অভ্যন্তরীণ অনলাইন ভর্তি ব্যবস্থা হইয়াছে, কিন্তু তাহাতে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপপ্রয়োগের সম্ভাবনা বিশেষ হ্রাস পায় না। ভিতরের ছুঁচোর কেত্তনকে পাত্তা না দিয়া, বাহিরের কোঁচার পত্তন লইয়া আড়ম্বর করিলে, তাহা শেষে কোঁচার কেত্তন হইয়া দাঁড়াইবে না তো!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন