চলছে চলবে। বিধানসভার বাইরে প্রতিবাদী বাম নেতারা। কলকাতা, জুন ২০১৬। ছবি: সুদীপ আচার্য
একদা বামপন্থীদের দুর্জয় ঘাঁটি নামে অভিহিত পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্ক্সবাদী) বা সিপিআইএম থেকে দীর্ঘমেয়াদি ভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এই মুখ-ফেরানো কেরলের মতো স্বল্পমেয়াদি নয় যে স্প্রিং-লাগানো পুতুলের মাথার মতো তা এক বার বাঁ দিকে পরের বার ডান দিকে ঘুরবে। সেই যে ২০০৮ সালে সিপিআইএম পরিচালিত বামফ্রন্ট পুর ও পঞ্চায়েত ভোটে পিছিয়ে যেতে শুরু করল, সেই অধোগতি অব্যাহত।
এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে সিপিআইএমের কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলাবার অনেকটাই কারণ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জেদ এবং দলের অন্যান্য নেতাদের (অবশ্য প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু ব্যতিক্রমী) মানুষের ভাষা বোঝার অক্ষমতা। বুদ্ধদেববাবুর যেন তেন প্রকারেণ ক্ষমতা পুনরধিকারের আগ্রহটি অবশ্য স্বাভাবিক। হৃতগৌরব ফিরে পেতে কারই বা সাধ না হয়!
তবে দল অবশ্যই বুঝতে পেরেছিল যে তার পায়ের তলায় জমি আছে সামান্যই, সুতরাং কংগ্রেসের মতো একটি ক্রাচ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কিন্তু ঠিক কতটা জমি সরেছে তা মধ্য কলকাতার মুজফ্ফর আহমেদ ভবনের পার্টি আমলারা মোটেই বোঝেননি। নির্বাচনী ফলের দিকে তাকালেই ব্যাপারটি পরিষ্কার হবে। কংগ্রেসের ডেরা উত্তরবঙ্গে, বিশেষ করে মালদহ জেলায়। যে সব অঞ্চলে কিছুই পায়নি সিপিএম। অথচ বিধানসভার দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসনবিশিষ্ট দক্ষিণবঙ্গে, যেখানে ৩৪ বছর পার্টির অঙ্গুলিহেলনই ছিল আইন, সেখানে ইতিউতি কিছু আসন ব্যতীত কোথাও তৃণমূল ঝড়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলতে পারেনি তারা। শহরাঞ্চলে কিছু প্রাক্-নির্বাচনী জনসভায় শ্রোতার ভিড় দেখে বুদ্ধদেববাবুরা আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন। বহু দিন পরে কিছু জনসমাগম দেখলে তাতে পুলকিত হওয়া বিচিত্র নয়। কিন্তু শহরাঞ্চলে ভোটের ফল বামফ্রন্টের পক্ষে করুণ: কলকাতা-০, হাওড়া-০, হুগলি-১।
এই রাজ্যে সিপিএম কেন পপাত ধরণীতলে সেই আশু প্রশ্নটিকে পিছনে ঠেলে দলের কর্তারা এখন ‘কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক’-এর প্রশ্নটি নিয়েই তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। মল্লযুদ্ধটি এক অর্থে দলের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট (যিনি সাবেকি আমল থেকে কংগ্রেসকেই মূল খলনায়ক ভাবতে অভ্যস্ত) বনাম বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফল, শেষোক্ত নেতাটির রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশ বা তেলঙ্গানায় বহু কাল যাবৎ সংসদীয় বামপন্থীরা প্রাগৈতিহাসিক জীবে পরিণত হওয়ায় তিনি এখন দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে বঙ্গের কমরেডদের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল। তবে ভারতীয় বামপন্থীরা আগাগোড়াই কংগ্রেস সম্পর্কে ঈর্ষান্বিত, কারণ ব্রিটিশ শাসনের অবসানে গাঁধী-নেহরু পরিচালিত কংগ্রেসের হাতে শাসনভার অর্পিত হতেই তাঁরা নিজেদের প্রবঞ্চিত মনে করে ফেলেন। এটি তাঁরা ভুলে যান যে বিশ্ব মহাযুদ্ধের সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ নিয়ে ব্রিটিশ-সোভিয়েত জোটের স্বার্থে তাঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামের কম বিরোধিতা করেননি। স্বাধীনতার পরেই আবার গাইতে শুরু করলেন, ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়। তেলঙ্গানায় কিছু দিন গেরিলা আন্দোলন চালালেন। সব নিষ্ফল। কমিউনিস্টরা সংসদীয় পথ বরণ করলেন।
তবে ১৯৬৪ সালে পার্টি বিভক্ত হওয়ার সময়েও কংগ্রেসের সঙ্গে সহযোগিতা অসহযোগিতার প্রশ্ন এক বড় ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। সেই দ্বিমতের ধাক্কাতেই ১৯৯৬ সালে জ্যোতি বসু কংগ্রেস-সমর্থন নিয়ে প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ করবেন কি না সেই প্রশ্নে দলে ভোট হয়ে গেল। বিজয়ী ‘না’ পক্ষের নেতা ছিলেন কারাট। ২০০৪ সালে সিপিএম ও তার চেলাচামুণ্ডারা প্রথম ইউপিএ সরকারকে সমর্থন করলেও সরকারে যোগদান করল না। ২০০৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের পরমাণু চুক্তির প্রতিবাদে তারা ইউপিএ থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিল। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে ফাঁকতালে জোট করা নিয়ে এখন সিপিএম-এর মধ্যে যে কাজিয়া চলছে, তা ওই প্রাচীন সিরিয়ালটিরই সাম্প্রতিকতম এপিসোড।
সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আরও গুরুতর ঘটনাটি হল ভারত থেকে মার্ক্স-লেনিনপন্থী বামপন্থার অপসরণ। সশস্ত্র বামপন্থীরা অবশ্য এখনও লড়াইরত পূর্ব ও মধ্য ভারতের বিভিন্ন অরণ্যাঞ্চলে, যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এই সংঘর্ষের মূলে রয়েছে ওই সব অঞ্চলের খনিজ সম্পদের দখলদারি নিয়ে বাঁটোয়ারা। কিন্তু সংসদীয় বামপন্থীরা কোথায় গেলেন? এর উত্তর দলের নেতাদের জানা নেই।
ভাবলেই বোঝা যায়, ১৯৯১ সালের আর্থিক সংস্কারের ফলে রাষ্ট্রের রাশ আলগা হওয়ার দশ-পনেরো বছর পরেই ভারতে বামপন্থা বিদায়ের পথে হাঁটতে শুরু করেছে। সিপিএম-এর মনে ২০০০ থেকে এই চিন্তার উদয় হয়েছিল যে, কৃষির ‘বেস’-এর উপর শিল্পের ‘সুপারস্ট্রাকচার’ চাপিয়ে দিলেই কেল্লা ফতে হবে। ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’ আউড়ে তাকে অভ্রান্ত সত্য বলে বিশ্বাস করার প্রবণতা— দার্শনিক কার্ল পপার প্রবণতাটিকে বলতেন ‘এসেনশিয়ালিজম’— কাল হল বাংলার বামফ্রন্টের। তাঁরা বুঝলেন না যে, কৃষি-অর্থনীতি পালটে গেছে বিশ্ব জুড়ে। এবং তাঁদের বর্গা আইন নামক কৌশলে আর চিঁড়ে ভিজছে না। বর্গার সুবাদে একটি রুমাল-সদৃশ জমি আঁকড়ে চিরকাল দু’মুঠো চালের জন্য গ্রামজীবনে বন্দি হয়ে থাকতে চাইছে না গ্রামবাসীরা। বিশেষ করে তাদের নতুন প্রজন্ম অস্থির হয়ে উঠছে। গ্রামের ঘরে যত পৌঁছচ্ছে স্যাটেলাইট টিভি, যত হাতে হাতে ঘুরছে মোবাইল ফোন, ততই হাতছানি দিচ্ছে নগরজীবন। হোক না কলকাতায় কোনও খালপাড়ের অপরিচ্ছন্ন বস্তি। হ্যাঁ, অটোচালক বা দৈনিক ঠিকা কাজের জীবনের গ্লানি তো আছেই। কিন্তু তবুও আছে খোকার ইস্কুল, সুইচ টিপলেই আলো, রাস্তার কলে জল। এবং ‘বাবু’দের মতো বাঁচবার এক বিরাট দাঁতে দাঁত চাপা প্রতিজ্ঞা।
কিন্তু কৃষির নড়বড়ে ভিত্তিটিকে মেরামতের কোনও চেষ্টাই না করে বুদ্ধদেববাবুরা ভাবলেন শিল্প-বিনিয়োগ দিয়ে সব ম্যানেজ করে দেবেন। সেই কারণেই সিঙ্গুরে টাটার অবতরণ। বুদ্ধদেববাবু ভাবলেন, এর ফলে চাকরি তৈরি হবে। মনে হয় না, তিনি কখনও কোনও গাড়িনির্মাণ কারখানার অভ্যন্তর স্বচক্ষে দেখেছেন। গুড়গাঁওয়ের মারুতি কারখানার ওয়ার্কশপে এক বার গেলেই দেখতেন, এক সুবিশাল হলের দেওয়াল জুড়ে দোলায়মান রেল। তার ওপর যেন হাওয়ায় ভেসে চলছে এক রংবিহীন গাড়ি। সেটি কয়েক মিনিটের জন্য আত্মগোপন করছে এক ঘেরাটোপের মধ্যে— যা আসলে রঙের কারখানা। তার পর সেখান থেকে বেরিয়ে আবার হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে একটি ঝকঝকে নীল মারুতি সুইফ্ট। কোথাও কোনও শ্রমিকের অস্তিত্ব নেই। সিঙ্গুরের টাটা কোম্পানিতে বর্গা চাষির সন্তান চাকরি করবে? দিবাস্বপ্ন।
আর একটি বিষয়ও লক্ষ করতে ব্যর্থ হয়ে গণ্ডগোল আরও বাড়িয়ে ফেললেন বুদ্ধদেব ও তাঁর উপদেষ্টারা। ২০০০-এর পর থেকেই নানা কারণে গ্রামে ও শহরতলিতে জমির দাম বাড়তে শুরু করেছিল। ফলে শিল্পায়নের নামে ব্রিটিশ যুগের জমি অধিগ্রহণ আইন অনুযায়ী জমির মালিককে ক্ষতিপূরণ ও ‘সন্তুষ্টিকরণ’ (সোলেশিয়াম) বাবদ কিছু টাকা গছিয়ে দিলে কখনওই সে জমি দিতে রাজি হবে না। তা করতে গিয়ে বুদ্ধদেববাবু তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে সহজতম ক্যাচ দিলেন। তারই হাত ধরে ‘বেণীর সঙ্গে মাথা’। রাজ্যশাসনের অধিকার।
এ ধরনের গোলমালের বৃহত্তর কারণটি কী? উত্তরটি সোজা। গত শতকের (ও সহস্রাব্দের) লেনিন, স্তালিন প্রমুখ রুশ নেতারা মার্ক্সবাদের ওপর যে সব পদ্ধতিগত কলকব্জা চাপিয়েছিলেন, তার একটি হল ডেমোক্র্যাটিক সেন্ট্রালিজম। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা। শাখা কমিটি থেকে কেন্দ্রীয় কমিটি পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে নীতি নির্ধারণ করবে সংখ্যাগুরু অংশ। সে নীতি সংখ্যালঘু অংশকে মেনে নিতেই হবে, আপত্তি থাকলেও। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এটিকে বলা হয় সংখ্যাগুরুবাদ বা ‘মেজরিটারিয়ানিজম’। লেনিন ১৯০৩ সালে রাশিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে অল্প ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন। তাতেই বাজিমাত। রুশ ভাষায় বলশেভিক কথাটির অর্থ সংখ্যাগুরু, মেনশেভিক— সংখ্যালঘু।
প্রকৃত অর্থে সর্বত্রই কমিউনিস্ট পার্টিতে নিচু তলার নির্বাচন পরিচালনা করে একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী। সেই গোষ্ঠীই নির্ধারণ করে কে হবে কোন কমিটির সদস্যপদে প্রার্থী, কী ভাবে তাকে জেতানো হবে। সিপিএম (ও অন্যান্য স্তালিনপন্থী দল) সম্পর্কে একটি বহুশ্রুত মন্তব্য হল, সেখানে ‘সেন্ট্রালিজম’ আছে, কিন্তু ‘ডেমোক্র্যাসি’ নেই। তার বিপদ হল, নীচের তলার নেতারা যদি কর্তাভজা হন, তবে তাঁরা কর্তাদের মন যাতে ভেজে সে রকমই রিপোর্ট পাঠাবেন। এটি অবশ্যম্ভাবী যে, সিপিএম-এর কৃষক কমিটি বা হুগলি জেলা কমিটি সিঙ্গুরে টাটাদের জন্য জমি অধিগ্রহণ করলে তার পরিণতি কী হতে পারে, সে কথা দলের নেতাদের কাছে খোলসা করে বলেননি। বরং যা করেছেন, তা কর্তার ইচ্ছায় কর্ম।
অবশ্য এই প্রবণতা তো সব দলেই। কিন্তু কমিউনিস্টরা আবার জাতিবর্ণ বা ধর্ম মানেন না, তাঁরা বিশ্বাস করেন শ্রেণিবিভাজনে। ফলে দলের নেতৃত্বে দলিত, নিম্নবর্গীয়, মধ্যবর্গীয় ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব তেমন চোখে পড়বে না। একে কর্তাভজা দল, তায় মানুষ চিনতে সম্বল শুধু ‘শ্রেণিচরিত্র’। অথচ ভারতে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার প্রভৃতি উচ্চশিক্ষিত পেশাতেও জাতিবৈষম্য ব্যাপক। কমিউনিস্টরা তার তল পান না।
তার ওপর আছে উদ্ভট সব বিশ্বাস। যথা, শ্রমিকশ্রেণির আপেক্ষিক আয় নাকি ক্রমশই কমতে থাকবে। কিন্তু ইতিহাস তো তা বলে না। বেতনবৃদ্ধি, বোনাস, পেনশন, সামাজিক সুরক্ষা, প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ‘শ্রমিক’ শব্দটির অর্থ পরিবর্তন, ইকুয়িটির অংশীদারি, স্টার্ট-আপ, আবিষ্কর্তা-কর্মীর পেটেন্টের অধিকার। মার্ক্সের দ্বিমাত্রিক জগৎ এখন দুমড়েমুচড়ে একাকার। মার্ক্সের অর্থনীতি যে অসার, তা সর্বকালের নমস্য অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনস বুঝেছিলেন: ‘ডাস কাপিটাল ইজ অ্যান অবসোলিট টেক্সটবুক হুইচ আই নো টু বি নট ওনলি সায়েন্টিফিকালি এরোনিয়াস বাট উইদাউট ইন্টরেস্ট অর অ্যাপ্লিকেশন ফর দ্য মডার্ন ওয়ার্ল্ড’।
প্রযুক্তি, আবহাওয়া, জনবিন্যাস— এই তিন ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তনের দরুন ভারতের যে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে মার্ক্সবাদের জন্ম হয়েছিল তা এখন অনুপস্থিত। ধনতন্ত্রের যে অবধারিত বিনাশের কথা মার্ক্স শুনিয়েছিলেন তা এখনও সত্য প্রমাণিত হয়নি। তার বদলে এসেছে ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে ধনতন্ত্রের অপ্রত্যাশিত বিবর্তন। চৌত্রিশ বছর একটি অনগ্রসর রাজ্যে অব্যাহত ক্ষমতাভোগের পর সিপিএমের পক্বকেশ নেতারা সে-সব ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করেন বলে মনে হয় না। কেনই বা তাঁরা মার্ক্সবাদের অভ্রান্ততা নিয়ে সন্দিহান হবেন? ‘ইহা বিজ্ঞান।’ তাই না?