পার্কের বেঞ্চে আড্ডা দেওয়া সেই বৃদ্ধেরা এখন সংখ্যালঘু

একটা সময় ছিল যখন সকালে ও বিকেলে পার্কে বা কোনও শিশু উদ্যানে হামেশাই দেখা মিলত বৃদ্ধবৃদ্ধাদের। তাঁদের সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের ছিল অম্লমধুর সহাবস্থান। লিখছেন হৃষিকেশ বসাকএকটা সময় ছিল যখন সকালে ও বিকেলে পার্কে বা কোনও শিশু উদ্যানে হামেশাই দেখা মিলত বৃদ্ধবৃদ্ধাদের। তাঁদের সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের ছিল অম্লমধুর সহাবস্থান। লিখছেন হৃষিকেশ বসাক

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৮ ০১:৩৩
Share:

বিরল হচ্ছে এমন দৃশ্য। ফাইল ছবি

১৯৭৪ সালের একটি সাড়া জাগানো সিনেমা ছিল অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত ‘মৌচাক’। সেই সিনেমায় দুই বৃদ্ধের পার্কে বসে আড্ডা মারার একটি দৃশ্য ছিল। সেখানে দেখা যায় যে তাঁদের আড্ডা মারার সময় দু’জন যুবক-যুবতী (রঞ্জিৎ মল্লিক এবং মিঠু মুখোপাধ্যায়) ‘বাঘ’ ও ‘হরিণের’ মুখোশ পরে তাঁদের সমানে দিয়ে চলে যাচ্ছে। তা দেখে এক বৃদ্ধ ‘দিনকাল যা পড়েছে’ গোত্রের টিপ্পনিও কাটেন।

Advertisement

একটা সময় ছিল যখন সকালে এবং বিকেলে পার্কে বা কোনও শিশু উদ্যানে হামেশাই দেখা মিলত বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের। তাঁদের সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের ছিল অম্লমধুর সহাবস্থান। বহু কালজয়ী সিনেমাতেও পার্কে বসে বৃদ্ধদের আড্ডা দেওয়ার দৃশ্যের অবতারণা করা হত হয়তো বা বয়স্ক দর্শকদের একটু ছুঁয়ে যাওয়ার তাগিদেই। আগে পার্কে বা কোনও শিশু উদ্যানে বসে থাকা বৃদ্ধের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া পরিচিত যুবকের কুশল বিনিময়ের দৃশ্যটি দুর্লভ ছিল না মোটেও। এখন ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যাবে যে অধিকাংশ পার্কে প্রবীণ এবং নবীনদের বসার জায়গা আলাদা। কোথাও যেন একটা অদৃশ্য দেওয়াল তৈরি হয়ে গিয়েছে দুই প্রজন্মের মধ্যে।

দুর্গাপুরের কাছে ‘কুমার মঙ্গলম’ নামে একটি পার্ক ছিল। সকাল ও সন্ধ্যা—দু’বেলাই সেখানে বসত বৃদ্ধদের আড্ডা। পার্কের সামনে দিয়ে গেলেই কানে ভেসে আসত বৃদ্ধদের নানা আলাপ আলোচনা। কিছু দিন আগে দেখা হল সে আড্ডারই এক সদস্যের সঙ্গে। কথায় কথায় তিনি জানালেন বিকেলে আর গল্প করতে যান না পার্কে। কারণ জানতে চাইলে উত্তর এল, ‘‘ওখানে পোষায় না। আমরা ওখানে গেলে এখনকার ছেলেমেয়েদের একটু আধটু অসুবিধা হয় কি না।’’

Advertisement

আসল সমস্যাটা এখানেই। সে দিনের সেই বৃদ্ধদের অনেকেই আজকের তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন না। তাঁদের একটা বড় অংশের কাছে সমবয়সী ছেলেমেয়েদের এক সঙ্গে গল্প করাটা অনেক ক্ষেত্রেই ‘দৃষ্টিকটু’ ঠেকে। আবার বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা তাঁদের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন দেখে, অস্বস্তি বোধ করেন আজকের তরুণেরাও। তাঁদের অনেকের কাছে আবার বিষয়টা হয়ে দাঁড়ায় ‘ব্যাকডেটেড’ মানসিকতা থেকে বেরোতে না পারা।

তবে শুধু প্রজন্মগত ব্যবধানই নয়, রয়েছে আরও কয়েকটি বিষয় যার প্রভাবে বৃদ্ধদের এক সঙ্গে বসে আড্ডা মারার দৃশ্য ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে। প্রথমেই বলতে হয় জনসংখ্যার বৃদ্ধি এবং তার জেরে মাঠঘাটের পরিমাণ সঙ্কুচিত হয়ে পড়ার কথা। কাঁকসা ব্লকেই কিছু বছর আগেও দেখা যেত, এমন সমস্ত জায়গায় বৃদ্ধেরা এক সঙ্গে বসে গল্প করছেন যেগুলিকে তথাকথিত ভাবে পার্ক বা শিশু উদ্যানের আওতায় ফেলা যায় না। সেগুলো হয়তো কারও পরিত্যক্ত জমি, নয়তো কোনও বাগান। কিন্তু আজকের যুগে বর্ধিত জনসংখ্যার চাপে তেমন জমির পরিমাণ ক্রমশ কমছে। আজকের যুগে সেই সমস্ত জমিতে মাথা তুলেছে একের পরে এক বহুতল। ফলে, স্থানচ্যুত হচ্ছেন বৃদ্ধ ভ্রমণার্থী তথা আড্ডা দিতে ইচ্ছুক প্রবীণেরা। কোনও কোনও বহুতলে আবার রয়েছে ‘ক্লাবহাউস’, আধুনিক প্রযুক্তির ‘সুইমিং পুল’ বা নানা ধরনের ‘ইন্ডোর গেম’-এর বন্দোবস্ত। ফলে, সেখানকার আবাসিক বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা কেন আর বাইরে গল্পগুজব করার ঝক্কিতে যাবেন?

আগে পানাগড়ের বিখ্যাত দানবাবা প্রান্তর ছিল এলাকার বয়স্ক ও মানুষদের এক সঙ্গে বসে গল্পগুজব করার অন্যতম ঠিকানা। কিন্তু কিছুদিন পরে দেখা গেল, সেখানে এসে খেলাধুলো করছে একদল প্রাণবন্ত বালক। হয়তো তারা যেখানে খেলত সেখানে কোনও বহুতলের কাজ শুরু হয়েছে। তারা বাধ্য হয়ে খেলার জন্য এসে জড়ো হয়েছে মাঠটিতে। কিছু দিন এক সঙ্গে খেলা ও প্রাতর্ভ্রমণ চলার পরে সাধারণত ছেলেদের খেলার বলের ঘায়ে আহত হওয়ার ভয় থেকে বহু বৃদ্ধ আড্ডা দেওয়ার সে জায়গাটি পরিত্যাগ করলেন।

আগেকার দিনে মফস্সলে ‘লাইব্রেরি’ ছিল এমনই একটি জায়গা, যার চত্বরে বসে বহু বৃদ্ধবৃদ্ধা এক সঙ্গে বসে সাহিত্য, দর্শন বা রাজনীতি নিয়ে আলোচনায় মাততেন। কিন্তু এখন শিল্পাঞ্চলের অধিকাংশ লাইব্রেরি সপ্তাহে দু’দিনের বেশি খোলা হয় না গ্রন্থাগারিকের অভাবে। ফলে, অনেক প্রবীণেরই আজ দিন কাটে টেলিভিশনে ‘সিরিয়াল’ দেখে।

আবার এখন অনেক বৃদ্ধবৃদ্ধার সন্তান কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন। ফলে, অশক্ত শরীরে সংসারের যাবতীয় কাজ সামলে আজ আর সময় কোথায় এক সঙ্গে আড্ডা মারতে যাওয়ার? আবার অনেক ক্ষেত্রে বিদেশ-বিভুঁইয়ে থাকা সন্তানেরা বৃদ্ধ পিতামাতার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তায় থাকেন। ফলে, সকাল-বিকেল আড্ডা দিতে বেরনোর বদলে বাবা-মা বাড়িতে থাকলেই নিশ্চিন্ত বোধ করেন তাঁরা। অনেক ক্ষেত্রে তারাই বাবা-মা-কে চাপাচাপি করেন, ‘ঝুঁকি’ নিয়ে বাড়ির বাইরে পা না রাখতে।

তবে সব বয়সের মানুযের জন্য আড্ডা দেওয়ার জায়গা যে একেবারে নেই, তা নয়। কাঁকসায় বনকাটির দেউলে গেলে দেখা যাবে, দলে দলে বৃদ্ধ বৃদ্ধারা ঘুরতে আসছেন। অজয় নদের ধার ঘেঁষে চলাফেরা করছেন সকাল-বিকেল। তাঁদের সঙ্গে মাঝে মধ্যেই এক সঙ্গে বসে গল্প করতে দেখা যায় নবীন প্রজন্মের একাংশকেও। সব প্রজন্মই প্রাণখোলা হাসিতে ফেটে পড়ছে, দেখা যায় তেমন দৃশ্যও। এ জায়গাটি একেবারেই ব্যতিক্রম। ভাল ব্যতিক্রম।

লেখক পানাগড়ের সাহিত্যকর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন