বে সরকারি হাসপাতাল নিয়ে হইচই আপাতত চাপা পড়ে গিয়েছে। এই সুযোগে একটা প্রশ্ন তোলা যাক। সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যখাতে যে টাকা খরচ করেন, সর্বভারতীয় গড়ের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে তার পরিমাণ অনেকখানি বেশি কেন? সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা এখন নিখরচায় মেলে, আগেও খুব বেশি খরচ ছিল না। তবুও, মানুষের খরচ জাতীয় গ়়ড়ের চেয়ে বেশি কেন? এই প্রশ্নের একটাই উত্তর হয়— রাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল এমনই যে দরকারে ভিটেমাটি বিক্রি করেও মানুষ বেসরকারি সংস্থার দ্বারস্থ হয়। হাসপাতালের সংখ্যা কম, এই যুক্তি কিন্তু ধোপে টিকবে না, কারণ গোটা দেশে যেখানে গড়ে ৬৪৪২৫ জনের জন্য একটা সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে, পশ্চিমবঙ্গে ৫৮৬৯৭ জনপ্রতি তেমন একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। অর্থাৎ, সরকারি জায়গায় পরিষেবা পান না বলেই মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে যান।
সরকারি হাসপাতালে পরিষেবা পাওয়া যায় না কেন? সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালগুলিতে তো বটেই, বেশ কিছু জেলা হাসপাতালেও রীতিমত উন্নতমানের যন্ত্রপাতি রয়েছে। খাতায়-কলমে ভাল ভাল ডাক্তাররাও রয়েছেন। তবুও পরিষেবা মেলে না, তার কারণ, সরকারি হাসপাতালগুলো ইনেফিশিয়েন্ট— অকুশলী। এই অকুশলতার একটা বড় কারণ হল নিশ্চয়তা— সরকারি হাসপাতালের কর্মীমাত্রেই জানেন, যা-ই হোক না কেন, চাকরি যাবে না। এবং, সত্যিই চাকরি যায় না। রোগী পরিষেবা পাক আর না-ই পাক, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গায়ে তার আঁচও লাগে না। সরকার সেই নিরাপত্তা দেয়। অর্থাৎ, সরকারি হাসপাতালের পরিষেবার বেহাল অবস্থার পিছনে রয়েছে সরকারই— রয়েছে তার ভুল পরিচালন-নীতি।
উল্টো দিকে আছে বেসরকারি হাসপাতালগুলো। তাদের হরেক বেনিয়মের কথা এখন বহুচর্চিত। কিন্তু, সব কিছু সত্ত্বেও সেই হাসপাতালগুলোকে প্রতিযোগিতার বাজারে করে খেতে হয়। তাদের পিছনে কোনও সরকারি সাহায্যের হাত নেই। যথেষ্ট রোগী না এলে, যথেষ্ট ব্যবসা না হলে তাদের চলবে না। এই হাসপাতালগুলোতে কুশলতার পরিমাণ এই তাগিদেরই ফল।
বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা বিলের একেবারে মূল কথাটুকু যদি দেখি, তা হলে বিলটি বেসরকারি হাসপাতালের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চায়। যে সরকার তার নিজস্ব হাসপাতালগুলোকেই চালাতে পারে না, তারাই তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি কুশলী বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করবে— এই ভাবনার মধ্যেই গোলমাল রয়েছে। আরও বড় গোলমাল নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিতে। প্রাক্-বিশ্বায়ন ভারতে যেমন ইনসপেক্টর রাজের বিভীষিকা ছিল, আশঙ্কা হয়, পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে তেমনই পরিস্থিতি তৈরি হবে। কোন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কত প্রভাবশালী, কত সহজে ধরে ফেলতে পারেন উঁচুদরের নেতা-মন্ত্রীকে, মূল বিবেচ্য হয়ে দাঁড়াবে সেটাই। স্থানীয় স্তরে সিন্ডিকেট তৈরি করে তোলাবাজির যে আশঙ্কার কথা ইতিমধ্যেই বহু বার আলোচিত হয়েছে, সে কথা আপাতত বাদই রাখলাম।
মূল গোলমাল মানসিকতায়। সরকারই সব ঠিক করে দিতে পারে, এহেন রাষ্ট্রবাদী বিশ্বাসই সরকারকে এমন পথে নিয়ে যেতে পারে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় যা চলছে, সেটা নিশ্চিত ভাবেই চলতে দেওয়া যায় না। কিন্তু, সমাধানের পথ আরও বেশি সরকারি খবরদারি নয়। বরং, কর্পোরেটকেই দায়িত্ব দেওয়া, নিজেদের ঠিক পথে রাখার। কর্পোরেট সংস্থা সামাজিক উন্নয়নে বড় অংশী হচ্ছে, এমন উদাহরণ ভারতেই রয়েছে। গোটা দুনিয়ায় তো বটেই। স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রেও তেমনটা না হওয়ার কোনও কারণ নেই। কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে বরং এগিয়ে আসার সুযোগ দেওয়া হোক। তারাই যৌথ ভাবে নিয়ম তৈরি করুক— প্রতিটি হাসপাতাল যে নিয়মগুলো মেনে চলতে বাধ্য হবে। কোনও হাসপাতাল যদি অসৎ, অনৈতিক পথে চলে, তাদের প্রাথমিক ভাবে শাসন করার দায়িত্বও থাকবে এই কর্পোরেট সংস্থাগুলিরই। এই প্রক্রিয়ায় সরকারেরও ভূমিকা রয়েছে— নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষার কাজ করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, একতরফা ভাবে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে চলবে না। সরকার নিয়ন্ত্রক নয়, স্টেকহোল্ডারের ভূমিকা পালন করুক।
প্রশ্নটা বিশ্বাসের। ভারতে সাধারণ মানুষ সচরাচর বাণিজ্যিক পুঁজিকে বিশ্বাস করেন না। অন্য দিকে, সরকারের কাছে যতই অবহেলা মিলুক, তাকে বিশ্বাস না করে মানুষের উপায় নেই। নেতারা যদি এই বিশ্বাসের অসমতাকে রাজনৈতিক পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করতে চান, তবে সেটা দুঃখজনক হবে। তার চেয়ে, কর্পোরেটের ওপর মানুষের বিশ্বাস তৈরি হওয়ার পরিবেশ তৈরি করা ভাল। অন্তত, সেই বিশ্বাস তৈরি করার মতো সুযোগ করে দিন। পুঁজির সঙ্গে, বা ডাক্তারদের মতো পেশাদারদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক যে সাধারণ ভাবে বৈরী বা শত্রুতার নয়, এই কথাটা প্রতিষ্ঠা করার দায় সরকারের রয়েছে।
বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে। যেখানে বেসরকারি ক্ষেত্রকে বাদ দিয়ে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার কোনও উপায় সরকারের হাতে নেই। সরকারের অদক্ষতার জন্যই নেই।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা-য় অর্থনীতির শিক্ষক